স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস : মুসলমানদের কাছেই যাদের সভ্যতার হাতেখড়ি

স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাসঃ হিজরীর প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকের কথা। তখন মুসলমানগন আফ্রিকার উত্তরাংশ জয় করে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছেন। সারাবিশ্বে তখন মুসলমানদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। মুসলিম মুজাহিদদের পদভারে কেঁপে উঠছে দূরদূরান্ত। জালিম স্বৈরশাসকদের জিনদান থেকে মজলুম মানবতাকে উদ্ধারের জন্য দিক দিগন্তে ছুটে চলছে মুসলিম বীর সেনারা। ক্রমেই মুসলমানদের পদানত হচ্ছে শহর-বন্দর গিরি-কন্দর, আসমুদ্র-হিমাচল।


ঠিক এমনই সময় স্পেনের রাজা ছিল রডারিক। সে ছিল গোঁড়া খ্রিষ্টান। তার অত্যাচার ও নিষ্পেষণে হাঁপিয়ে উঠেছিল মজলুম মানবতা। তখনকার স্পেনে মানুষকে মানুষ মনে করা হতো না। নিত্যকার দ্রব্যের মতো মানুষ বেচা-কেনা হতো দাস হিসেবে। রাজা রডারিকের শাসনব্যবস্থা ছিলো সীমাহীন বর্বরোচিত এক অধ্যায়। তবে রডারিক ছিলো নামেমাত্র রাজা। স্পেন তথা গোটা ইউরোপে তখন ক্ষমতার কলকব্জা পরিচালনা করছিল পোপ ও পুরোহিতরা। ধর্মের নামে চলছিল পোপ পুরোহিতদের সীমাহীন শোষণ-অত্যাচার। ধর্মকে ব্যবহার করে দুনিয়া ভোগের এক উন্মত্ত খেলায় মেতেছিল তারা। পুরোহিতদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কারো টু শব্দ টুকু করারও অধিকার ছিল না। জমির মালিকানা কুক্ষিগত করে রেখেছিল সামন্ত প্রভুরা। আর সাধারন মানুষ ছিল ভূমিদাস বা ক্রীতদাস। পেশিশক্তির বলে তাদের উপরে চালানো হতো নির্যাতনের স্টিমরোলার। শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান চর্চার কোন বালাই ছিল না তখন। স্পেন তথা গোটা ইউরোপ তখন নিমজ্জিত ছিল শিক্ষাদীক্ষা হীন অবস্থায়। খ্রিস্টান ঐতিহাসিক অধ্যাপক লেন এর ভাষায়-


"যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা কাঠের কুঠুরিতে বাস করতেন। ময়লা খড়ের উপর বিশ্রাম নিতেন। যখন আমাদের ভাষা ছিল অসংগতিপূর্ণ এবং শিক্ষা কি তা মানুষ জানতোই না। পড়ালেখা শুধু কয়েকজন পাদ্রী সন্ন্যাসীর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল তখন আমরা মুরু সভ্যতার অসামান্য বিকাশ সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। তখন সমস্ত ইউরোপ বর্বরতা, অজ্ঞতা ও বুনো ব্যবহারে ছিল নিমজ্জিত। "


রডারিক স্পেনকে তার করদরাজ্যে পরিণত করে। চরিত্রগত দিক দিয়ে রডারিক যেমন ছিল বর্বর তেমনি আচার-আচরণে ছিল স্বেচ্ছাচারী। তার যেসব কুকীর্তির কথা জানা যায় তন্মধ্যে একটি হলাে, সে তার রাজ্যের সুশ্রী বালক-বালিকা কিশাের-কিশােরীদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতার অজুহাতে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে তাদের সাথে যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করত। কাউন্ট জুলিয়ারের এক অনুদ্ভিন্নযৌবনা কিশােরী কন্যাও রডারিকের তত্ত্বাবধানে থাকত। কিন্তু পাষণ্ড, ওই কিশোরীকেও একসময় যৌনক্রীড়ার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত কে ফলে কিশোরী তার নিগৃহীত হওয়ার কথাসহ রডারিকের সব গােপন কথা কাউন্ট জুলিয়ানকে অবহিত করে। রডারিকের এ পৈশাচিক আচরণের কথা শুনে কাউন্ট জুলিয়ানের মনে রডারিক ও তার রাজত্বের বিরুদ্ধে ঘৃণা ক্ষোভ প্রচণ্ডভাবে দানা বেঁধে ওঠে। উল্লেখ্য কাউন্ট জুলিয়ান ছিলো স্পেনের শাসনাধীন মরোক্কোর উত্তরে অবস্থিত উপকুলবর্তী শহর সিউটার রাজা।


