যায়েদ ইবনে হারেসা (রাদিঃ) : ইমানদ্বীপ্ত আখ্যান

যায়েদ ইবনে হারেসা (রাদিঃ) : ইমানদ্বীপ্ত আখ্যান 

ছোট্ট বালক যায়েদ মায়ের সাথে নানার বাড়ীতে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে।  তখনকার আরব  মরুভূমিতে পথ চলা বর্তমান সময়ের মতো এতো সহজ ছিল না। সফর হতো কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত। পথে দরকারি সব জিনিসপত্র তাই তারা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।


মরুভূমির পথে এগিয়ে চলছে কাফেলা। এইতো আর একটু পথ, এর পরেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর পালা। কিন্তু পথিমধ্যে মরু ডাকাতদের দল কাফেলা আক্রমণ করে। তারা জায়েদকে উকাজের বাজারে বিক্রি করার জন্য ধরে নিয়ে যায়। ঠিক ওই দিনেই মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর ভাতিজা হাকিম ইবনে হিজাম গোলাম ক্রয় করার জন্য উকাজের বাজরে যান। ঘটনাক্রমে তিনি যায়েদকে দাস হিসেবে কিনে নেন এবং মক্কায় ফিরে আসেন। 


খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর সাথে হাকিমের সাক্ষাত হলে তিনি তার ফুফুকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে, আমার ফুফু আমি উকাজের বাজার থেকে কিছু গোলাম ক্রয় করে এনেছি। এখান থেকে আপনার পছন্দমত একটি বেছে নিন। 


খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যায়েদকেই বাছাই করলেন কারণ যায়েদ ছিল দেখতে অনেক শান্ত আর ভদ্র। পরবর্তীতে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর সাথে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিয়ের সময় যায়েদকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম এর নিকট উপহার স্বরূপ প্রদান করেন। এরপর থেকেই যায়েদ রাদিআল্লাহু আনহু নবীজি (সাঃ)  তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে থাকলেন। রাসুল সাঃ তাকে অত্যন্ত স্নেহের সাথে লালন পালন করছিলেন।


অন্যদিকে যায়েদের পিতা হারেসা যায়েদকে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেলেন না। অতঃপর হজের মৌসুমে জায়েদের গোত্রের কিছু লোক মক্কায় আসলে হজ করতে ঘটনাক্রমে যায়েদের সাথে তাদের দেখা হয়ে যায়।  যায়েদ তাদের চিনতে পারল এবং তারাও তাকে চিনতে পারল। হজ্ব শেষে তারা যায়েদের বাবাকে জানালো আপনার ছেলে মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের তত্ত্বাবধানে আছে। 


খবর শোনা মাত্রই যায়েদের পিতা, তার কলিজার টুকরা সন্তানকে মুক্ত করার জন্য তার ভাই কা'ব কে সাথে নিয়ে মক্কার অভিমুখে রওনা হলেন। একই সাথে মুক্তিপণ হিসেবে প্রচুর ধন-সম্পদ সাথে নিলেন। মক্কায় গিয়ে তারা রাসুল সাঃ এর সাথে দেখা করলেন। হারেসা নবীজিকে বললেন হে আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান আপনারা পবিত্র ভূমির অধিবাসী, আপনারা হাজীদের পানি পান করান, অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করেন। আমরা শুনেছি, আমার সন্তান আপনার কাছেই আছে। আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার বিনিময় যেকোনো পরিমাণের মুক্তিপণ দিতে রাজি আছি। 


রাসুল সাঃ বললেন, কে তোমাদের সন্তান?  তখন হারেসা উত্তর দিল, আপনার গোলাম যায়েদই আমার সন্তান। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন যায়েদকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে একটি বিষয়ে আমরা একমত হই আর সেটা হল, যায়েদ যদি তোমাদের সাথে যেতে রাজি হয় তবে তোমরা তাকে বিনা মুক্তিপণে নিয়ে যাবে আর যদি সে না যেতে চায় তবে তোমরা তাঁকে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন তারা বলল, আপনি আমাদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করেছেন। আমরা আপনার শর্তে রাজি। 

অতঃপর জায়েদকে সবার সম্মুখে ডাকা হল। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম তাকে বললেন তোমার পিতা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তুমি কি তাদের সাথে চলে যেতে চাও, নাকি এখানেই থাকতে চাও? তখন বালক জায়েদ উত্তর দিলো আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই। 


একথা শুনে যাদের পিতা হারেসা যারপরনাই বিস্মিত হলেন এবং আক্ষেপ করে বললেন তুমি কি এই গোলামীর জীবনকে বেছে নিতে চাচ্ছো। যায়েদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম এর ঘরে এতই মমতার সাথে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন যে তিনি তাঁর পিতার সাথে যেতে অস্বীকার করলেন। 


