মনসুর হাল্লাজঃ আল্লাহর প্রেমে বিপন্ন এক সুফির আখ্যান

বিস্ময় আধারে মনসুর হাল্লাজ

মানসুর আল–হাল্লাজ (ফার্সি: منصور حلاج Mansūr-e Ḥallāj; পুরো নাম আরবি: "أبو عبد الله حسين بن منصور الحلاج" আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মানসুর আল-হাল্লাজ) (৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ – মার্চ ২৬, ৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) (হিজরী ২৪৪ হিজরী – ৩০৯ হিজরী) ছিলেন একজন ইরানী মরমি সুফী, বৈপ্লবিক সাহিত্যিক এবং সুফিবাদ-এর একজন দিকদর্শি। তিনি মুসলিম জগতে খ্যাত প্রধানত তার চরম বিতর্কিত বক্তব্য "আনাল হাক্ক" ("আমিই পরম সত্য") এবং এর ফলশ্রুতিতে লম্বা বিচার-প্রক্রিয়ার পরে আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির এর আদেশে তার মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

মনসুর হাল্লাজ
মনসুর হাল্লাজ আলোচিত-সমালোচিত 

বিষ্ময় আর বিতর্কে ভরা মানসুর হাল্লাজকে নিয়ে মানুষের কৌতুহলের কমতি নেই৷ ইতিহাসের আলোচিত এ সুফিসাধকে নিয়ে রয়েছে নানান তর্ক বিতর্ক। উলামায়ে কেরামের মধ্যেও তাকে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ তাকে বলে দরবেশ আবার কেউ বলে কাফের৷ হাক্বিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) এর একটি বক্তব্যে তাকে দরবেশই বলা হয়েছে।

মনসুর আল-হাল্লাজ এর জন্ম আনুমানিক ৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের ফারস প্রদেশে। উনার পিতা ছিলেন একজন সুতা-প্রস্তুতকারক। হাল্লাজ শব্দের অর্থ সুতা প্রস্তুতকারক। মনসুর হাল্লাজ এর বংশের লোকেরা সুতা প্রস্তুত করতো বলে তাদের নামের পর হাল্লাজ উপাধিটি যুক্ত করা হয়েছে। 

মনসুর হাল্লাজের পিতামহ ছিলেন, যরথুস্থের অনুসারী অর্থাৎ তারা ছিল পারস্যের অগ্নিপূজক। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। সেই সময়ে পারস্যে মুসলমানদের অনেকেই ধর্মাচরণের জন্য সুফি-সাধনার পথ বেছে নিতেন। এই সূত্রে শৈশব থেকেই সুফিদের মজলিশে মনসুর হাল্লাজ আসা-যাওয়া করতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর ভেতরে আল্লাহর সাথে নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি কুরআনের হাফেজ হন।

১৮ বছর বয়সে তিনি তুস্তারে যান এবং সেখানকার সুফি সাহল আল-তুস্তারির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর এই গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার পর তিনি বাগদাদ হয়ে বসরায় যান। বসরাতে তিনি আমর ইবনে ওসমান আল-মক্কির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানেও তিনি গুরু আমরের সাহচর্যে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেন। 

তরুণ আল-হাল্লাজ বিয়ে করেন এবং এরপর মক্কায় হজ্বে যান, সেখানে তিনি এক বছর সময় অতিবাহিত করেন, কেবলার দিকে মুখ করে, রোজা-অবস্থায় এবং সম্পূর্ণ নীরবতার সাথে। এরপর তিনি মক্কা নগরী ত্যাগ করেন, লম্বা এক সফরে সময় ব্যয় করেন আর পথিমধ্যে শিক্ষাদান এবং লেখালেখি করেন।

বাগদাদে বিখ্যাত ওলি জুনায়েদ বাগদাদির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি হেজাজ ভ্রমন করেন। হিজরি ২৭০ এর দিকে তিনি হজ্জের জন্য মক্কা নগরিতে চলে যান। সেখানে তিনি সর্বদা ধ্যান মগ্ন অবস্থায় সময় অতিবাহিত করতেন। এ সময় প্রতিদিন এক ব্যক্তি কয়েকটি রুটি ও এক পাত্র পানি তাঁর সামনে রেখে যেতেন। হাল্লাজ কদাচিৎ রুটির কিছু অংশ খেতেন বা সামান্য পানি পান করতেন। ফলে তাঁর শরীর শুকিয়ে হাড্ডি সর্বস্ব হয়ে যায়। মুনসুর হাল্লাজের 'আনাল হক' মতবাদই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার কারনে তিনি মুসলিম জাহানে এত বেশি বিতর্কিত একজন ব্যক্তিতে পরিনত হন। 

হজ্জের পর মনসুর হাল্লাজ বাগদাদে ফিরে আসেন এবং ২৭০ হিজরিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করেন। এসময় তিনি ভারতবর্ষে সফর করেন। মক্কা থেকে পরবর্তীতে তিনি ভারতবর্ষে সফর করেন এবং সেখানে তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়৷ ভারতবর্ষে তার মুরিদদের মধ্যে অনেকেই উনার ২য় এবং ৩য় হজ্বের সফরে সফরসঙ্গী হন। তার এই সফরকালীন সময় অতিবাহিত করার পরে তিনি বাগদাদের প্রাণকেন্দ্র আব্বাসিদ এ অবস্থান শুরু করেন। 

