হাজ্জাজ বিন ইউসুফ : ইতিহাসের এক বর্বর শাসকের গল্প

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার নিষ্ঠুরতার জন্য ইতিহাসে সমালোচিত হয়ে আছেন। উমাইয়া খিলাফতের প্রাদেশিক শাসনকর্তা দের মধ্যে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর চাইতে বেশি খ্যাতি আর কেউ অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু এই ক্ষেতি ন্যায় বিচার ও সহৃদয়তার জন্য নয়। সুক্ষ্ম রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও কঠোর শাসনের মাধ্যমে তার খ্যাতি বিস্তৃত হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কঠোরতা উপমায় পরিণত হয়। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া রাঃ মৃত্যুর পর উমাইয়া খিলাফতের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে গিয়েছিল। হাজ্জাজ-ই শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া তরবারি চালিয়ে, সীমাহীন নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে এই পড়ন্ত  ইমারতের ভিত্তি নতুন করে দাঁড় করিয়েছিলেন।

বনি ওমাইয়ার সবচাইতে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রদিয়াল্লাহু । তার নতুন রাজত্বের কেন্দ্রস্থল ছিল মক্কায়। তখন কার সময়ে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু এর অধিকারের সীমা সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতিপক্ষকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছিলেন তিনি মক্কা অবরোধ করেন কাবার মসজিদে পর্যন্ত মেছানিক দ্বারা প্রস্তুত নিক্ষেপ করেন এবং শেষ পর্যন্ত মক্কায়, ৬৯২ সালে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদিআল্লাহু আনহুকে নিতান্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। তপ্ত দুপুরে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিআল্লাহু আনহুর দেহটিকে ক্রুশবিদ্ধ করে রাখা হয়। ক্রুশে চড়ানোর আগে করা হয় শিরশ্ছেদ।  আর পাশে দাড়িয়ে তখন উল্লাস করছিল আশপাশে জড়ো হওয়া সেনারা। অথচ সত্তর বছর আগে, এই আব্দুল্লাহ যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন বহু উল্লাস হয়েছিল মদিনার পথে প্রান্তরে, অলিতে গলিতে; কারণ তিনি ছিলেন হিজরতের পর মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু। আর আজ তার মৃত্যুই উল্লাসের কারণ। 

ইরাক প্রথম দিক হতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কেন্দ্র ছিল। তখনকার রাজনৈতিক বিপর্যয় কখনো শেষ হতো না। একজনের পর একজন করে শাসক ইরাকে শাসন করতে আসতেন আর নিরুপায় হয়ে ফিরে যেতেন। কিন্তু হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের  নিষ্ঠুর তরবারী ইরাকের সকল বিশৃঙ্খলা চূড়ান্তভাবে দমন করতে সমর্থ হয়।

তার এই কৃতকার্যতার দেখে সমসাময়িক চিন্তাশীল লোকজন আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। কাশেম ইবনে সালাম বলতেন  কুফা বাসীদের অহংকার আর আত্মগরিমা কোথায় গেল? ইহারা আমিরুল হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কে হত্যা করে, হযরত হুসাইন ইবনে আলী রাদিআল্লাহু আনহুর মস্তক কর্তন করে, মোক্তারের ন্যায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের খতম করে ফেলে কিন্তু এই কুৎসিতদর্শন মালাউন (হাজ্জাজ)এর সম্মুখে সবাই চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়ে যায় কেন? কুফায় এক লক্ষ আরব বাস করে কিন্তু এই হতভাগ্য কেবল মাত্র বার (১২) জন অশ্বারোহী সহ আগমন করে সকলকেই গোলামীর শিকলে বেঁধে ফেলেছে। 

কুফার ভূমিতে পা রেখে হাজ্জাজ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আরবি সাহিত্যের এক স্মরণীয় সম্পদ হয়ে রয়েছে। সে কুফাবাসীকে লক্ষ্য করে এমন কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ইরাকের জনসাধারণ চিরতরে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। 

হাজ্জাজের তরবারী ছিল যেমন নির্দয় তার ভাষাও ছিল তেমনি অনলবর্ষী। কুফায় তার প্রথম বক্তৃতার সেই শক্তিশালী ভাষা জ্ঞান এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, দৃষ্টি উপরদিকে উত্তোলন করা হচ্ছে, মস্তক উন্নত হচ্ছে, মস্তিষ্কের ফসল পরিপক্ক হয়ে উঠছে, কর্তনের সময় উপস্থিত হয়েছে আর আমার দৃষ্টি ওই জিনিস দেখতে পাচ্ছে যা দাড়ি ও পাগলীর মধ্যবর্তী স্থানে প্রবাহিত হবে। 

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ 

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর শাসক বলে খ্যাত। তার তরবারির কাছে কেউই নিরাপদ ছিলো না৷ এমনি সে সাহাবীদের হত্যা করতেও কুন্ঠাবোধ করেনি।  বর্ণিত আছে যুদ্ধ ব্যতীত কেবলমাত্র স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার জন মানুষকে হত্যা করেছিলেন। --(ইকদুল-ফারিদ, আল-বায়ান)

হাজ্জাজ অগণিত বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন সায়ীদ ইবনে যুবাইর প্রমুখের প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করছিলেন। পবিত্র মক্কা নগরি অবরোধ করেছিলেন। মদিনায় অগণিত সাহাবীর হাতে সীসার মোহর লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মতো বিখ্যাত সাহাবীকেও তিনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন। বর্তমান যুগের সাম্রাজ্যবাদী নীতির ন্যায় মতো তারও নীতি ছিল। রাষ্ট্রের খাতিরে যে কোনো জুলুম এবং যেকোন প্রকার নিষ্ঠুরতাকে তিনি অন্যায় মনে করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজ্য ন্যায়বিচার ও অনুকম্পা প্রদর্শনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কঠোরতার দ্বারাই রাষ্ট্রের ভীত মজবুত হয়।

সেই যুগের সৎ ও খোদাভীরু ব্যক্তিগণ হাজ্জাজকে খোদার মূর্তিমান আজাব মনে করতেন। হযরত হাসান বসরী বলতেন, হাজ্জাজ আল্লাহ তাআলার মূর্তিমান অভিশাপ। তাই তাকে বাহুবলের সাহায্যে দূর করার চেষ্টা করো না। আল্লাহ তাআলার নিকট বিনীত ভাবে ক্রন্দন করো। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন 

"এবং নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে কঠোর। শাস্তির মধ্যে ফেলে দেই কেননা তারা তাদের প্রভুর নিকট বিনম্র অনুকম্পা প্রদর্শন করে না।"

আর এজন্যই হজ্জাজ বিন ইউসুফের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হযরত হাসান বছরী রহিমাহুল্লাহ, সেজদায় পড়ে শুকরিয়া আদায় করে বলেছিলেন, এ জাতির ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। 

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ : ইতিহাসের এক বর্বর শাসকের গল্প

Previous Post Next Post