মাযহাব ও তাকলীদ : একটি সরল মূল্যায়ন

মাযহাবের গুরুত্বঃ

প্রত্যেক মুসলমানের উপর মূলতঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ করা ফরয। কুরআন এবং হাদিসের অনুসরণের মাধ্যমেই এ ফরয আদায় হবে। কিন্তু সরাসরি যারা কুরআন হাদীছের ভাষা-আরবী বােঝেন না, কিংবা আরবী ভাষা বুঝলেও কুরআন হাদীছ যথাযথ ভাবে অনুধাবন ও তা থেকে মাসআলা-মাসায়েল চয়ন ও ইজতেহাদ করার জন্য আরবী ব্যাকরণ, আরবী অলংকার, আরবী সাহিত্য, উসূলে ফেকাহ, উসূলে হাদীস উসুলে তাফসীর ইত্যাদি যে সব আনুষঙ্গিক শাস্ত্রগুলাে বােঝা প্রয়ােজন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সেগুলাে পাঠ করেননি বা পাঠ করলেও গভীরভাবে এসব বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারেননি, তাদের পক্ষে সরাসরি সব মাসআলা-মাসায়েল কুরআন হাদীছ থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ (গবেষণা) করে বের করা যেমন সন্তভব নয় তেমনি তা নিরাপদও নয় বরং গভীর বুৎপত্তি ও দক্ষতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও গােমরাহীর শিকার হয়ে যাওয়ার সন্তাবনাই স্বাভাবিক। তো আপনার কি করা উচিত? আজ এই মুহূর্তে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন কিংবা আপনি জন্মগতভাবেই মুসলিম, এ মুহূর্তে আপনি ইসলামের কোনো বিধান পালন করতে চান, তো আপনাকে আলেম-উলামা বা ইসলাম সম্পর্কে জানেন-এমন ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের এই ভূখন্ডে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা ঈমান শিখেছিলেন ইসলাম-প্রচারকদের কাছে। এরপর তাদের কাছেই নামায আদায় করতে শিখেছিলেন। আজ এবং অনাগত দিনেও পৃথিবীব্যাপী প্রতিটি নওমুসলিমই ঈমান, অযু-গোসল, হালাল-হারাম, সালাত-যাকাত, সিয়াম-হজ্ব ইত্যাদির প্রথম ধারণা লাভ করবেন তার ইসলাম গ্রহণের প্রথম মাধ্যম ব্যক্তিটির কাছ থেকে এবং বহু কিছু তিনি শিখে নিবেন মুসলিমসমাজের ধর্মীয় কার্যক্রম ও কালচার থেকে। এ বিষয়টি আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যদি কল্পনা করি সে সময়টির কথা, যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত উন্নত হয়নি। শিক্ষা-দীক্ষার হার ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যম বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছিল না এত বই-পুস্তক, পত্রিকা ও প্রকাশনা। তখন ভাবের আদান-প্রদান ও যোগাযোগের একটিই উপায় ছিল। তা হল মৌখিক জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলন। অর্থাৎ হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া।
মাজহাব ও তাকলীদ | মাজহাব কেন গুরুত্বপূর্ণ | মাযহাব মানার দলিল | নির্দিষ্ট মাযহাব মানার কারন
মাযহাব ও তাকলীদ

মাযহাব কাদের জন্যঃ

যারা ফিকাহ্ শাস্ত্রে বিশেষ বৎপুত্তি লাভ করেনি সেসব শ্রেণীর লােকদের জন্য বিস্তারিত মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধানের জন্য এমন কোন বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া ব্যতিত গত্যন্তর নেই, যিনি উপরােক্ত বিদ্যাসমূহে পারদর্শী ও দক্ষ হওয়ার ফলে সরাসরি সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান কুরআন হাদীছ থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ করে বের করতে সক্ষম। এরূপ বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম তথা মুজতাহিদ ইমামের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি কুরআন-হাদীস থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ করে সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান যেভাবে বলেন তার অনুসরণ করাকেই বলা হয় উক্ত ইমামের তাকলীদ করা বা উক্ত ইমামের মাযহাব অনুসরণ করা। তাকলীদ করা তাই উপরােক্ত শ্রেণী সমূহের লােকদের জন্য ওয়াজিব এবং যে ইমামেরই হােক এরূপ যে কোন এক জনেরই তাকলীদ করা ওয়াজিব। 

নির্দিষ্ট মাযহাবকেই অনুসরণ কেন?

