বাগদাদে হালাকু তান্ডব (বাগদাদ আক্রমণ)

বাগদাদে হালাকু তান্ডবঃ হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমনের মধ্যদিয়েই আব্বাসীয় খিলাফতের পতন হয়। রক্তপিপাসু হালাকু বাহিনী সেদিন বাগদাদকে রক্তগঙ্গায় পরিনত করে। বাগদাদ আক্রমনের পিছনে যে কারণটি অলক্ষ্যেই রয়ে যায় সর্বদা তা নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করবো। 


সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন আল মুসতাসিম বিল্লাহ। মুসতাসিমের শাসনকালের শেষদিকে মিশরে সর্বশেষ আইয়ুবি সুলতান আল মালিকুস সালিহ নাজমুদ্দীন আইয়ুব ইনতেকাল করেন। ক্ষমতায় বসেন তার স্ত্রী শাজারাতুদ দুর। এভাবে মিশরে সূচনা হয় মামলুক শাসনের।

 

মুসতাসিম যদিও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন; কিন্তু শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অযােগ্য। একটি পতনান্মুখ সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল তার জানা ছিল না। তার উজির ছিল আলকামি। সে ছিল কট্টর শিয়া। তার উসকানিতে বাগদাদে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময় আলকামি খলিফাকে পরামর্শ দেয় এত বড় সেনাবাহিনী লালন করার কোনাে দরকার নেই। অযথাই অটেল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আলকামির পরামর্শে খলিফা সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা হ্রাস করেন। এটি ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, যা শত্রুদের কাজ সহজ করে দিয়েছিলা আলকামি যদিও খলিফার উজির ছিল এবং খলিফা তার পরামর্শ মেনে নিতেন; কিন্তু খলিফা শিয়াদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। খলিফারি আবু বকর এবং আমির রুকনুদ্দীন কারখের মহল্লায় শিয়াদের একটি বসতিতে হামলা করেন। আলকামি এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়। আব্বাসিদের হটিয়ে আলাবিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করবে। সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশকেও ভেঙে দেয়। 


শিয়াদের চক্রান্ত
এরপর সে হালাকু খানের। কাছে পত্র লিখে তাকে বাগদাদ আক্রমণের পরামর্শ দেয়। আবুল ফিদা লিখেছেন, আলকামি হালাকু খানের কাছে পত্র লিখে বাগদাদ আক্রমণ করতে বলে এবং নিজের ভাইকে মৌখিক বার্তা দিয়ে হালাকু খানের কাছে পাঠায়।ঐতিহাসিক জালালুদ্দীন সুয়ুুতি লিখেছেন, খলিফা তার শিয়া উজির আলকামির উপর খুব ভরসা করতেন। সে যেভাবে চাইত খলিফাকে ব্যবহার করত। গোপনে সে তাতারদের সাথে বার্তা বিনিময় করে। তার এই যোগাযােগ সম্পর্কে খলিফা কিছুই জানতেন না। হালাকু খান আলকামির পত্র পেতেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার মনে কিছুটা দ্বিধাও ছিল। আব্বাসি খিলাফতে আক্রমণ করলে পুরাে মুসলিমবিশ্ব ফুসে উঠবে। এই ঝুঁকি নিবে কিনা তা নিয়ে হালাকু খান দ্বিধান্বিত ছিল। এ সময় হালাকু খানের দরবারে শিয়া জ্যোতির্বিদ নাসিরুদ্দীন তুসির খুব প্রভাব ছিল। হালাকু খান কোনাে কাজ করার আগে তার পরামর্শ নিতেন। সে হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের পরামর্শ দেয়।


বাগদাদ আক্রমন
হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণ


বাগদাদ আক্রমণঃ ৬৫৫ হিজরির জিলহজ মাসে হালাকু খান তার বাহিনী নিয়ে রওনা হয়। এ সময় আব্বাসি খলিফা ছিলেন আমােদ-প্রমােদে ব্যস্ত। এখানে একটি ঘটনা বলা যায়। হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণের আগে মােসুলের আমির বদরদ্দীন লুলুর কাছে দুটি পত্র এসেছিল। একটি পাঠিয়েছিলেন খলিফা মুসতাসিম। তিনি একজন ভালাে গায়িকার সন্ধান চেয়েছিলেন। অপর পত্র অসেছিল হালাকু খানের পক্ষ থেকে। সে চেয়েছিল ভালাে একটি মিনজানিক। এই দৃশ্য দেখে বদরুদ্দীন লুলু বলেছিল, ইসলাম এবং তার। অনুসারীদের জন্য কাঁদো। এ থেকে বুঝা যায় হালাকু খান যখন বাগদাদ আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত, খলিফা তখন বিনােদনে মত্ত। এমন হলে সে জাতির ধ্বংস নেমে আসবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাদের কোনাে সাহায্য করেন না, যারা তার দীনকে সাহায্য করে না। 


হালাকু খানের বাহিনী বাগদাদের কাছাকাছি চলে এল। এদিকে খলিফা তার সেনাবাহিনী আগেই ছােট করে ফেলেছেন। তাতারদের প্রতিরােধ করার কেউ নেই। তাতারদের প্রতিহত করার জন্য আব্বাসিদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী এগিয়ে গেলেও তাতাররা সহজেই তাদের পরাজিত করে। হালাকু খানের বাহিনী এগিয়ে এসে বাগদাদ অবরাধ করে। তখনাে আলকামির প্রতিশােধের নেশা থামেনি। সে খলিফা এবং শহরের গণ্যমান্যদের আশ্বাস দিয়ে বলে হালাকু খান কারাে কোনাে ক্ষতি করবে না। এমনকি নিজের মেয়ের সাথে খলিফার ছেলে আবু বকরের বিয়ে দিবে। এই বলে সে খলিফা, আমির ও আলেমদের এক বিশাল জামাতকে হালাকু খানের কাছে নিয়ে যায়। হালাকু খান তাদের সবাইকে হত্যা করে। এমনকি খলিফাকে বস্তায় ভরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার দাফন-কাফনও করা হয়নি।

তাতাররা বাগদাদে প্রবেশ করে টানা কয়েকদিন তারা এখানে নির্মম গণহত্যা চালায়। ইবনে খালদুনের বর্ণনামতে তারা বাগদাদে ১৬ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। বাগদাদের সমৃদ্ধ কুতুবখানাগুলার সব বই তারা দজলা নদীতে ফেলে দেয়। মুসতাসিমকে হত্যার মধ্য দিয়ে আব্বাসিদের পাঁচশাে বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সমৃদ্ধ শহর বাগদাদকে নির্জন কবরস্থানে পরিণত করে তবেই তাতাররা বাগদাদ ত্যাগ করে।



তথ্যসূত্রঃ
১. সিয়ার আলামিন নুবালা- ২২/১৭৫
২. আব্বাসীয় খিলাফাহ- ইমরান রাইহান - পৃঃ ২৭৫-২৭৬
৩. তারিখে ইবনে খালদুন - ৩/৪৫৩
৪. দাওয়ালুল ইসলাম - ২/১১৯



Post a Comment

Previous Post Next Post