স্পেনে মুসলিম শাসন : ইসলামপূর্ব স্পেনের সামাজিক অবস্থা (২য় পর্ব)

স্পেনে মুসলিম শাসন - ২য় পর্ব

রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় ইসলামি রাষ্ট্রের পরিধি ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু তিনি যে মুজাহিদ বাহিনী তৈরি করে রেখে যান তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার বদৌলতে ইসলামি রাষ্ট্রের সে ভিত্তি গগনচুম্বি অট্টালিকার রূপ নেয়। খােলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রাদিয়ালাহু আনহু খেলাফতকালে (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকে। যদিও হজরত উসমান ও আলী রাদিয়ালাহু আনহুর খেলাফতকালে এর গতি কিছুটা মন্থর ছিল। কিন্তু উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে ইসলামি সাম্রাজ্য প্রবল ও দুর্বার গতিতে বিস্তার লাভ করে। খলিফা ওয়ালিদ বড় মাপের যােদ্ধা না হলেও তিনি মুসা বিন নুসায়ের, তারিক বিন যিয়াদ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ও রণনিপুণ সেনাপতি লাভ করেছিলেন। তাদের শৌর্যবীর্য, রণনিপুণতা ও অক্লান্ত পরিশ্রেমের ফলে এশিয়া, ইউরােপ। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক এলাকা ইসলামি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এ সময় স্পেনও মুসলমানদের পদানত হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেকে উত্তর আফ্রিকা উমাইয়া খেলাফতে অধীনে আসে। ৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী কার্থেজ থেকে বাইযাইনটাইনগ বিতাড়িত হয়। তিউনিসে ইসলামের আগমন ঘটে এবং সেখানে মুসলিমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের অল্প পরেই মুসলমানরা আলজেরিয়া হয়ে মরক্কোতে প্রবেশ করতে শুরু করেন। 

মরক্কোসহ উত্তর আফ্রিকাতে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরেই মুসলমানরা মুসা বিন নুসায়ের এবং অধীনস্থ সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনে অভিযান পরিচালনা করেন। প্রথম হিজরি শতাব্দীর শেষের দিকে তথা খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে মুসলমানদের স্পেন বিজয় আইবেরীয় উপদ্বীপের ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। স্পেন বিজয়ের সেই বীরত্বগাথা, স্পেনে মুসলিমদের উত্থান পতনের ইতিহাস নিয়ে জানতে চোখ রাখুন আমাদের এই সিরিজে। উক্ত সিরিজে আমরা কাজী মুহাম্মদ হানিফের লেখা স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস ও অবদান বইটিকে অনুসরণ করবো। তাহলে চলুন ইতিহাসের পাতায় আমাদের অভিযান শুরু করা যাক.....

স্পেনে মুসলিম শাসন | স্পেনে মুসলমানদের সোনালি ইতিহাস | মুসলিমপুর্ব স্পেনের সামাজিক অবস্থা | স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস
স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস
তৎকালিন স্পেনের সামাজিক অবস্থা

অভিজাতরাই ছিল দেশের ভূমি সম্পত্তির প্রকৃত মালিক। সাধারণ জনগণ ছিল ভূমিদাস। এ ভূমিদাস বা ক্রীতদাসদেরকে নিয়েই গঠিত হয়েছিল স্পেনের নিম্নশ্রেণি। ভূমিদাসরা জমিচাষ করতাে এবং কৃষিশ্রমিক ও সামরিকবাহিনীতে লােক সরবরাহের অনুবাদ, সরকার বলতে ছিল গােত্রপতি শাসন। তাদের মধ্যে নৃশংসতা পুরাে মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। ভৌগােলিক কারণে তারা দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। বরিসস্থিন নদীর পূর্ব তীরের বাসিন্দারা অষ্টোগথ এবং পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা ভিজিগথ নামে পরিচিত ছিলো। এরা এত ধর্মান্ধ ছিল যে, খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কোনাে ধর্মীয় গােষ্ঠী বা মতকে আদৌ সহ্য করত না। এর ফলে হাজার হাজার ইহুদিকে তারা নির্মম নির্যাতনে হয় ধর্মান্তরিত না হয় বিতাড়িত কিংবা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। এরা বহু বিবাহ ও উপপত্নী গ্রহণে বেপরােয়া ছিল। ভিজিগথ রাজতন্ত্র ৫ম শতক হতে শুরু করে মুসলিম সেনাপতি কর্তৃক স্পেন বিজিত হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত স্পেনে অব্যাহত ছিল। তবে এই রাজতন্ত্রের শেষ শৌর্যবীর্যের বীর প্রতীক ছিলেন রাজা ওয়ামবা। তার জীবনাবসানে রাজা হন আরভিজিয়াস। আরভিজিয়াস তার জামাতার অনুকূলে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। জামাতা এযিজা বেশি কিছু দিন রাজ্য শাসন করার পর তার পুত্র উইটিজা তার স্থলাভিষিক্ত হন উইটিজা বেশ ব্যতিক্রমধর্মী শাসক ছিলেন এবং অনেক অনাচার অত্যাচার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার হতে দেশকে মুক্ত করার প্রয়াস চালান। গোঁড়া ধর্মান্ধরা এটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে তাকে অসহায়ভাবে নিহত হতে হয়।

