হযরত মুসআব ইবনে উমাইর (রাযিঃ) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অত্যন্ত আদর যত্নে লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং ধনী ছেলেদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার পিতা তাঁকে দুইশত দেরহামের কাপড় জোড়া খরিদ করে পড়াতেন। নামি দামি সব ধরনের আতর ব্যবহার করতেন তিনি। যুবক মুসআব অত্যন্ত আদর-যত্নে ও মাল-ঐশ্বর্যে লালিত হয়েছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগেই পরিবারের লােকজনকে না জানিয়ে মুসলমান হয়েছিলেন এবং গোপনে এবাদত করতেন। একদিন কেউ বিষয়টি জানতে পারে এবং তার পরিবারের লােকদেরকে জানিয়ে দেয়। তারা তাকে ঘরে নজরবন্দী করে রাখে। কিছুদিন এইভাবে চলার পর কোন এক সুযােগে গােপনে পালিয়ে গেলেন এবং হাবশার দিকে হিজরতকারীদের সঙ্গে চলে গেলেন।
কিন্তু মনটা যেন মক্কাতেই রয়ে গেল। যার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিলেন তাকে মক্কাতে রেখে তিনি ঘুমাবেন কি করে?
তিনি হাবশা থেকে চলে এলেন মক্কায়। মক্কায় আসার পরে তার মা তাকে আবার বন্দী করতে চাইলেন। নির্ভীক মুসআব এবার আর চুপ রইলেন না। তিনি কসম খেয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি যদি আমাকে বন্দি করতে চাও আর যদি কেউ তোমাকে এ কাজে সাহায্য করে তবে তোমাকে-সহ সবাইকে আমি হত্যা করবো।
ছেলের কথায় মা আর সাহস করলেন না৷ তিনি জানতেন তার সন্তান ভয়ানক জেদি। তিনি বুঝতে পারলেন ছেলেকে থামানো যাবে না। কিন্তু তিনি ছেলেকে অনেক ভালোবাসতেন। তাই মুসআবকে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। কিছুতেই রাজি হলেন না মুসআব।
![]() |
প্রতীকী চিত্রঃ প্রকৃতি |
একদিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম তার সাহাবিদের সাথে বসা। মুসআবও তাঁদের সাথে বসা। কিন্তু আজ আর মুসআবের গায়ে চিরচেনা পরিপাটি পোশাক নেই। ময়লাযুক্ত পোশাক আর ছেঁড়া জামা গায়ে বসে আছেন তিনি। জামাটি ছিঁড়ে গেয়ে অনেক জায়গায়। ছেঁড়া অংশে কাপড়ের তালি লাগনো। এ অবস্থা দেখে মুসআবের ইসলাম পূর্ব জীবনের ছবি সাহাবিদের চোখে ভেসে উঠল।এ কি সেই মুসআব, যার আতরের ঘ্রাণ পথচারীদের আকর্ষিত করতো? এ কি সেই মুসআব, যার আভিজাত্যে মুগ্ধ হতো সবাই? সাহাবিদের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। রাসুল (সা.) বললেন, 'মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন ও উৎকৃষ্ট পোশাকধারী কেউ ছিল না। তার চেয়ে পিতামাতার বেশি আদুরের আর কোনো যুবক ছিলো না। আল্লাহ ও তার রসুলের ভালোবাসায় সে সবকিছু ত্যাগ করেছে।'
কিছুদিন পরের ঘটনা। হজ্জের মৌসুমে মদিনা থেকে আগত কিছু লোক রাসুল (সা.) এর কথায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ফিরে যান মদিনায়। তখন মদিনাতে মুসলমানদের দ্বীন শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। তখন নবী (সা.) মুসআব (রাদিঃ) কে পাঠনোর সিদ্ধান্ত নেন। মক্কায় মুসআবের চেয়ে বয়সে বড় অনেক সাহাবি ছিলেন, তবুও তাকেই দূত মনোনীত করা হলো। তার বাগ্মিতা, মেধা, উত্তম চরিত্র, দ্বীনের জন্যে কোরবানি - মুগ্ধ করেছিল নবীজিকে। মুসআব ইসলামের শিক্ষা দিতে লাগলেন মদিনায়। তার দাওয়াতে মুসলিম হলো মদিনার বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ-সহ আরও অনেক বড়ো বড়ো নেতা। মদিনাতে বইতে শুরু করলো ইসলামি বিপ্লবের বাতাস।
