বিক্রিত মাল ফেরত নেওয়া হয় না : ইসলামের বিধান কি?

বিক্রিত মাল ফেরত নেওয়া হয় না!!!!

বিক্রিত মাল ফেরত নেওয়া হয় না, এমন লেখা সবাই-ই হয়তো দেখে থাকবেন। বিভিন্ন দোকানের ব্যাগে বা তাদের সাইনবোর্ডে এ লেখা হয়তো আপনার চোখে পড়েছে। কিন্তু এইরকম মনোভাব ইসলামী আচরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশ্বনবী সাঃ বলেন 'যে ব্যক্তি তার ক্রেতা ভাইয়ের ক্ষতি পূরণের জন্য স্বীয় বিক্রয় বাতিল করবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার উপর থেকে তার অপরাধের শাস্তি বাতিল করে নিবেন।' 

সকলেই চায় এমন সুযোগ পেতে কিন্তু কেউ দুনিয়ায় সেজন্য একটু মেহনত করতে রাজি হন না। কিন্তু কেমন ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যাবসায়ী নীতি? তা কি আমরা জানি? তারা কি দুনিয়ার লাভকে প্রাধান্য দিতেন? নাকি আখিরাতকে?

হযরত আবু হুরাইরা রাঃ বিশ্বনবীর হাদীস আহরণের জন্য এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, ক্ষুধার তাড়নায় মাটিতে গড়াগড়ি দিতেন তবুও নবীজির দরবার থেকে গরহাজির হননি। পাছে নিজ অনুপস্থিতির কারনে নবীজির কোন হাদীস থেকে বঞ্চিত না হয়ে যাই!

এই সাহাবীই একবার মদীনা বাজারে দোকান খোলে বসলেন তিন মাস ধরে। একদিন দোকান গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা অবাক হয়ে বললেন ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ের লস সহ্য করে টিকে রইলেন, এখন মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করে ব্যবসা বন্ধ করে দিবেন?

তিনি বললেন তোমাদের কাছে প্রচলিত লাভ-লসের উদ্দেশ্যে আমি দোকান খোলি নি। 

: তাহলে কেন ?

:আমি নবীজি সাঃ কে বলতে শুনেছি 

مَنْ أَقَالَ مُسْلِمًا عَثْرَتَهُ ، أَقَالَهُ اللَّهُ عَثْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ "

 (যে ব্যক্তি তার ক্রেতা ভাইয়ের ক্ষতি পূরণের জন্য স্বীয় বিক্রয় রহিত করবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার উপর থেকে তার অপরাধের শাস্তি রহিত করে দিবেন।)

ব্যবসা ছাড়া বিক্রয় রহিত করার কোন উপায় ছিল না। এমনকি তিন মাসের মধ্যে কেউ বিক্রয় রহিত করার জন্য আসেও নি। আজ সকালে একজন এসেছেন। মাল ফেরত রেখেছি। আমার মাকসাদ পূরণ হয়ে গেছে। তাই দোকান গুটাচ্ছি। এমনই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনচরিত ।

সুতরাং ব্যাসসায়ীদের কে পরকালের বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে ক্রয় বিক্রয়ে আল্লাহ নির্দশ মেনে চলা উচিত। তাই চলুন জেনে নেই ক্রয়বিক্রয়ের সাধারণ কিছু মাসায়েল। 

ক্রয়-বিক্রয়ের সাধারণ মাসায়েলঃ

★ অবৈধ বস্তু ক্ৰয় করা বা কোন ভাবে অবৈধ বস্তুর মালিক হয়ে গেলে এমন লােকের নিকট তা বিক্রয় করা যার জন্য তা অবৈধ, এটা জায়েয নয়।

★ যে সব দ্রব্য বিক্রি করা হবে তা সামনে থাকতে হবে অথবা তার নমূনা (sample) সামনে থাকতে হবে। অদেখা দ্রব্য দেখার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার শর্তে ক্রয় করলেও তার অনুমতি রয়েছে।

★ বিক্রিত দ্রব্যের সমস্ত অবস্থা (দোষ-ক্রুটি থাকলে তা সহ) ক্রেতাকে খুলে বলতে হবে, অন্যথায় বিক্রয় শুদ্ধ হবে না এবং ক্রেতার তা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে। দ্রব্যের দোষ না বলে ধােকা দিয়ে বিক্রি করা হারাম।