অতঃপর নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম যায়েদকে নিয়ে কাবার প্রান্তরে চললেন এবং ঘোষণা করলেন, হে  কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমরা সাক্ষী থাকো আজ থেকে জায়েদ আমার সন্তান। এ দৃশ্য দেখে জায়েদের বাবা সন্তুষ্টচিত্তে যায়েদকে  রেখে বাড়ি চলে গেলেন। এরপর থেকে লোকেরা জায়েদকে যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলে ডাকা শুরু করলো পরবর্তীতে কুরআনের আয়াত নাজিলের মধ্য দিয়ে পালক পুত্রের প্রথা রহিত করা হলে তাকে আবার যায়েদ ইবনে হারেসা বলে ডাকা হতো। এই ঘটনার পর বালক জায়েদ মক্কায়, খাদিজার ঘরেই লালিত-পালিত হতে থাকলেন। অতঃপর কয়েক বছর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইসাল্লাম যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হন তখন যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন। যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন ওই সকল সৌভাগ্যবান মহান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যারা ইসলামের প্রাথমিক যুগে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। 


যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন আর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও  তাকে অনেক বেশি স্নেহ করতেন। যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাক্ষাতে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম উচ্ছাসিত হয়ে পড়তেন। এমনই একটি ঘটনা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন।


যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিআল্লাহু আনহু
যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিআল্লাহু আনহু


একবার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইসসালাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর গৃহে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দেখা করতে আসলেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু সালাম তখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জায়েদ ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন। হুজুর (সাঃ) যায়েদ  রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কন্ঠ শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং নিজেই দরজার দিকে ছুটে যান। অতঃপর জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আহ!  কি সুন্দর দৃশ্য। কি মনোরম দৃশ্য! যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন এক মহান ব্যক্তির স্নেহাস্পদে পরিণত হয়েছিলেন তিনি সকল মুমিনের কলিজার টুকরা, হৃদয়ের স্পন্দন, যাকে সৃষ্টি করা না হলে দুনিয়ার কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। 


হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন তখন রাসূল সালালাহু আলাইহি সালাম শুধু লুঙ্গি জাতীয় কিছু পড়া ছিল তিনি আরও বলেন আমি কখনোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম কি এত আপ্লুত হতে দেখিনি। সাহাবীদের মাঝেও তখন যায়েদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর ভালোবাসার ব্যাপারটা প্রসিদ্ধ ছিল। আর তাই সবাই জায়েদকে 'হিব্বু রাসূলিল্লাহ' বা রাসুলের প্রিয় পাত্র বলে সম্বোধন করত। 


একবার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেস ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে  বসরার শাসকের নিকট একটি পত্র দিয়ে প্রেরণ করেন। পত্রের মাধ্যমে বসরার শাসককে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। পথে জর্ডানের মুতা নামক অঞ্চলে গাসসানের  শাসক শুরাহবিল ইবনে আমর তাকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে। হারেস ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন ইসলামের প্রথম বার্তাবাহক যাকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হয়। এর প্রেক্ষিতেই সংঘটিত হয় মুতার যুদ্ধ। প্রায় তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনীকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরণ করলেন মুতার যুদ্ধের জন্য। যুদ্ধের সেনাপতি নিযুক্ত হন যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু। নবীজী সাঃ বললেন, যায়েদ আক্রান্ত হলে এরপর জাফর ইবনে আবু তালিব এবং তারপর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রদিয়াল্লাহু সেনাপতি নিযুক্ত হবেন। যদি তিনিও শহীদ হন তখন মুসলমানরা পরামর্শ করে যেন, একজন সেনাপতি নিযুক্ত করে নেয়। 


মুসলিম বাহিনী যখন জর্ডানের পূর্বপাশে মা'আন নামক অঞ্চলে পৌছলেন তখন সংবাদ পেলেন,  রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লক্ষ সেনা নিয়ে শুরাহবীল ইবনে আমর এর সহায়তায় এগিয়ে আসছে। এদিকে মক্কার মুশরিকরাও তাদের তাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছিল। সেখানে প্রায় এক লক্ষ সেনা ছিল। একদিকে তিন হাজারের মুসলিম বাহিনী অন্যদিকে দুই লক্ষের বিশাল কাফের বাহিনী। মুসলিম বাহিনী বীরত্বের সাথে তাদের মোকাবেলা করতে লাগল। যা দেখে রোম সম্রাট বিস্মিত হলেন। অতঃপর,  একে একে শহীদ হলেন তিনজন সেনাপতি, যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু, তার পর জাফর ইবনে আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আবু তালিব রাদিআল্লাহু আনহুম। পরবর্তীতে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তিনি মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে কৌশলে সরে আসলেন এবং সবাই কে বিপদের থেকে রক্ষা করলেন। 


যখন মক্কায় এই সংবাদ পৌঁছলো তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইসসাল্লাম অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। তিনি যায়েদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে তাদের বাড়িতে গেলেন। তখন জায়েদের ছোট্ট মেয়েটি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো? হুজুর (সাঃ)ও কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। তিনিও স্বশব্দে কেঁদে ফেলেন। এটি দেখে হযরত সাদ ইবনে আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনিও কাঁদচ্ছেন? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এটা প্রিয়জনের বেদনায় প্রিয়জনের কান্না। 


আল্লাহ তায়ালা যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উপর সন্তুষ্ট আর তিনিও মহান আল্লাহ তাআলার উপর সন্তুষ্ট।।। রাদিআল্লাহু আনহু।

أحدث أقدم