মক্কার কুরাইশদের নির্যাতন ও নবীজির উম্মতের চিন্তা
নবুয়তের চতুর্থ বছরে ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত বন্ধ করতে পৌত্তলিকরা যেসব কাজ করেছে তার বিবরণ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব অপতৎপরতা পৌত্তলিকরা পর্যায়ক্রমে এবং ধীরে ধীরে চালিয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস অতিরিক্ত কিছু করেনি এবং যুলুম অত্যাচারের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও করেনি। কিন্তু তারা যখন লক্ষ্য করলাে যে, তাদের তৎপরতা ইসলামের দাওয়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা পুনরায় সমবেত হয়ে পঁচিশজন কাফেরের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলাে!
এরা ছিলাে কোরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ কমিটির প্রধান ছিলাে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। পারস্পরিক পরামর্শ এবং চিন্তা-ভাবনার পর কমিটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাব অনুমােদন করলাে।
তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাে যে, ইসলামের বিরােধিতা করতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের নির্যাতন করার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতার পরিচরয় দেয়া হবে না। পৌত্তলিকরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পর সর্বাত্মকভাবে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলাে। মুসলমান বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের ক্ষেত্রে পৌত্তলিকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিলাে।
কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ছিলাে কঠিন। কেননা তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসাধারণ মানুষ। সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতাে। তাঁর কাছে সম্মানজনকভাবেই যাওয়া সহজ এবং স্বাভাবিক ছিলাে। তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননাকর এবং ঘৃণ্য তৎপরতা বর্বর এবং নির্বোধদের জন্যেই ছিলাে মানানসই। ব্যক্তিত্বের এ স্বাতন্ত্র্য এবং প্রখরতা ছাড়া আবু তালেবের সাহায্যও তিনি পাচ্ছিলেন। মক্কায় আবু তালেবের প্রভাব ছিলাে অনতিক্রম্য। ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে এ প্রভাব অতিক্রম করা এবং তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করার সাহস কারাে ছিলাে না। এ পরিস্থিতিতে কোরায়শরা নিদারুণ মর্মপীড়ার মধ্যে দিন যাপন করছিলাে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে দ্বীনের প্রচার প্রসার তাদের ধর্মীয় আধিপত্য এবং পার্থিব নেতৃত্ব কর্তৃত্বের শেকড় কেটে দিচ্ছিলাে, সে দ্বীনের ব্যাপারে আর কতােকাল তারা ধৈর্যধারণ করবে? পরিশেষে পৌত্তলিকরা আবু লাহাবের নেতৃত্বে নবী মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতে শুরু করলাে।
প্রকৃতপক্ষে প্রিয় নবীর সাথে আবু লাহাবের শত্ৰুতামূলক আচরণ আগে থেকেই ছিলাে। কোরাইশরা আল্লাহর রসূলের ওপর নির্যাতনের কথা চিন্তা করারও আগে আবু লাহাব চিন্তা করেছিলাে। বনি হাশেমের মজলিস এবং সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এই দুর্বৃত্ত ইতিপূর্বে আরো অনেক জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে।
![]() |
প্রতীকী চিত্রঃ কোরআনুল কারীম |
নিজেন আপন চাচা হয়েও তিনি তার প্রতি এমন কোনো নির্যাতনের পথ বাকি রাখেন নি। মক্কার কুরাইশরা নবীজি (সাঃ) কে দ্বীনের দাওয়াত থেকে ফিরিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্যাতন করতে করতে ব্যর্থ হয়ে দুনিয়ার সব লোভনীয় সুযোগ আর ভোগ সামগ্রীও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম এর সামনে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনোই দ্বীনের দাওয়াতে এতটুকুও পিছুপা হননি। সর্বদাই তিনি উম্মতের মুক্তির চিন্তায় বিভোর থাকতেন। এমনকি বিচারের দিনের মতো ভয়াবহ অবস্থায় যখন সকল মানুষ ও নবীরা নিজেকে বাঁচানোর ফিকিরে ব্যস্ত তখন তিনি ঠিকই আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করবেন। যখন সবার মুখে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি উচ্চারিত হবে তখন আমাদের নবীর কন্ঠে শোনা যাবে ইয়া উম্মাতি ইয়া উম্মাতি।।।
১.তিরমিযি
২. তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ৩য় খন্ড, পৃ. ২৮২ তাফসীর তাফহীমুল কোরআন, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ষষ্ঠ খন্ড, ৫২২ (উর্দু সংস্করণ)
৩. তাফসীর তাফহীমুল কোরআন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ. ৪৯০ (উর্দূ সংস্করণ)
৪.জামে তিরমিযি
৫. আর রাহেতুল মাখতুম, আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী। পৃ. নং ১০১-১০৩