★ বিক্রেতা প্রব্যের যে গুণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছিল পরে তার বিপরীত প্রমাণিত হল, যেমন বলেছিল রং পাকা বা অমুক কোম্পানীর, অথচ তা মিথ্যা প্রমাণিত হল, এ ক্ষেত্রে ক্রেতা সেটা ফেরত দেয়ার অধিকার রাখে।

★ দাম স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে হবে। কেউ তা অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ রাখলে বিক্রয় শুদ্ধ হবে না। ক্রয়ের সময় ক্রেতা যদি বলে দু তিন দিনের মধ্যে (তিন দিনের বেশী নয়) দ্রব্যটি গ্রহণ বা বর্জনের কথা জানাব অথবা ঘরে দেখিয়ে পরে বলব, তাহলে উক্ত মেয়াদের মধ্যে ক্রেতার তা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে যদি ক্রেতা দ্রব্যটি ব্যবহার করে না থাকে কিংবা যে সব দ্রব্য ব্যবহার করা ব্যতীত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না, সেগুলাে ব্যবহারের ফলে দ্রব্যটির মাঝে কোন দোষ- ক্রুটি সৃষ্টি না হয়ে থাকে।

★ বিক্রেতা কোন দ্রব্যের বিশেষ গুণাগুণ বর্ণনা করল, কিন্তু অন্ধকারের কারণে ক্রেতা ভাল করে তা দেখে নিতে পারল না। কিংবা কেবল বিক্রেতার বর্ণনার ভিত্তিতে সে ক্রয় করল, কিন্তু পরে নেয়ার পরে পরীক্ষা করে বিক্রেতার বর্ণনা মত পেল না তাহলে ক্রেতার সেটা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে। নমূনা (sample) দেখে অর্ডার দেয়ার পর নমূনা মত না পেলেও তা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে। অবশ্য দ্রব্যটি ব্যবহার করলে বা অন্যের কাছে বিক্রি করলে পরে আর তা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকে না।

★ কোন দ্রব্য না দেখে ক্রয় করে থাকলে দেখার পর তা রাখা বা না রাখার অধিকার থাকবে।
ক্রয়-বিক্রয়ের ইসলামি নীতি
ক্রয় বিক্রয়ের মাসায়েল
★ যে সব বস্তুর নমূনা দেখে সে সম্পর্কে অনুমান করা যায় না, সেরূপ দ্রব্যের নমূনা দেখে অর্ডার দিলে দ্রব্যটি পাওয়ার পর তা ক্রয় করা না করার অধিকার থাকবে। আর যে দ্রব্যের নমূনা দেখে সে সম্পর্কে অনুমান করা যায় সে ক্ষেত্রে নমূনার অনুরূপ না পেলে উপরোেক্ত অধিকার থাকবে, কিনতু নমূনার অনুরূপ পেলে সে অধিকার থাকবে না।

★ বিক্রেতা যদি দ্রব্যের সে পরিমাণ দাম নিয়ে থাকে, যা কোন স্বচছ নির্দোষ দ্রব্যের বিনিময়ে নেয়া হয়ে থাকে, আর পরে তাতে কোন দোষ প্রকাশ পায় তাহলে ক্রেতার তা ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে। যদি ক্রেতা দোষ-ক্রুটি সত্ত্বেও রাখতে চায় তাহলে তার দাম কম দেয়ার অধিকার থাকবে না। অবশ্য বিক্রেতা স্বেচ্ছায় কিছু কম নিলে তা তার ইচ্ছা। তবে দোকানদার পণ্যের দোষ-ক্রুটি বলা সত্ত্বেও কেউ সে দ্রব্য ক্রয় করলে উক্ত দোষ-ক্রটির কারণে তার ফেরত দেয়ার অধিকার থাকবে না।

★ ক্রেতার হাতে এসে কোন ক্রুটি হলে সে দ্রব্য ফেরত দেয়ার অধিকার নষ্ট হয়ে যায়।

★ ক্রুটি প্রকাশ পাওয়ার পর কিছু (ভালটা) রেখে বাকীটা (খারাপগুলাে) ফেরত দেয়ার অধিকার নেই। রাখলে পূরাটা রাখতে হবে কিংবা পূরাটা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য বিক্রেতা সম্মত হলে সব রকমই করা যেতে পারে।

