আপনাদের একটা গল্প শুনাই। আমাদের খুব প্রিয় একটা গল্প।খলিফা মামুনের সময়ের ঘটনা। দেশব্যাপী খরা চলছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ক্ষুধা ও দরিদ্রের মাঝে থেকে কঠিন সময় পার করছিলেন। তেমনি এক প্রত্যন্ত গ্রামের মরুচারী বেদুইন ঠিক করলেন, খলিফার সাথে দেখা করবেন। জানাবেন তার কষ্টের কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। বেদুইন যাত্রা শুরু করলেন রাজধানী বাগদাদের পথে। অনেক দূরের পথ। বাহন বলতে কিছুই নেই। একমাত্র পায়ে হাঁটাই সম্বল। মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পথ চলতে চলতে বেদুইন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যতদূর চোখ যায়, পানির কোনাে দেখা নেই। বেদুইন তবুও ক্লান্ত অবসন্ন দেহ টেনে নিয়ে সামনে চলল। খলিফার দেখা যে তাকে পেতেই হবে।
![]() |
খলিফা মামুনুর রশীদ ও এক বেদুইন এর ঘটনা। |
বেশ কিছুটা পথ চলার পর বেদুইন থমকে দাঁড়ালেন। এ কি! পানি দেখা যাচ্ছে? বেদুইন দৌড়ে এলেন। এক জায়গায় এক গর্তে আসলেই পানি জমে আছে। তৃষ্ণার্ত বেদুইন দুহাতের আজলা ভরে চুক চুক করে সবটুকু পানি পান করলেন। আহা! এ যে অমৃত! এত মিষ্টি, এত চমৎকার পানি যে আর জীবনেও সে পায়নি। বেদুইন মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। তার মনে হলাে, আল্লাহ অনেক মেহেরবান। এ পানি জান্নাতের না হয়ে পারেই না। আল্লাহ নিশ্চয় দয়া করে শুধু তার জন্যই এ পানি পাঠিয়েছেন। সে মনে মনে ভাবল, খলিফার কাছে যখন যাচ্ছি, তখন উনার জন্য উপহারস্বরূপ এ জান্নাতের নেয়ামত নিয়ে গেলে খলিফা যা খুশি হবেন না। বেদুইন সে পানি একপাত্রে ভরে হাজির হলেন রাজদরবারে। খলিফা খেয়াল করলেন, এই অপরিচিত লােকটি এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলছে না। বােধহয় সাহস করে উঠতে পারছে না।
খলিফা নিজ থেকেই তার পরিচয় জানতে চাইলেন। লােকটি তার পরিচয় জানাল। তারপরে গর্বভরে বলল, মহামান্য খলিফা! অভাবে পড়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। তবে আমি নিঃস্ব হলেও আপনার দরবারে একেবারে খালি হাতে আসিনি। আমি আপনার কাছে আসার সময় পথিমধ্যে এক জান্নাতি নেয়ামতের সন্ধান পেয়েছি। সে নেয়ামতের পানি আমি আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। সে পানি এত মিষ্টি, এত চমৎকার...যার তুলনা পৃথিবীতে বিরল। খলিফা আগ্রহভরে সে পানি মুখে তুললেন। কয়েক চুমুক দিয়ে এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। তারপর উজ্জ্বল চোখে বেদুইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তােমার নিয়ে আসা পানি আসলেই অত্যন্ত মিষ্টি এবং খুব চমৎকার। এর তুলনা সত্যিই বিরল। তুমি যে এত কষ্ট করে আমার জন্য এই পানি নিয়ে এসেছ, আমি এই জন্যে তােমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তােমাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি। তুমি তা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। এখান থেকে বেরিয়ে আর সামনে যাওয়ার দরকার নেই।
![]() |
sample image : water in Desert |
দরবারে উপস্থিত লােকজন তাে অবাক। কী এমন মহামূল্যবান পানীয়, খলিফা যার এত উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন! খলিফার দরবারে নিয়ম ছিল, কেউ কোনাে খাবার জিনিস আনলে, খলিফা অন্যদেরকেও তা খেতে দেন। কিন্তু এই পানীয় খলিফা কাউকে খেতেও দিলেন না। আবার লােকটিকে বললেন, যেন সামনের দিকে না যায়। এসবের মানে কী?
লােকটি চলে যেতেই সবাই খলিফার কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। খলিফা এক গাল হেসে বললেন এই পানির মতাে এত বিশ্বাদ পানি আমি আমার জীবনেও খাইনি। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পথের মাঝে কোনাে এক গর্তে হয়তাে বৃষ্টির পানি জমেছিল। লােকটা সেই পানি আমার কাছে বয়ে নিয়ে এসেছে। বেচারা মরুভূমির মানুষ। সুপেয় পানি খুব একটা চোখে দেখেনি।
পাশাপাশি পথ চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত ছিল। এ অবস্থায় এই পানি তার কাছে অমৃত মনে হয়েছে। সে আন্তরিকতা থেকেই আমার জন্য নিয়ে এসেছে। এখন আমি যদি আপনাদের কাউকে এই পানি খেতে দিতাম, তাহলে তাে রহস্য ফাঁস হয়ে যেত। শুধু শুধু মানুষটা সবার সামনে লজ্জা পেত। আমি তাকে নিষেধ করেছি, যাতে সে সামনে না আগায়। কারণ, আর কিছুদূর গেলেই দজলা- ফোরাত। দজলা-ফোরাতের কাছে এই পানির স্বাদ তুচ্ছ। সে পানি পান করলে তার ভুল ভেঙে যেত। আমি চাইনি, লােকটা এক ধরনের অনুশােচনায় পুড়ুক। যেন তার এ অনুভূতি না হয়, হায় হায় আমি খলিফাকে কী দিয়ে এসেছি!
আমরা যারা ইসলামকে জন্মসূত্রে পেয়েছি, আমরা এর মর্ম বুঝতে পারি না। কিন্তু যারা অমুসলিম পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তারা বােঝেন ইসলাম' আল্লাহ তায়ালার কত বড় নেয়ামাত। তাদের অবস্থা মরুভূমির সেই তৃষ্ণার্ত মুসাফিরের মতাে।
এই ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের আচরনের নমুনা। তারা শত্রুর বিরুদ্ধে ছিলেন অটুট, শক্তিশালী আর প্রজাদের প্রতি ছিলেন কোমলপ্রাণ। আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করে নিজেদের জীবন গড়া উচিত।