সুলতান মালিক শাহঃ
জালাল আল-দৌলা মালিক-বেগ (মালিক শাহ) (ফার্সি : ملكشاه, আধুনিক তুর্কি : Melikşah) ১০৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মকালে তার নাম ছিলো জালাল আল-দৌলা মালিক বেগ। ১০৭২ সালে তিনি তার পিতা সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের উত্তরাধীকারী হন। এবং মালিক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১০৯২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। তার শাসনকালে সেলজুক সাম্রাজ্য অর্ধ-পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
মালিক-শাহ জন্মগ্রহণ করেছেন ১০৫৫ সালের ১৬ ই আগষ্ট। শৈশবের বেশিরভাগ সময় তিনি ইসফাহানেই অতিবাহিত করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর পার্সিয়ান ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন আলী রাওয়ান্দি মালিক শাহ এর বৈশিষ্ট্যে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, মালিক-শাহের ত্বক ফর্সা ছিল, লম্বা এবং কিছুটা ভারী দৈহিক ধরনের ছিল। ১০৬৪ সালে মালিক-শাহ ততক্ষণে মাত্র নয় বছর বয়সী, নিজাম আল-মুলকের সাথে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের উজির হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ককেশাসে আল্প আরস্লানের প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। পরে মালিক-শাহ করখানিদ খান ইব্রাহিম তমঘাচ-খানের কন্যা তেরকিন খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১০৬৬ সালে, অলপ আরসলান মারভের কাছে একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, যেখানে তিনি মালিক-শাহকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন এবং মালিক শাহকে ইসফাহানের শাসন ভার অর্পণ করেন।
১০৭২ সালে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনাকালে সুলতান আল্প আরসালান বেগ আততায়ীর হাতে মারা যান। ঘটনাটি ছিল এই-
মানযিকার্টের যুদ্ধের পর আল্প আরসালান পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ অধিকার করেন। এরপর তিনি তার পূর্বপুরুষদের অঞ্চল তুর্কিস্তান অধিকার করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি আমু দরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। নদী পার হওয়ার আগে কিছু দুর্গ দখল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তৎমধ্যে একটি বেশ কয়েকদিন ধরে ইউসুফ আল-হারেযমি প্রতিরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মসমর্পণে বাধ্য হন এবং সুলতানের সামনে তাকে আনা হয়। সুলতান তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। ইউসুফ তৎক্ষণাৎ তার ছুরি বের করে সুলতানের উপর হামলা চালান। এর চার দিন পর ১০৭২ সালের ২৫ নভেম্বর আল্প আরসালান মৃত্যুবরন করেন।
বাবা আল্প আরসালানের মৃত্যুর পরে মালিক-শাহ সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু মালিক-শাহ শান্তিপূর্ণভাবে সিংহাসনে প্রবেশ করতে পারেননি। সে সময় তার চাচা কাভর্টের সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। তার চাচাও চাইছিলেন সিংহাসনের অধিকার নিজের কাছে রাখতে। আর এর জের ধরেই, পিতার হত্যাকান্ডের পর সুলতান মালিক শাহকে তার চাচা কাভুর্টের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। ১০৭৪ সালের জানুয়ারিতে হামাদানের নিকটে তাদের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের আগে, তাঁর চাচা কভুর্ট নিজের জন্য সিংহাসন দাবি করেছিলেন এবং মালিক-শাহকে একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যাতে বলা হয়েছিল: "আমি বড় ভাই এবং আপনি একটি যুবক পুত্র; আমার ভাইয়ের সিংহাসনে আমার অধিকার আছে, আরসলানের উত্তরাধিকার। "
তারপরে মালিক-শাহ নীচের বার্তাটি পাঠিয়ে জবাব দিলেন: "ছেলে থাকলে ভাই উত্তরাধিকার হয় না।"
এই বার্তাটি কাভার্টকে ক্রুদ্ধ করেছিল, যিনি এরপরে ইসফাহান অধিকার করেছিলেন। ১০৭৩ সালে হামদানের কাছে একটি যুদ্ধ হয়েছিল, যা তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। কাভার্টের সাথে তার সাতজন পুত্র ছিল এবং তাঁর সেনাবাহিনী তুর্কমেনীদের নিয়ে গঠিত ছিল অন্যদিকে মালিক-শাহের সেনাবাহিনী ছিল গোলাম ("সামরিক দাস") এবং কুর্দি এবং আরব সেনার সৈন্যদের সমন্বয়ে।
যুদ্ধের সময়, মালিক-শাহের সেনাবাহিনীর তুর্কিরাও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তবুও তিনি কাভার্টকে পরাজিত করেন এবং ইসফাহান দখল করতে সক্ষম হন। কাভুর্ট তখন করুণার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং এর বিনিময়ে ওমানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ফলে মালিক শাহ চাচার প্রতি দয়া দেখান এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। তবে সেসময় নিজাম আল-মুলক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ তিনি দাবি করেন যে, তাকে ছেড়ে দেওয়া দুর্বলতার ইঙ্গিত।
