সুলতান তুঘরিল বেগ : সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান

সুলতান তুঘরিল বেগঃ

তুঘরিল বেগ, পূর্ণ নাম: সুলতান রুকনুদ্দিন আবু তালিব তুঘরুল-বেগ মুহাম্মদ ইবনে মিকাইল ইবনে সেলজুক। তুঘরুল আল্প, তুগ্রিল, তওগ্রিল, তুগরুল বা টোগ্রিল বেগ। (তুর্কি: তুগ্রুল)। তিনি সেলজুক সাম্রাজ্য এর তুর্কি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ১০৩৭ থেকে ১০৬৩ পর্যন্ত সাম্রাজ্যটি শাসন করেন। তুঘরিল গ্রেট ইউরেশিয়ান স্ট্যাফিজের তুর্কি যোদ্ধাদের একত্রিত করেছিলেন। এই উপজাতিরা তাদের পূর্বপুরুষকে একটি একক খলিফা হিসেবে সেলজুক বেগ নামে অভিহিত করেছিল এবং তাদের সাহায্যে পূর্ব ইরানে বিজয় অর্জন করেন। পরে তিনি পারস্য জয় করে ১০৫৫ সালে বুভেয়হী রাজবংশ থেকে আব্বাসীয় খিলাফতকে নিরাপত্তা দেন। তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। ফাতেমিয় খিলাফতের বিরুদ্ধেও তার অভিযানের প্রমান পাওয়া যায়। এ অভিযান তিনি খলিফার সেনাদের সাহায্য নেন৷ তিনি তার খিলাফতের(সাম্রাজ্য) সীমানা সম্প্রসারণ করে দক্ষ কূটনৈতির মাধ্যমে পৃথিবীর অর্ধ-ভূখন্ড তার শাসন বলয়ের মধ্য রাখতে সক্ষম হন।


সেলজুকদের পরিচয়ঃ

দশম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া এবং রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকা হতে একশ্রেণীর যাযাবর লোকের আবির্ভাব হয়। তাদের মধ্যে একটি গোত্র ছিল, যাদের নেতার নাম সেলজুক। তাদের নেতার নাম অনুসারেই তারা সেলজুক নামে পরিচিত হয়। এ গোত্রটি পরবর্তীতে সুন্নি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তারা সামানি সাম্রাজ্য এবং গজনি সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একসময় তারা নিজেরা গজনি সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়। সেলজুকের দুই নাতি চাগরি বেগ ও তুঘরিল বেগ নিজেদের অধীনে পারসিকদের অঞ্চলে খণ্ড সাম্রাজ্য কায়েম করে। চাগরি খোরাসান এলাকা দখলে নেয় এবং তুঘরিল নেয় পশ্চিম ইরান এবং মেসোপটেমীয় এলাকা।


সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান তুঘরিল বেগ
তুঘরিল বেগ (প্রতীকী চিত্র)

তুঘরিল বেগের জন্মঃ

তুঘরিল বেগ ৯৯০ সালে সেলজুকের পুত্র মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুকের ঘরে জন্ম গ্রহণ করে। তুঘরিল ছিলেন মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুক এর পুত্র। বালক বয়সেই তার পিতা মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুক মারা যায়। বাবার মৃত্যুর পরে তুঘ্রিল ও তার ভাই চাঘরি তাদের পিতামহ সেলজুক এর নিকট লালিত-পালিত হন। মুসা ইয়াবাগু এবং আরসলান ইসরাইল নামে সেলজুকের আরও দুজন ছেলে ছিল, যাদের পরে তুঘ্রিল পরবর্তী জীবনে ইরান মালভূমিতে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি ক্ষমতায় আসতে শুরু করেন। 


তুঘরিল বেগ থেকে সুলতান রূপে আবির্ভাবঃ 

১০২০-এর দশকে, তুঘ্রিল এবং তার অন্যান্য আত্মীয়রা বোখারার কারা-খানীদের শাসক আলী তেগিনের আনুগত্য করছিলেন।  ১০২৬ সালে, গজনভি সুলতান মাহমুদ বুখারা থেকে কারা-খানিদের(Kara-Khanid) তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।  এই পরাজয়ের ফলে তুঘ্রিল বেগের চাচা আরসলান ইসরাইল 'সরখস'এর নিকটবর্তী স্থানে পালিয়ে যায়, সেখানে তিনি সামরিক সহায়তার বিনিময়ে মাহমুদের কাছে তার এলাকায় বসতি স্থাপনের অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু গাজনভী সুলতান মাহমুদ আরসলান ইসরা'লকে কারাগারে বন্দী করেন এরপর আরসালান ইসরা'ল কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে শীঘ্রই মারা যান। এদিকে, তুঘ্রিল এবং তার ভাই চাঘরি বেগ কারা-খানিদ শাসকের প্রতি অনুগত ছিল। যদিও ১০২৯ সালে কারা-খানীদের সাথে তাদের কিছু বিরোধ হয় তবুও তারা তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল, এবং তখনও গজনভিদের বিরুদ্ধে কারা-খানিদ শাসকের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১০৩৩ সালে, তারা ডাবুসিয়া যুদ্ধেও উপস্থিত ছিল।


কারা-খানিদ শাসক আলী-তেগিনের মৃত্যুর পরে, সেলজুকরা খোয়াজরমের শাসক হারুনের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। এরপরে সেলজুকরা সেই জায়গায় গিয়েছিল যেখানে তুঘ্রিল বেগের চাচা আরসালান গিয়েছিল এবং মাহমুদের পুত্র, মাসউদ প্রথম এর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে।  তবে মাসউদ যাযাবর তুর্কিদেরকে একটি বিপজ্জনক হুমকি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন এবং সেনাপতি-ইন-চিফ বেগতোগদির অধীনে একটি সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন। তুঘ্রিল বেগের সেলজুক বাহিনী সুলতান মাসুদ প্রথম এর বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, এর ফলে সেলজুকরা ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তা দেওয়ার শর্তে মাসুদের কাছ থেকে নাসা, ফারাভা এবং দিহিস্তানের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে সেলজুকরা তুঘ্রিল বেগের অধিনে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।