★ যে সব দ্রব্য ভাঙ্গার পর (যেমন ডিম) বা কাটার পর (যেমন তরমুজ) তার ভাল মন্দ বােঝা যায়, সে সব দ্রব্য ভাঙ্গা বা কাটার পর যদি সম্পূর্ণ ফেলে দেয়ার মত অবস্থা দেখা যায়, তাহলে পুরা দাম ফেরত নেয়ার অধিকার থাকবে। যদি অন্য কোন কাজে ব্যবহার করার উপযােগী থাকে (যেমন তরমুজ বা কোন তরকারী জন্তুকে খাওয়ানাের যােগ্য থাকে) তাহলে সেগুলাে ফেরত না দিলে কিছু দাম কমানাের অধিকার থাকে।

★ ক্রয় বিক্রয়ের সময় প্রথমে দাম পরিশােধ এবং পরে পণ্য হস্তান্তর হবে। ক্রেতা এরূপ দাবী করতে পারবে না যে, প্রথমে পণ্য দিন পরে দাম নিন। অবশ্য বিক্রেতা চাইলে প্রথমে পণ্য দিতে ও পরে দাম নিতে পারে। 

★ বিক্রেতা কোন দ্রব্য বিক্রি করলে ক্রেতাকে তা এমনভাবে হস্তান্তর করতে হবে যাতে দ্রব্যটি তার আয়ত্তে নিতে কোন প্রকার বেগ পেতে না হয়।

★ বিক্রেতা যদি স্বেচ্ছায় কোন দ্রব্য অধিক পরিমাণে দিয়ে থাকে অথবা ক্রেতা মূল্য কিছু বেশী দিয়ে থাকে তাহলে কারবার চূড়ান্ত হওয়ার পর কাউকে তা ফেরত দেয়ার জন্য বাধ্য করা যাবে না।

★ দাম পরিশােধ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার ক্রেতাকে বহন করতে হবে, যেমন মানিঅর্ডার খরচ (এমনিভাবে পে অর্ডার ও পােস্টাল অর্ডার খরচ) ইত্যাদি।

★ এভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের লেখা পড়া সংক্রান্ত খরচ যেমন জমির দলিল রেজিষ্ট্রি ব্যয় ইত্যাদি ক্রেতাকে বহন করতে হবে।

★ ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দিতে যে সব খরচ হয়ে থাকে সে সব খরচ বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। যেমন মাপ বা ওজন করার ব্যয়, সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র না থাকলে সেগুলাে সংগ্রহের ব্যয় ইত্যাদি।

★ ক্রেতার নিকট মালামাল পৌছানাের পরিবহন ব্যয়, ভিপি খরচ ইত্যাদি ক্রেতাকে বহন করতে হবে, অবশ্য বিক্রেতা স্বেচ্ছায় বহন করলে তা হবে তার বদান্যতা। কিন্তু বিক্রেতাকেই তা বহন করতে হবে- এরূপ শর্ত আরােপ করলে বাণিজ্য ফাসেদ হয়ে যাবে।

★ ভিপি যােগে মাল পাঠালে তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার দায়-দায়িত্ব বিক্রেতাকেই বহন করতে হবে।

★ কাউকে কোন মাল তৈরী করার অর্ডার দিলে তার পূর্ণ বিবরণ, দাম দন্তুর, সরবরাহের স্থান, সরবরাহের দিন তারিখ, দাম পরিশােধের সময় ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট হওয়া জরূরী।

★ যে কারবার ফাসেদ হয়ে যায় তা ভেঙ্গে দেয়া উচিত। অথবা অন্ততঃ বিক্রেতা দাম ও ক্রেতা পণ্য ব্যবহার থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবে আর তা কোন দরিদ্র অভাবীকে দিয়ে দিবে।

★ শরীআতে যে সব ক্রয়-বিক্রয় জায়েয নয় সেরূপ কোন ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হলেও তা মলিককে ফেরত দেয়া জরূরী- কোনভাবে তাতে হস্থক্ষেপ করা বা নিজের কাজে ব্যবহার করা জায়েয নয়।

★ ফল আসার পূর্বে বা পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে আম কাঁঠাল প্রভৃতির বাগান বিক্রি করার যে প্রচলন রয়েছে তা জায়েয নয়।

★ যে ব্যক্তি খালেছ হারাম উপায়ে কোন মাল উপার্জন করেছে তার থেকে সেটা ক্রয় করা জায়েয নয়। 

(বেহেশতী জেওর ও ইসলামী ফেকাহঃ ৩য় প্রভৃতি থেকে গৃহীত :)

Previous Post Next Post