ইতিমধ্যে মক্কার মুশরিকদের অত্যাচারে রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেছেন। মুসলিমরা মদিনাতে ভালো আছে দেখে, মক্কার মুশরিকদের অন্তরে আগুন লেগে গেল। তারা ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। মুসলিম ও কুরাইশরা মুখোমুখি হলো বদরের প্রান্তরে। মুসলিমদের ধ্বংস করা তো দূরের কথা তারাই উল্টো নাকানিচুবানি খেয়ে বিদায় নিলো। কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল মুশরিকদের বাহিনী। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার যু্দ্ধ শুরু হলো দুই বাহিনীর মধ্যে। উহুদের প্রান্তরে একত্র হলো দুই বাহিনী। যুদ্ধ শুরুর আগে রাসুল (সা.) কার হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দিবেন, এ নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি গভীরভাবে উপস্থিত সাহাবিদের নিরীক্ষণ করে মুসআবের হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দিলেন।
যুদ্ধ শুরু হলো। একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কুরাইশরা৷ কিন্তু একটি ছোট ভুলের কারণে শেষের দিকে কুরাইশরা আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যায়। বিশৃঙ্খল হয়ে গেল মুসলিম বাহিনী। এ সুযোগে কুরাইশরা নবীজি (সা.) কে টার্গেট করে বসে। যুবক মুসআব বিপদের তীব্রতা বুঝতে পারলেন। উঁচু করে ধরলেন ইসলামের পতাকা আর তাকবীর দিতে দিতে ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেন নবিজিকে নিরাপত্তা দিতে। একহাতে ঝান্ডাধারী মুসআব অন্য হাতে তলোয়ার নিয়ে শত্রুবাহিনীর মধ্যে ঢুকে গেলেন। যুদ্ধ করতে লাগলেন বীর-বিক্রমে।
শত্রুদের আক্রমণ থেকে নবীজিকে রক্ষা করতে নিজেকে ঢাল বানালেন তিনি। ইবনু কামিয়ার আঘাতে তার ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দেহ থেকে। সাথে সাথে বাম হাতে তুলে নিলেন ইসলামের পতাকা। আর বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে লাগলেন, (ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রসূল, ক্বদ খলাত মিন ক্ববলিহির রসূল)। পরে তার বাম হাতটিও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। কর্তিত বাহু দ্বারাই ধরে রাখলেন ঝান্ডাটি। এবার একটি বর্শার আঘাতে তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হযে গেল। বীরের মতো লড়াই করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন মুসআব।
যুদ্ধ শেষ হলো৷ শহীদদের লাশগুলো জড়ো করা হলো একজায়গায়। মুসআবের লাশটি আনা হলো৷ রক্ত আর ধুলোবালিতে তার চেহারা একাকার। সাহাবিরা এ দৃশ্য দেখে কান্না শুরু করলেন। নবিজি (সা.) ও কাঁদলেন।
মুসআবকে দাফন করার জন্যে একটি চাদর আনা হলো। একপ্রস্থ চাদর ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। সে চাদরে মাথা ঢাকালে পা, আর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল।
নবীজি মুসআবের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফি আর কারও ছিল না। আর আজ তুমি এ চাদরে ধুলিমলিন অবস্থায় পড়ে আছো। আল্লাহর রাসুল সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যদানককারী হবে।