১০৩৭ সালে, সেলজাকরা গাজনাভিদের সরখ, অ্যাবিভার্ড এবং মারউ অবরোধ করে।  এরপরে সেলজাকরা ধীরে ধীরে খোরাসানের শহরগুলিকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে অভিযান শুরু করে। তুঘ্রিল বেগ নিশাপুর দখল করে নেন এবং গজনভী সাম্রাজ্য থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। পরবর্তীতে তুঘ্রিল বেগ সুলতান রুপে আত্মাপ্রকাশ করেন। 


তুঘরিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকরা বাগদাদে বুওয়িদদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে সুন্নি ইসলামের অধীনে পুরো মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করতে ভূমিকা রাখে। বাগদাদ জয়ের পর তুঘরিল বেগ বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা কায়্যিমের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য খলিফার দরবারে বিবাহ-প্রস্তাব পাঠান। খলিফা কায়্যিম তাতে সম্মতি দেন এবং তুঘরিল বেগকে রুকুনুদ্দীন উপাধি প্রদান করেন। 


বিয়ের মাত্র ছ’মাস পর তুঘরিল বেগ মৃত্যুবরণ করেন। তখন সাম্রাজ্যের জন্য তার কোনো পুত্রসন্তান উত্তরাধিকারী না থাকায় দায়িত্ব বর্তায় তার ভাতিজা আলপ আরসালানের কাঁধে। আল্প আরসালান ছিলেন তুঘ্রিল বেগের ভাই চাগরি বেগের পুত্র। 


সুলতান তুঘ্রিল বেগের কৃতিত্বঃ

ইসলামী বিশ্বকে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় তুগরিল বেগ সফলতার সাক্ষর রেখেছন। সেলজুকদের নেতা তুঘরিল বেগ, বুভেয়হীদের রাষ্ট্রকে হিজরি ৪৪৭ সালে উচ্ছেদ করে এই অঞ্চল থেকে ফিতনা দূরীভূত করতে সক্ষম হন। যারা মসজিদের দরজায় সাহাবীদেরকে গালী দিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখা টাঙাত তাদেরকে তিনি সমুলে উৎখাত করতে সক্ষম হন। এই ব্যাপারে সব চেয়ে বেশি সীমা লঙ্ঘন কারী রাফেজি আবু আব্দুল্লাহ আল জ্বালাবীককে তিনি হত্যা করেন।


বাগদাদের আব্বাসী খলিফার উপর এই বুভেয়হীদের প্রচণ্ড চাপ ছিল। সেলজুকগণ এই বুভেয়হী রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে তাদেরকে বাগদাদ থেকে অপসারণ করে। সেলজুকের সুলতান তুঘরিল বেগ, আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে গেলে তৎকালীন আব্বাসী খলিফা কাইম বি আমরিল্লাহ তাকে সাদর সম্ভাষণ জানান এবং তাকে সুলতান রুকুনুদ্দীন নামক উপাধীতে ভূষিত করেন। তাকে তার নিজের আসনে বসান এবং অনেক সম্মানে ভূষিত করেন। তার নামে মুদ্রাঙ্কিত করেন এবং বাগদাদ সহ অন্যান্য অঞ্চলের মসজিদে খুতবার সময় তার নাম উল্লেখ করা হয়। এইভাবে সেলজুকদের মান-মর্যাদা আরও অনেক বেড়ে যায়।


সেই সময়ের পর থেকে সেলজুকরা, বূভেয়হীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠা আব্বাসী খলিফাদেরকে সব চেয়ে বড় সাহায্য করেন এবং খলিফা সহজে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হন। সুলতান তুঘরিল বেগ একজন ব্যক্তিত্ত্বশালী , অসাধারণ মেধাবী এবং সাহসী একজন সেনাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দীনদার এবং আবেদ। আর এই কারণেই তিনি তার জাতীর কাছ থেকে অনেক বড় সমর্থন এবং সাহায্য পেয়েছিলেন। তিনি ‘’সুলজুকি তুর্ক’’ নামক শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং ‘’শক্তিশালী রাষ্ট্র’’ এই শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে যান। আব্বাসী খলিফা কাইম বি আমরিল্লাহর সাথে পরবর্তীতে সুলতান তুউরুল সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পায় এবং এই সম্পর্কের জের ধরে খলিফা সুলতান তুঘরিলের বড় ভাই চাগরি বেগ সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করেন। হিজরি ৪৪৮ সালে (১০৫৬ খ্রিঃ) এই বিবাহ সংগঠিত হয়। 


পরবর্তিতে হিজরি ৪৫৪ সালে সুলতান তুঘরিল খলিফার মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু এঁর পর সুলতান তুঘরিল বেগ বেশি দ্বীন হায়াত পাননি। হিজরী ৪৫৫ সালে পবিত্র রমজান মাসের শুক্রবার রাতে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার পরে সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান আল্প আরসালান বেগ সুলতান তুঘরিল বেগের মৃত্যুর পর সেলজুকগন, সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে খোরাসান, ইরান, উত্তর – পূর্ব ইরাক অঞ্চলে পুনঃদখল করে সাম্রাজ্যকে সুসংগঠিত করেন।


সম্পর্কিত পাতাঃ
২. মিকাইল বেগ
أحدث أقدم