৭০৯ সালে রাজা ইউটিজার পুত্র অচিলা অপাস রাজধানী টলেডােতে এবং জামাতা কাউন্ট জুলিয়ান সিউটার গভর্নর ছিলেন। ৭১০ সালে মুসলিম বাহিনীর হাতে রাজধানী টলেডাের পতন হয় এবং গথ শাসনের অবসান ঘটে। জমিজমার খাজনা ছাড়াও তাদেরকে ব্যক্তিগত কর দিতে হতাে। সামান্য ক্রুটিতে তাদের ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ গাছ। ভূমির সাথে ভূমিদাসদের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা ছিল। ভূমিমালিক ভূমি বিক্রি করলে ভূমিদাসরাও এর সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যেত। তারা কোনাে মৌলিক চাহিদার দাবি করতে পারত না। এমনকি তারা প্রভুর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। যদি পাশাপাশি দুই জমিদারের ভূমিদাস পরস্পর বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হতাে তাহলে তাদের সন্তান-সন্ততিরাও উক্ত মালিকের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হতাে।

ইসলামপূর্ব স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থাঃ

উপরযুক্ত কারণে ততকালিন স্পেনের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত ও হতাশাব্যঞ্জক ছিল। রােমান শাসনামলে স্পেন কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধি অর্জন করলেও ভিজিগথিক শাসনামলে কৃষকদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। দেশের শাসক-শ্রেণি ভূমির সর্বময় মালিক হয়ে যায়। কৃষকরা হয়ে যায় ভূমিদাস। স্পেনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইহুদিদের অনেক অবদান ছিল। কিন্তু তাদের ওপর গোঁড়া গথিক শাসকদের অত্যাচারে তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে স্পেনে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। জনগণের ওপর সীমাতিরিক্ত করের বােঝা চাপানাে হয়। দস্যু-তস্করে দেশ ভরে যায়। স্পেনে তখন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা ছিল না। ভিজিগথরা নিজেদেরকে খ্রিষ্টধর্মের আর্য শাখাভুক্ত বলে দাবি করত। এ সময় হতেই স্পেন গোঁড়া ধর্মমতে বিশ্বাসী ও পরধর্মে অসহিষ্ণু দেশ হয়ে ওঠে। এই অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসীরা অন্য ধর্মের উৎখাত ও উচ্ছেদকে নিজ ধর্মের সেবা বলে বিশ্বাস করত। স্পেনের ইহুদিরা এ সকল গোঁড়া খ্রিষ্টানদের রোষানলে পতিত হয়ে নির্যাতিত হতে থাকে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণঃ

৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে গথিক রাজা সিসেবুত (Sisebut) একটি বিতর্কিত ও গোঁড়া আইন জারি করে ততকালিন স্পেনের সকল ইহুদিকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের নির্দেশ জারি করে। এ সময় প্রায় ৯০,০০০ ইহুদিকে জোরপূর্বক খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। যারা ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার চলতে থাকে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অত্যাচারিত বিক্ষুব্ধ ইহুদিরা ৬৯৪ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় বসবাসকারী তাদের সমগােত্রীয় ও ভ্রাতৃসুলভ বার্বারদের সহযােগিতা নিয়ে গথিকশাসকদের বিরুদ্ধে একটি গণবিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেলে তাদের ওপর আরও কঠোর নির্যাতন নেমে আসে। তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে নানা নির্যাতনের যাতাকলে ইহুদিরা নিষ্পেষিত হতে থাকে। ভিজিগথিকরা তাদের পূর্বসূরি রােমানদের চেয়ে শতগুণে দুর্নীতিপরায়ণ ও অত্যাচারী ছিল। তবে তারা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখাত ও ধর্মযাজকদেরকে যথাযথ মর্যাদার আসন দিয়েছিল। কিন্তু তা ছিল নিছক নিজেদের অপকর্মগুলাে ঢাকার অপপ্রয়াস মাত্র। যেখানে ধর্মযাজকরা জনসাধারণকে রক্ষা করার কথা সেখানে তা না করে তারা নিজেরাই জনসাধারণের পীড়নের মূল কারণ ছিল। ২০০ বছরের বেশি সময় রাজত্ব করে ভিজিগথিকরা স্পেনে শান্তি আনতে পারেনি। এ সময় স্পেনের রাজনৈতিক আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রুটির কারণে প্রদেশগুলাে ছিল প্রায় স্বাধীন। ভিজিগথিক রাজপরিবারে সদস্যদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করছিল। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা উয়াম্বা-র সিংহাসনচ্যুতির পর ভিজিগথিকদের ৩০ বছরের শাসন অতিবাহিত হয়েছিল প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে রাজধানী টলেডাে দখলের প্রতিযােগিতা শুরু হলে দূরবর্তী প্রদেশের শাসকগন বিদ্রোহী হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিডা : পিতৃ ব্যাদনা

এ সময় সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান তাদের রাজপরিবারের প্রথা অনুযায়ী নিজ কন্যা ফ্লোরিডাকে রাজকীয় নিয়ম-কানুন, শিষ্টাচার ও ভদ্রতা শিক্ষাদানের জন্য রডারিকের রাজমহলে প্রেরণ করেন। কিন্তু রডারিক ফ্লোরিডার শ্লীলতাহানি করে। রডারিকের এরূপ আচরণে কাউন্ট জুলিয়ান অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি অপমানের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য আফ্রিকায় অবস্থানরত দেশত্যাগীদের সাথে গােপনে আঁতাত করেন। তিনি রডারিককে ক্ষমতাচ্যুত করার শপথ নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি উত্তর আফ্রিকার কায়রােয়ানে অবস্থানরত উমাইয়া খেলাফতে গভর্নর মুসা বিন নুসায়েরকে স্পেন আক্রমণের আহ্বান জানান। এ জন্য প্রয়ােজনীয় গােপন তথ্য দিয়ে তাকে সহযােগিতাও করেন। স্পেন আক্রমণের প্রেক্ষাপট বিস্তারিত জানতে পড়ুন- স্পেনে মুসলমানদের আগমনের পটভূমি

কাউন্ট জুলিয়ান ও উত্তর আফ্রিকার স্পেনিশ উদ্বাস্তদের অনুরােধের প্রেক্ষিতে মুসা বিন নুসায়ের স্পেনে অভিযান পরিচালনার জন্য উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। খলিফা একটি ক্ষুদ্রসেনাদল প্রেরণে অনুমতি প্রদান করেন।

মুসা বিন নুসায়ের তারিফ কে ৭১০ খ্রিষ্টাব্দর জুলাই মাসে ৪০০ পদাতিক এবং ১০০ অশ্বারােহী বার্বার সৈন্য দিয়ে স্পেনের দক্ষিণ উপকূল ও তদসংলগ্ন এলাকা জরিপ ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন। জরিপ ও পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি অভিযান পরিচালনার অনুকূলে মতামত দেন।

স্পেনে মুসলমানদের অভিযান ও বিজয় পরবর্তী আলোচনা আসছে পরবর্তী পর্বে.............(চলবে ইনশাআল্লাহ)

সম্পর্কিত পাতাঃ
Previous Post Next Post