এটা ছিল সে সময়ের ঘটনা যখন মুসা বিন নুসায়েরের নেতৃত্বে আফ্রিকার উত্তরাংশের বেশির ভাগ অঞ্চল মুসলমানদের কর্তৃত্বাধীনে চলে এসেছিল। বিজিত অঞ্চলে মুসলমানদের ন্যায়-নীতি দেখে রডারিকের প্রতি বিক্ষুব্ধ রাজা কাউন্ট জুলিয়ান একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে মুসা বিন নুসায়েরের মজলিসে উপস্থিত হন এবং মুসা বিন নুসায়েরকে স্পেন আক্রমণ করে নিল্পেষিত-নিগৃহীত মানবতাকে রাজা রডারিকের কালাে থাবা থেকে উদ্ধার করার জন্য আবেদন করেন। একই সাথে তিনি সসৈন্যে মুসলমানদেরকে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।


স্পেনে মুসলিম শাসন। স্পেনে মুসলিম শাসন। স্পেনে মুসলিম শাসন।
স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস


স্পেনে মুসলিম শাসন। স্পেনে মুসলিম শাসন। স্পেনে মুসলিম শাসন।
স্পেনে মুসলিম শাসন 


কাউন্ট জুলিয়ানের আহ্বানের প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে মুসা বিন নুসাইর তার অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষ তারিক বিন যিয়াদকে স্পেন অভিযানের জন্য প্রেরণ করেন। তারিক বিন যিয়াদ জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য উপকূলে নোঙর করেন। উল্লেখ্য জিব্রাল্টার প্রণালীর নামকরণ তারিক বিন যিয়াদ এর নাম অনুসারেই হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা তা বিকৃত করে জিব্রালটার রাখে। স্পেনে মুসলিম শাসনের পতন পর্যন্ত এর নাম ছিল "জাবালে তারিক"। খ্রিস্টানরা এটাকে এখন জিব্রাল্টার নামে ডাকে। তারেক বিন যিয়াদ আরো কিছুদূর অগ্রসর হবার পর সিডোনা শহরের অদূরে অবস্থিত গোয়দেলেত নদীর তীরবর্তী স্থানে ৯২ হিজরীর ১৮ ই রমজান মোতাবেক ৭১১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মুসলমানগন খ্রিস্টান বাহিনীর মুখোমুখি হয়। শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। মর্মস্পর্শী তাকবীর ধ্বনিতে কেঁপে উঠে রণপ্রান্তর। রাজা রডারিক সেনাপতি থিউওডমিরের নেতৃত্বে যে সেনা বাহিনী পাঠিয়েছিল তারিক বিন যিয়াদের বাহিনীর কাছে তা বারবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে শক্তি, সাহস আর মনোবল সম্পুর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে। তখন সেনাপতি থিওডামির (Thiodomir) এই মর্মে রডারিকের কাছে পত্র লেখে যে,


"যে জাতির সাথে আমরা যুদ্ধ করছি ঈশ্বরই জানেন তারা কি আকাশ থেকে নেমে এসেছে নাকি জমি ফুঁড়ে এসেছে। এহেন অবস্থায় আপনি যুদ্ধবাজ ও দক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে নিজে না আসলে তাদের থামানো সম্ভব নয়।"


রাজা রডারিক সেনাপতির এ বার্তা শুনে সত্তর হাজার সাহসী ও যুদ্ধবাজ সৈন্যর সমন্বয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী গঠন করে তড়িৎগতিতে তারিক বিন যিয়াদের মােকাবিলার জন্য রওনা হয়ে যান।


অপর দিকে মুসা বিন নুসায়েরও তারিক বিন যিয়াদের সাহায্যার্থে পাঁচ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। ফলে মুসলিম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বার হাজারে উন্নীত হয়। লাক্কা উপত্যকায় যখন উভয় বাহিনী মুখােমুখি অবস্থান গ্রহণ করে তখন তারিক বিন যিয়াদ নিজেদের সৈন্যদেরকে লক্ষ্য করে যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন তা আজও আরবি সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ হয়ে আসছে। যার প্রতিটি শব্দ তারিকের দৃঢ় সংকল্প, ঈমানি চেতনা, অদম্য মনােবল ও সর্বোপরি আত্মােৎসর্গের স্পৃহার প্রমাণ বহন করে। তারিকের সে তেজস্বী ঐতিহাসিক ভাষণের মর্মস্পর্শী শব্দের ঝংকারগুলো যেন মুজাহিদদের স্পৃহার অনলে লবণ ছিটিয়ে দিয়েছিল।


