বারমাকি কারা? কি ছিল বারমাকিদের পরিচয়?

বারমাকি-কারা-কি-ছিল-বারমাকিদের-পরিচয়


বারমাকি-পরিবার। আব্বাসি সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলােচনায় যাদের কথা বলতেই হয়। আব্বাসি সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে প্রায় পঞ্চাশ বছর (১৩৬ হিজরি-১৮৭ হিজরি) এই পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত সুনাম ও খ্যাতির সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে। বলতে গেলে সাম্রাজ্য পরিচালনার চাবিকাঠি ছিল তাদের হাতেই। তাদের হাতেই বাগদাদ হয়ে ওঠে সুশােভিত। 


বারমাকিদের স্বর্ণযুগ ধরা যায় হারুনুর রশিদের শাসনামল। আবার তাদের পতনও হয় হারুনের হাতেই। বারমাকিদের আদি বাস ছিল বলখে। সেখানে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড ছিল। স্থানীয়রা এই অগ্নিকুণ্ডের উপাসনা করত। ৩১ হিজরিতে (৬৫১ খ্রিষ্টব্দ) মুসলমানদের হাতে বলখ বিজয়ের পর অগ্নিকুণ্ড নিভিয়ে ফেলা হয়। কিছুকাল পরে আবার এই অগ্নিকুণ্ড জ্বালানাে হয়। ৮৬ হিজরিতে (৭০৫খ্রিষ্টাব্দ) কুতাইবা বিন মুসলিম আবার বলখ দখল করেন এবং একে ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই সময় অগ্নিপূজকদের একটি অংশ ইসলাম গ্রহণ করে দামেশকে চলে যায়। ১৩৩ হিজরিতে যখন দারুল খিলাফাহ দামেশক থেকে বাগদাদে সরিয়ে নেওয়া হয় তখন তারাও বাগদাদ গমন করে। এ সময় থেকে রাজদরবারে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। অগ্নিপূজক এই সম্প্রদায়ের নাম ছিল বারমাক। বারমাকের বহুবচন বারমাকি। খালেদ বারমাকি, ইয়াহইয়া বারমাকি, জাফর বারমাকি, ফজল বারমাকি এই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

বারমাকি-কারা বারমাকিদের-পরিচয় বারমাকিদের মুদ্রা
তৎকালীন বারমাকিদের মুদ্রা

বারমাকিরা আব্বাসি সাম্রাজ্যের উন্নয়নে নানাভাবে অবদান রেখেছে। বিশেষ করে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইয়াহইয়া বারমাকি ভারতবর্ষে দূত প্রেরণ করে এখানকার বেশ কজন পণ্ডিতকে বাগদাদ নিয়ে যান। তিনি অনুবাদক নিয়ােগ করে ভারতবর্ষে রচিত চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক বইপত্র অনুবাদ করান। ইয়াহইয়া বারমাকি বাগদাদে ইলমি বিতর্কের আয়োজন করতেন। খলিফা মামুনের আমলে এর আরাে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি সাহিত্য ও কাব্যরচনায় বারমাকিদের পারদর্শিতা ছিল। ফজল বারমাকি বাগদাদে কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রশাসনিক পদোন্নতি ও খলিফার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে বারমাকিরা বিপুল অর্থবৈভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হয়। বাগদাদের। আবাদি জমির বেশিরভাগ তাদের দখলে চলে যায়। এসময় তারাই পর্দার আড়াল থেকে হয়ে ওঠে খিলাফতের নিয়ন্ত্রক। প্রকাশ পেতে থাকে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলাে তাদের দখলে চলে আসে। ইবনে খালদুনের মতে, তারা কোষাগারের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অনেক সময় খলিফা হারুনুর রশিদ প্রয়ােজনে পড়ে কোষাধ্যক্ষের কাছে অর্থ চেয়েও পেতেন না।


নানা কারণে বারমাকিদের অনেক শত্রু তৈরি হয়। এদের একজন খলিফা হারুনুর রশিদের প্রাসাদের প্রধান পাহারাদার (হাজেব) ফজল ইবনে রবি ফজল তার পদমর্যাদাবলে খলিফার কাছে বারমাকিদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেন। তার মন বিষিয়ে তােলেন। খলিফাকে বলা হয় বারমাকিরা বনু আব্বাসের পতন ঘটানাের ষড়যন্ত্র করছে। ফজল ইবনে রবির অভিযোগ ও ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে খলিফা বারমাকিদের উপর ক্রুদ্ধ হন। ১৮৭ হিজরির (৮০৩ খ্রিষ্টাব্দ) একরাতে খলিফা আদেশ দিলেন উজির জাফরকে হত্যা এবং জাফরের পিতা ইয়াহইয়া ও ভাই ফজলকে গ্রেফতার করতে। একইসাথে বারমাকিদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হলাে। খলিফার অনুচর মাসরুরের মাধ্যমে জাফরের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলাে। বারমাকিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। ইয়াহহয়া বারমাকি ও অন্যদের রাক্কা শহরে বন্দি করা হয়। প্রথম এক বছর তাদেরকে কোনাে কষ্ট দেওয়া হয়নি। তাদের সুখ-সুবিধার প্রতিও খেয়াল রাখা হতো।


কিন্তু পরবর্তীতে আবদুল মালিক ইবনে সালেহ ও তার পুত্র খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যড়যন্ত্র করে গ্রেফতার হন। অভিযােগ ওঠে বারমাকিরা এই যড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত ছিল। এবার খলিফা বন্দি বারমাকিদের উপর ক্রুদ্ধ হন এবং সকল সুযােগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন। ১৯০ হিজরিতে (৮০৬ খ্রিষ্টব্দ) বৃদ্ধ ইয়াহইয়া বারমাকি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। মামুন ক্ষমতায় এলে বারমাকিদের মুক্তি দেন এবং তাদের সম্পদও ফিরিয়ে দেন। কিন্তু বারমাকিরা আর তাদের হারানাে জৌলুস ফিরে পায়নি।

Post a Comment

Previous Post Next Post