হস্তি বাহিনীর ঘটনাঃ গভর্নর আবরাহা সাবাহ

আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর পক্ষ থেকে আবরাহা সাবাহ হাবশী ইয়েমেনের গভর্ণর জেনারেল ছিলাে। গভর্নর আবরাহা লক্ষ্য করলাে যে, আরবের লােকেরা কাবাঘরে হজ্জ পালনের জন্যে যাচ্ছে। এটা দেখে সে সনয়ায় একটি গীর্জা তৈরী করলাে। সে চাচ্ছিলাে যে, আরবের লােকেরা হজ্জ পালনের জন্যে মক্কায় না গিয়ে সনয়ায় যাবে। এ খবর জানার পর বনু কেনানা গােত্রের একজন লােক আবরাহার নির্মিত গীর্জার ভেতর প্রবেশ করে গীর্জার মেহরাবে পায়খানা করে এলাে। আবরাহা এ খবর পেয়ে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ষাট হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্য নিয়ে কাবাঘর ধ্বংস করতে অগ্রসর হলাে। নিজের জন্যে সে একটি বিশাল হাতী ব্যবস্থা করলাে। তার বাহিনীতে মােট নয় বা তেরােটি হাতী ছিলাে। আবরাহা ইয়েমেন থেকে মােগাম্মাস নামক জায়গায় পৌছে সৈন্যদের বিন্যস্ত করলাে। মক্কায় প্রবেশের পর মােযদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী মােহাস্সের প্রান্তরে পৌছুলে সব হাতী বসে পড়লাে। অনেক চেষ্টার পরও কাবার দিকে যাওয়ার জন্যে হাতীকে উঠানাে সম্ভব হলাে না। চেষ্টা করলে হাতী উঠে উত্তর, দক্ষিণ বা পূর্ব দিকে দৌড়াতে শুরু করতাে। কিন্তু কাবার দিকে নেয়ার চেষ্টা করলেই বসে পড়তাে। এ সময় আল্লাহ তায়ালা এক পাল চড়ই পাখি প্রেরণ করলেন।


পাখিরা মুখে ছােট ছােট পাথর বহন করছিলাে। এসব পাথের তারা সৈন্যদের ওপর নিক্ষেপ করলাে। এর মাধ্যমে আবরাহার সেনাদল ভূষির মতাে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলাে। চড়ই পাখিগুলাে ছিলাে আবাবিলের মতাে। প্রতিটি পাখি তিনটি পাথর বহন করছিলাে। একটি মুখে, অন্য দু'টি দুই পাখার নীচে। পাথরগুলাে ছিলাে মটরুটির মত। যার গায়ে সে পাথর পড়তাে, তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খসে পড়তে শুরু করতাে এবং সে মরে যেতাে। প্রত্যেকের গায়ে এ পাথর পড়েনি। কিন্তু সেনাদলের মধ্যে এমন আতঙ্ক এবং বিভীষিকা সৃষ্টি হলাে যে, সবাই এলােপাতাড়ি পালাতে শুরু করলাে। এরপর তারা এখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলাে। এদিকে আবরাহার ওপর আল্লাহ তায়ালা এমন গযব নাযিল করলেন যে, তার হাতের আঙ্গুল খসে পড়তে শুরু করলাে। সনয়ায় পৌছুতে পৌছুতে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলাে। কলিজা ফেটে বাইরে এসে মর্মান্তিকভাবে সে মৃত্যুবরণ করলাে। আবরাহার এ হামলার সময় মক্কার অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লাে এবং পাহাড়ের গুহায় গিয়ে আত্মগােপন করলাে। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হলে তারা নিশ্চিত্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেলাে।


হস্তি বাহিনীর ঘটনা। হস্তি বাহিনীর ঘটনা। হস্তি বাহিনীর ঘটনা।


উল্লিখিত ঘটনা অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার অভিমত অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন দিন আগে ঘটে। সেটি ছিলাে মহররম মাস। ৫৭১ ঈসায়ী সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ বা মার্চের শুরুতে এ ঘটনা ঘটেছিলাে।


প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী এবং তাঁর পবিত্র ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে এর ভূমিকাস্বরূপ এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। যেমন ৫৮৭ সালে বখতে নসর বায়তুল মাকদেস দখল করেছিলাে। এর আগে ৭০ সালে রােমকরা বায়তুল মাকদেস অধিকার করেছিলাে। পক্ষান্তরে কাবার ওপর খৃষ্টানরা কখনােই আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। অথচ সে সময় ঈসায়ী বা খৃষ্টানরা ছিলাে আল্লাহ বিশ্বাসী মুসলমান এবং কাবার অধিকারীরা ছিলাে পৌত্তলিক।


হস্তীযুদ্ধের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই অল্প সময়ের মধ্যেই তদনীন্তন উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিত রােম এবং পারস্যে এ খবর পৌছে গিয়েছিলাে। কেননা মক্কার সাথে রােমকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। অন্যদিকে রােমকদের ওপর পারসিকদের সব সময় নযর থাকতাে। রােমক এবং তাদের শত্রুদের যাবতীয় ঘটনা পারস্য বা পারসিকরা পর্যবেক্ষণ করতাে। তাই দেখা যায় যে, আবরাহার পতনের পর পরই পারস্যবাসীরা ইয়েমেন দখল করে নেয়। সে সময়কার বিশ্বে পারস্য এবং রােম উন্নত ও সভ্য দেশ হিসাবে পরিচিত থাকায় বিশ্ব মানবের দৃষ্টি কাবার প্রতি নিবদ্ধ হলাে। কাবাঘরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা প্রত্যক্ষ করলাে। তারা বুঝতে পারলাে যে, এই ঘরকে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ঘর হিসাবে মনােনীত করেছেন। কাজেই মক্কার জনপদ থেকে নবুয়তের দাবীসহ কারাে উত্থান অবশ্য সমীচীন। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী পৌত্তলিকদের আল্লাহ তায়ালা কেন সাহায্য করেছিলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের কথা চিন্তা করলে তা বুঝতে মােটেও অসুবিধা হয় না।


তথ্যসূত্রঃ

১. ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৪২-১৪৭
২. ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পূ. ৪৩, ৫৬
৩.তালকিহুল ফুহুম পূ. ৮, ৯, রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পূ. ৫৬, ৬৬
৪. ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৫১-১৫৫, রহমাতুললিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ. ৮৯, ৯০, মুখতাছার সীরাতে রাছুল/শেখ আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ. ২২, ২৩
৫. ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৫৬, ১৫৮, ফেকহুস সিয়ার, মােহাম্মদ গাযালী, পৃ.. ৪৫, রহমাতুল লিল আলামিন, ২য় খন্ড পূ. ৯১,
৬.তাবাকাতে ইবনে সাদ /১ম খন্ড, পূ. ৬২
৭.মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ. ১২ তালাকিহুল ফুহুম, পৃ. ১৪, সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড পৃ. ৯৬
৮. আর রাহেতুল মাখতুম/ পৃষ্ঠা নং ৬৮-৬৯

أحدث أقدم