দীর্ঘ লড়াইয়ের পর খ্রিস্টান বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও পর্যুদস্ত হয়ে পিছু টান দেয়। এরপর একের পর এক স্পেনের শহর-বন্দর পদানত করে তারিক বাহিনী সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অপর দিকে সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর ১৮ হাজার সৈন্য নিয়ে স্পেনের অন্য এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে কর্মোনা, সেভিল, ও মেরিদা জয় করেন। এভাবে দুই দিক থেকে দুই বীর বাহাদুর স্পেন দখল করে পিরীনিজ পর্বতমালার পাদদেশে গিয়ে পৌঁছান।


এরপর থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ আট শত বছর পর্যন্ত মুসলমানগন স্পেন শাসন করেন। এই দীর্ঘ আট শত বছরে মুসলমানগন স্পেনকে গড়ে তুলে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে। শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধন-সম্পদ, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে স্পেন পরিণত হয় কিংবদন্তির দেশে। অন্ধকার, বর্বর, অধঃপতিত স্পেন মুসলিম জাতির ছোঁয়ায় রূপে-গুণে, প্রজ্ঞা ও উৎকর্ষে যেন নবজীবন লাভ করে।



এক সময়ে যেখানে ঝুপড়ি ও জীর্ণ কুটির ছিল একমাত্র বাসস্থান সেখানে মুসলমানগন তৈরি করেন জাঁকজমকপূর্ণ বাসভবন দালান ইমারত, রং-বেরংয়ের প্রস্তর ইট আর মার্বেল দিয়ে নির্মাণ করেন ফুটপাত। রাস্তায় রাস্তায় স্থাপন করেন লন্টন । যে ইউরোপীয়রা গোসল করা জানতো না, কাঁচা গোস্ত খেত সেই স্পেনের এক একটি শহরে নির্মিত হয় শত শত হাম্মামখানা। যেখানে শিক্ষার নামমাত্র ছিল না সেই স্পেনে প্রতিষ্ঠা করা হলো শত শত স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কুরআন-হাদিস ও ফিকাহ ছাড়াও তালিম দেয়া হতো গ্রীক, ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষার। এছাড়াও ছিল প্রকৃতি বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, শিল্প, রসায়ন সহ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা।। মোটকথা মুসলমানদের আগমনের ফলে শুধু স্পেনই নয় বরং পুরো ইউরোপের চেহারা বদলে যেতে থাকে। মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির দীক্ষা নিয়ে তমসাচ্ছন্ন ইউরোপ প্রবেশ করে আলোর ভুবনে।


কিন্তু হায়! যে জাতি একসময়ে জগতকে দিয়েছিল সভ্যতার শিক্ষা সে জাতি আজ অসভ্যতার অপবাদে জর্জরিত। যে জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর বিশ্বকে দিয়েছিল শিক্ষার আলো সে জাতি আজ শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর। যে জাতি জগতকে করেছিল উৎকর্ষমন্ডিত সে জাতি আজ অনুন্নত। এমনকি মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো হিম্মতটুকু জেনো আর নেই। এমনকি তারা জানেও না যে একসময় তারাই অন্ধকার ইউরোপকে করেছিল আলোকিত, অসভ্য জগতকে পরিণত করেছিল সভ্যজগতে। মুসলিম যুবক সমাজ আজ ইউরোপের কাছ থেকে সভ্যতার সবক গ্রহণ করছে, তাদেরকেই উন্নয়নের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস চালাচ্ছে।


এর জন্য প্রধানত দায়ী হলো আমাদের আত্মবিস্মৃতি। আমরা ভুলে গেছি আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের গৌরবগাথা। তাই মুসলমানদেরকে আবার জাগাতে হলে ভাঙতে হবে তাদের আত্মবিস্মৃতির এ পুরো দেওয়াল। আর এজন্য সত্য-নিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার বিকল্প নেই।

Previous Post Next Post