উনি প্রাথমিক যুগে জুনায়েদ বাগদাদী এবং আমর-আল-মক্কীর শিষ্য ছিলেন, কিন্তু পরে দুজনেই উনাকে পরিত্যাক্ত করেন। সাহল আল-তাশতারিও আল-হাল্লাজের একজন প্রাথমিক যুগের উস্তাদ ছিলেন।

বিতর্কে মোড়ানো মনসূর হাল্লাজ সম্পর্কে কথিত আছে একদিন ধ্যানরত অবস্থায় তিনি এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে দেখতে পান। মনসুর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে। ওই পুরুষ তাঁকে বলেন ‘আনাল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই পরম সত্য’। উল্লেখ্য ’আল-হক’ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নামের একটি। আল্লার এই রূপ এবং বাণী দ্বারা তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করতে থাকেন ‘আনাল হক’। এই থেকে তিনি ‘আনাল হক’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। আর সে কারনেই তিনি মুসলিম জাহানে এত বেশি সমালোচিত হয়েছেন।

মনসুর হাল্লাজের সমসাময়িক বেশিরভাগ আলেম তার এমন আরচণের বিরোধিতা করেছিলেন। ‘আমিই পরম সত্য’ এই অর্থে আল্লাহ বিবেচনা করে, নিজেকে আনাল হক বলাকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিলেন সেকালের বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম। কেউ কেউ তাঁকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু অনেক সুফি মনে করতেন তিনি নিজেকে আল্লাহ দাবি  করার অর্থে আনার হক বলেন নি। সুফিরা জানতেন, মনসুর কোন অর্থে নিজেকে আনাল হক বলছেন। আল্লাহর সাথে তাঁর নৈকট্য এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, তিনি নিজেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না। তাই তিনি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। 

মানসুর হাল্লাজ বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র আল্লাহ-তাআলাই পারেন উনার নিজের একত্বের ঘোষণা দিতে; অপরপক্ষে, মানুষের ইবাদত শুধুমাত্র তার হুকুমের প্রতিফলন, তার আদেশের সামনে মাথা নত করা। "ভালবাসা মানে প্রিয়জনের পাশে দাড়িয়ে থাকা, নিজের আমিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করা আর নিজেকে তার(খোদার) রঙে রাঙিয়ে নেয়া" ((Massignon, পৃ:৭৪)। তিনি আল্লাহর ব্যপারে উল্লেখ করতেন নিজের "প্রেমাস্পদ", "বন্ধু", "তুমি" ইত্যাদির মাধ্যমে, আর অনুভব করতেন যে "তার একমাত্র স্বত্তাই তিনি(আল্লাহ)". "ব্যপারটা এতদুর গড়িয়েছিল যে তিনি অনেক সময় নিজের নামটি পর্যন্ত স্মরণ করতে পারতেন না" ((Mason, পৃ:২৬)।

সিরাতে মনসুর হাল্লাজ নামে একটি গ্রন্থে হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহঃ লিখেছেন, 

"অনেকেই মনসুর হাল্লাজের এমন কিছু কথার কারণে ধোঁকায় নিপতিত হয়েছে, মনসুর যা ভ্রমগ্রস্থ অবস্থায় বলেছিলেন৷ আর তার সেই কথাগুলোই এতটা আলোচিত হয় যে, তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে তাওহিদের যেই ঘোষণা দিয়েছেন মানুষ আর সেইদিকে ভ্রুক্ষেপ করে নাই।"

মনসুর হাল্লাজ সেসময় একটি গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওয়াসিন’ রচনা করে হৈ চৈ ফেলে দেন৷ তার বিরোধিরা আইনের আশ্রয় নেয় এবং তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ'র কাছে বিচার প্রদান করেন। পরবর্তীতে দেশের প্রধান বিচারপতি কাজি আবু উমর মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ আল-মালেকি রহ.-সহ সর্বোচ্চ বিদ্বানমণ্ডলীর মতামত ও বিচারকদের রায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পূর্বে তাকে অনেকবার তার মতবাদ থেকে ফিরে আসতে বললেও সে তা গ্রহণ করেনি। দীর্ঘ ৯ থেকে ১১ বছর কারাগারে থাকার পর তাকে জনসম্মুখে হাত-পা কেঁটে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তার মাথা কেটে ঝুঁলিয়ে দেওয়া হয় এবং লাশ পুঁড়িয়ে ফেলা হয়। 

কথিত আছে, তৎকালীন বহু উলামায়ে কেরাম তাঁর মৃত্যুদণ্ডের কালে এই বলে কেঁদেছিলেন যে, যদি ফেতনার আশংকা না থাকত, তাহলে আমরা মনসুর হাল্লাজের মৃত্যদণ্ডের পক্ষে মত প্রদান করতাম না।


তথ্যসূত্রঃ 
১. মেসোন, পৃঃ নঃ ২৬
২. মেসোন পৃঃ নঃ ৭৪
৩. ফাতেহ সংখ্যা/বিস্ময় বিতর্কের মনসুর হাল্লাজঃ 
৪. The Tawasin of Mansur Hallaj

Post a Comment

Previous Post Next Post