উম্মতের ইজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এক সাথে একাধিক ইমামের অনুসরণ করা যাবেনা, অর্থাৎ এক এক মাসআলায় এক এক জনের অনুসরণ করা যাবেনা। বরং যে কোন একজন ইমামেরই পুরােপুরি অনুসরণ করতে হবে। এক এক মাসআলায় এক এক জনের অনুসরণ করার অবকাশ নেই এবং সেরূপ করা জায়েযও নয়, যেকোনো একটি মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়ার কারণ হলো, যদি মানুষকে ফিকাহ্'র ক্ষেত্রে যে কোন মাযহাব অনুসরণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় তাহলে এর ফল এই দাঁড়াবে যে- মানুষ কেবল প্রতিটি মাযহাবের সহজ সহজ বিষয়গুলাে খুঁজে বের করবে এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় ওই সহজগুলােই মেনে চলবে। হালাল-হারাম, ওয়াজিব-জায়েযের ক্ষেত্রে তারা পূর্ণ স্বাধীন হয়ে পড়বে। অবশেষে শরীয়তের বিধানাবলী অনুসরণে আর কোন বাঁধন থাকবে না। (বরং সর্বত্র স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছঙ্খলতা ছড়িয়ে পড়বে।) তবে ইসলামের প্রথম যুগে ব্যক্তি-তাকলীদের কোন সুযােগই ছিল না। কারণ, তখনও ফিকহী মাযহাব পরিপূর্ণরূপে সংকলিত ও প্রচারিত হয়নি। (কিন্তু এখন যখন ফিকহী মাযহাবসমূহ লিখিত সংকলিত ও সর্বজনবিদিত তখন) সকলকেই যে কোন একটি মাযহাবকে নির্বাচন করতে হবে, অতঃপর সেই নির্দিষ্ট মাযহাবেরই তাকলীদ করতে হবে। 

ইমাম নববী (রহ.) এখানে একথাই বলেছেন : যদি যখন যে ইমামের খুশি তখন সে ইমামের তাকলীদ করার উম্মুক্ত অনুমােদন দেয়া হয়, তাহলে হালাল-হারাম একাকার হয়ে যাবে। তখন আর শরীয়তের বিধানাবলীর অনুসরণই থাকবে না। এর ব্যাখ্যা হলাে এই- সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হাজারাে ফকীহ্ মুজতাহিদ সৃষ্টি হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ আলেমগণ জানেন, প্রত্যেক ফকীহ্'র মাযহাবেই কিছু কিছু এমন সহজ বিষয় আছে যা অন্য মাযহাবে নেই। তাছাড়া মুজাহিদগণতাে আর ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না! প্রত্যেক মুজতাহিদের মাযহাবেই এমন দু'একটি বিষয় পাওয়া যায় যা উম্মাহর গরিষ্ঠ মতের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এখন যদি তাকলীদের পথ মুক্ত বা খােলা রাখা হয় আর লোকজন মুজতাহিদগণের সেই সহজ বিষয়গুলাে খুঁজে খুঁজে আমল করতে থাকে তাহলে ইমাম নববী (রহ.) যা বলেছেন তাই তাে হবে। তখন আর শরীয়তের বিধানাবলীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন ইমাম শাফিঈ (রহ.) এর মাযহাবে দাবা খেলা জায়েয আছে। হযেরত আব্দুল্লাহ ইবন জাফর (রাযি.) এর প্রতি সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয় যে, তিনি সঙ্গীতকে বৈধ মনে করতেন। হযরত কাসিম ইবন মুহাম্মাদ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি ছায়াহীন ফটো ও চিত্র গ্রহণকে জায়েয মনে করতেন। হযরত ইমাম আমাশ (রহ.) মনে করতেন- সুবহে সাদেক থেকে নয়- বরং রােযার সূচনা হয় সূর্যোদয় থেকে। হযরত আতা ইবন আবী রাবাহ (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, যদি জুমুআর দিবসে ঈদ হয়, তাহলে সেদিন জুমুআ এবং জোহর নামায উভয়টাই মাফ। সেদিনের জন্যে আসর পর্যন্ত আর কোন ফরয নামায নেই। আল্লামা দাউদ যাহেরী (রহ.) ও আল্লামা ইবন্ হাযাম (রহ.) এর মতে, কেউ যদি কোন নারীকে বিয়ে করতে কৃত সংকল্প হয় তাহলে তার জন্য ঐ নারীকে বিবস্ত্র করে দেখাও জায়েয আছে। আল্লামা সাহনূনের দিকে সম্পৃক্ত করে একটি মত বর্ণনা করা হয়েছে সে মতে স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে সংগম করা বৈধ।