কিছুক্ষণ পরে কাভুর্টকে তীরের সাহায্যে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল, তার দুই পুত্রকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ধারনা করা হয়, এটি নিজামুল মুলকের আদেশেই করা হয়৷ মালিক শাহ সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রধান হলেও তার উজির নিজামুল মুলক ছিল অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাকে ছাড়া সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। বস্তুত নিজামুল মুলকের দ্বারাই সাম্রাজ্যের শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান ছিল। তার গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত। রাজ্যের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মালিক শাহর উজিরকে নিজামুল মুলক উপাধি দেওয়া হয়েছিল৷ নিযামের অধীনে সেলজুক সেনাবাহিনী গজনভিদের খোরাসানে অবরুদ্ধ করে রাখে, ফাতেমীদেরকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করে, সেলজুক রাজত্বের দাবিদারদের পরাজিত করে, জর্জিয়াকে করদ রাজ্যে পরিণত করে, আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে এবং আব্বাসীয় খলিফাকে হীনবল করে ফেলে। আল্প আরসালান বেগের সময়েও তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের উজির ছিলেন।
![]() |
Seljuk empire (source: en.Wikipedia.org) |
মালিক-শাহ তুরস্কের যুদ্ধবাজার অর্ঘারকে পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন যা শিরওয়ানশাহ ফরিবুর্জ অঞ্চলে অভিযানকালে ধ্বংস করেছিলেন। একই বছর তিনি চাচা কাভার্টের ছেলে রুকন আল-দাওলা সুলতান-শাহকে কেরমানের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এক বছর পরে, মালিক-শাহ সাব-তেগিনের অধীনে আরান-এ একটি বাহিনী প্রেরণ করেন, যা শাদ্দাদি শাসক ফাদলুন তৃতীয় দ্বারা শাসিত হচ্ছিল। সাব-তেগিন এই অঞ্চলটি সহজেই জয় করতে পেরেছিল, এইভাবে শাদ্দাদিদের শাসনের অবসান ঘটে। মালিকের রাজত্বকালে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই সময়েই জালালী ক্যালেন্ডারের সংস্কার করা হয় ইসফাহান পর্যবেক্ষণে। ১০৮৯ সালে, মালিক-শাহ স্থানীয় ধর্মযাজকদের সহায়তায় সমরখন্দ দখল করেছিলেন এবং ঐ অঞ্চলের করখানিদ শাসক আহমেদ খান ইবনে খিজরকে বন্দী করেছিলেন। যিনি তার বিবি তেরকিন খাতুনের ভাগ্নে ছিলেন। ১০৭৫ সালে জালালী ক্যালেন্ডার সংস্কার করা হয় এবং মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুক শাসনাধীন অঞ্চল জুড়ে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
১০৯২ সালে বাগদাদ যাওয়ার সময় সিহনার কাছে নিযামুল মুলক আততায়ীর হাতে নিহত হন। হত্যাকারী সুফির ছদ্মবেশে ছিল। নিযামের দেহরক্ষীরা তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে তাই তার সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। একটি মত হল হল সে ইসমাঈলীদের কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিল। এরা প্রায়ই সেলজুক কর্মকর্তা ও শাসকদের উপর এগার শতক থেকে আক্রমণ চালিয়ে আসছিল। অন্য একটি মত হল মালিক শাহ নিজেই এই হত্যাকান্ড ঘটান কারণ তিনি তার অতি প্রভাবশালী উজিরের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। আসল তথ্য হয়ত কখনই উদঘাটন হবে না। মালিক শাহ নিজেও অসুস্থ বোধ করেন এবং কয়েক মাস পর মৃত্যুবরণ করেন। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় মনে হয় যে নিযামুল মুলকের প্রতি অনুগত লোকেরা তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিল।
মালিক শাহ ছিলেন একজন সুন্নি মুসলমান। সুন্নি মুসলমান না বলে তাকে মুসলমান বলাই যুক্তযুক্ত কেননা শিয়ারা আসলে মুসলিম নয়। আর শিয়া মুসলিম বলতে কোনো মুসলিম নেই। শিয়ারা মুলত কাফের সম্প্রদায়। এরা গুপ্তহত্যা, খুন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে উস্তাদ। এরাই খলিফা উসমান রাদিআল্লাহু আনহুর হত্যাকারী। সুলতান মালিক শাহ শিয়াদের অপতৎপরতার উপর বিশেষ নজর রাখতেন। বিশেষত হাসান ইবনে সাব্বাহর মতো গুপ্ত ঘাতকের উপর৷ তারা ইসলামের বড় বড় নেতাদের গুপ্ত হত্যা করতো। মালিক শাহের সময় তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়টি সামরিক অভিযান পরিচালনা হয় তবে সাব্বাহের অনুসারীরা কাজিভিনের নিকটে আলমুত দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয় এবং মালিক শাহের পাঠানো আমির আরসলান-তাশের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এটি পুনরায় দখল করতে পারেনি। সুলতান বাইবার্স হাশাশিনদের বিরুদ্ধে বিষয় অভিযান পরিচালনা করে অনেক সফলতা পান। সুলতান বাইবার্স সম্পর্কে জানতে দেখুন - সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স
মালিক-শাহ ১৯৯৯ সালের ১০ নভেম্বর শিকারের সময় মারা যান। তেরকিন খাতুনের নির্দেশে মালিক-শাহের লাশ ইসফাহানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে তাকে মাদ্রাসায় দাফন করা হয়।
তার মৃত্যুর পর সেলজুক রাজবংশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। উত্তরাধীকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকরা সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথম ক্রুসেডের ফলে সেলজুক সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এই ক্রুসেডের ফলে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য মালিক শাহের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর নির্ভর করেছে।
যুক্তিযুক্তভাবে তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হওয়া সত্ত্বেও, মালিক-শাহ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং বিনয়ী। জনশ্রুতিটি রয়েছে যে, যখন মালিক শাহ কোনো অভিযানে জয়ী হতেন তখন তিনি তার সাম্রাজ্যের শক্তিতে অভিভূত হতেন আর একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নীচের বাক্যগুলো বলতেন,
"হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ, আমি নিজের ক্ষুদার জ্বালা তো সইতে পারবো, কিন্তু দয়া করে আমাকে প্রাচুর্যের হুমকি থেকে রক্ষা করুন "