তাতার আক্রমনের প্রেক্ষাপটঃ
চেঙ্গিস খান এসেছিল গােবি মরু-অঞ্চল থেকে। মরুভূমিতে ছিটিয়ে থাকা যাযাবর গােত্রগুলাে একত্রিত করেছিল সে। চীনের ক্যাথি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার পর সে অনেকটা স্থির ছিল নিজের রাজধানী কারাকোরামে। তার সীমান্তের সাথেই ছিল খাওয়ারিজম সীমান্ত। চেঙ্গিস খানের লােলুপ দৃষ্টি ছিল সমৃদ্ধ খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের প্রতি। কিন্তু সে পুরোপুরি সাহস করে উঠতে পারছিল না। আচমকা ৬১৫ হিজরিতে (১২১৮ খ্রিষ্টাব্দ) এমন দুটি ঘটনা ঘটল, যার কারণে চেঙ্গিস খানের জন্য খাওয়ারিজম আক্রমণের পথ খুলে গেল। চেঙ্গিস খানের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল খাওয়ারিজম সীমান্তের ভেতর দিয়ে। তাদেরকে গােয়েন্দা সন্দেহে হত্যা করা হয়। এতে চেঙ্গিস খান ক্রুদ্ধ হন। খলিফা নাসির চেঙ্গিস খানের ক্ষোভের কথা জানতে পেরে নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন।
খলিফা চিন্তা করলেন চেঙ্গিস খানকে আলাউদ্দীনের উপর লেলিয়ে দিবেন। খলিফার এই সিদ্ধান্ত ছিল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাকারজনক ঘটনা। এই একটি ঘটনাই তাকে ইতিহাসে কুখ্যাত করে রেখেছে। এই কাজের সামনে তার সকল কীর্তি ম্লান হয়ে গেছে।
তার এই সিদ্ধান্তের না আছে কোনাে শরয়ি বৈধতা, না ছিল কোনাে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। খলিফা তার বুদ্ধি ও কৌশলকে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে কাজে না লাগিয়ে কাজে লাগালেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এক দূতের মাথা নেড়া করে তার চামড়া কেটে লেখা হলাে গােপন বার্তা। খলিফার সিলমােহরের ছাপও দেওয়া হলাে। এক মাস অপেক্ষা করার পর তার মাথায় চুল গজাল। তারপর তাকে পাঠানাে হলাে চেঙ্গিস খানের কাছে। কয়েক মাছ সফর করে সে পৌঁছলাে কারাকুরাম। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য অতিক্রম করার সময় তাকে কয়েকবার তল্লাশি করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। তখন কেইবা জানত নিজের মাথায় সে বহন করছে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের মৃত্যু-পরােয়ানা।![]() |
তাতার আক্রমনের প্রেক্ষাপট |
খলিফার এই বার্তা পেয়ে চেঙ্গিস খানের সাহস বেড়ে যায়। সে বুঝতে পারে সে খাওয়ারিজম আক্রমণ করলে তাদের সাহায্যে আব্বাসিরা এগিয়ে আসবেনা। ফলে সে তাদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত। এরপর সে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে খাওয়ারিজম সাত্রাজ্যের দিকে। খলিফা নাসিরের এই পত্রের ঘটনা অবিশ্বাস্য। ইতিপূর্বে কোনো খলিফা বা মুসলিম শাসক এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেননি। আধুনিক লেখকদের কেউকেউ এই ঘটনা অস্বীকার করেন। তারা এর পক্ষে শক্তিশালী কোনো প্রমাণউপস্থাপন না করে শুধু এতটুকু বলেন যে, একজন খলিফার ব্যাপারে এমন অভিযােগ বিশ্বাস করা যায় না। বাস্তবতা হলাে খলিফা নাসির শুধু খলিফার নাম ও ঐতিহ্য বহন করতেন। তার মধ্যে খলিফার গুণাবলি ছিল অনুপস্থিত। তার এই পত্রের কথা ঐতিহাসিক নথিপত্রে উল্লেখ আছে। ইবনুল আসির, মাকরেজি, ইবনুল ফুরাত, মিরখন্দ, আবুল ফিদা সহ অনেক ঐতিহাসিক এই অভিযােগের সত্যায়ন করেছেন।
![]() |
তাতার আক্রমনের প্রেক্ষাপট |
ইবনুল আসিরের অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি খলিফা নাসিরের সমসাময়িক আলেম। খলিফা নাসিরের জীবদ্দশাতেই তিনি আল কামিল ফিত তারিখ রচনা করছিলেন। ৬১৭ হিজরির (১২২০ খ্রিষ্টাব্দ) ঘটনাবলি লেখার সময় তিনি লেখেন,
মুসলিমবিশ্বে তাতারদের আক্রমণের আরেকটি গােপন কারণ আছে। যা হওয়ার তা হয়েছে। তা এখানে বলা যাবে না। তােমরা সুধারণা রাখাে। আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করাে না। স্পষ্টতই ইবনুল আসির কিছু লুকাচ্ছিলেন। তিনি কী লুকাচ্ছিলেন তা স্পষ্ট করেছেন ৬২২ হিজরির (১২২৫ খ্রিষ্টাব্দ) ঘটনাবলি লেখার সময়। সে বছর খলিফা নাসির ইনতেকাল করেছিলেন। তার জীবনী আলােচনা করার পর ইবনল আসির লেখেন,
অনারবরা খলিফার ব্যাপারে অভিযোগ করে তিনি পত্র লিখে তাতারদের হামলা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই অভিযোগ সত্য। এটা ছিল এমন এক বড় কিয়ামত, যার সামনে অন্যান্য সকল অপরাধ নস্যি। এতে বুঝা যায় খলিফা নাসিরের জীবদ্দশায় তিনি সত্য প্রকাশ করতে পারেননি। এতে তিনি খলিফার আক্রোশের শিকার হতেন। কিন্তু মৃত্যুর পর আর সে ভয় ছিল না। তাই সত্য প্রকাশ করেছেন।
আফসােস, ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য খলিফা ডাকলেন এক অমুসলিম পিশাচকে।