উদাহরণ হিসেবে গুটিকয়েক মাসায়েল এখানে উল্লেখ করা হলো। নতুবা এমন অনেক মাসায়েল আছে। যদি যেকোনো মাযহাব একই সাথে অনুসরণ করার বৈধতা দেয়া হয় তবে সমাজে হালাল-হরাম মিশ্রিত হয়ে যাবে।তখন আর শরীয়তের বিধানাবলীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইতিহাসে অনুরূপ মুজতাহিদ ইমাম অনেকেই অতিবাহিত হয়েছেন। তবে তম্মধ্যে বিশেষভাবে চাবজন ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযােগ্যতা লাভ করেছেন এবং তাদের চয়ন ও ইজতিহাদবকৃত মাসআলা-মাসায়েল তথা তাঁদের মাযহাব ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়ে আসছে। তাই আমরা চার ইমাম ও চার মাযহাব-এর কথা শুনে থাকি। উক্ত চার জন ইমাম হলেন হযরত ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ), হযরত ইমাম শাফিঈ (রহঃ), হযরত ইমাম মালেক (রহঃ) ও হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)। তাদের মাযহাবকেই যথাক্রমে হানাফী মাযহাব, শাফিঈ মাযহাব, মালেকী মাযহাব ও হাম্বলী মাযহাব বলা হয়ে থাকে।

উপরােক্ত সব মাযহাবই হক, তবে অনুসরণ যে কোন একটারই করতে হবে, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে। উপমহাদেশের মুসলমানসহ পৃথিবীর অধিক সংখ্যক মুসলমান হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর তথা হানাফী মাযহাব-এর অনুসারী।

মাযহাব কেন মানবেন : একটি দালিলিক প্রমাণ 

অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে, এক আল্লাহ, এক নবী এক কুরআন, তাহলে এত মাযহাব কেন! আসলে 'মাজহাব' অর্থ কি তা তারা ভালভাবে খেয়াল করেননা। এখানে মাযহাব অর্থ ধর্ম নয় যে, একাধিক মাযহাব থাকলে ধর্ম একাধিক হয়ে গেল। বরং পূর্বেই বলা হয়েছে বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম তথা মুজতাহিদ ইমামের ব্যাখ্যাকেই এখানে মাযহাব বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অতএব বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম একাধিক থাকার ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যাও একাধিক হতে পারে। এভাবে মাযহাব একাধিক হয়ে গিয়েছে। আরও মনে রাখতে হবে অনুসরণীয় সব ইমামই কুরআন-হাদীছের আলােকে সব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের কারও ব্যাখ্যাই কুরআন-হাদীছের বাইরে নয়। কোন বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতবিরােধ থাকলে সকলের মতের স্বপক্ষেই কুরআন/হাদীছ রয়েছে। অর্থাৎ, কুরআন-হাদীছে সে বিষয়ে একাধিক সূরতের আবকাশ রয়েছে। তাই সব মাযহাবই হক, তবে অনুসরণ যে কোন একটারই করতে হবে, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে।

তথ্যসুত্রঃ
১. মাযহাব ও তাকলীদ : কি ও কেন?/ মুফতি তাকী উসমানী
২. আহকামে জিন্দেগী / মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন
أحدث أقدم