ইমাম আবু হানিফা : কষ্টে মোড়ানো জীবন

ইমাম আবু হানিফা : কষ্টে মোড়ানো জীবন

খলিফা আবু জাফর মানসুরের সময় সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামি ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আজম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান জ্ঞানতাপস। সারাজীবন সন্তর্পণে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। শাসকের চাটুকারিতা করা থেকে। সবসময় ছিলেন রাজদরবার থেকে দূরে। বার বার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন লােভনীয় পদের প্রস্তাব। এমনকি এর জন্য নির্যাতনের মুখােমুখি হয়েছেন তিনি।

তবু নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি। উমাইয়াদের শাসনামলে ইরাকের গভর্নর ইয়াজিদ বিন হুবাইরা ইমাম সাহেবকে প্রধান কাজির পদ নিতে অনুরােধ করেছিলেন। ইমাম আবু হানিফা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত পদ গ্রহণে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা শাসকের দরজা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, এই পদ গ্রহণ করলে তিনি নিজেও গভর্নরের জুলুমের সহযােগী হয়ে যাবেন। তখন ইয়াজিদ বিন হুবাইরা হুমকি দিলেন, আপনি আমার আদেশ না মানলে আমি আপনাকে চাবুক-পেটা করব। ইমাম আবু হানিফা দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, তােমার অধীনে মসজিদের দরজা গােনার কাজ দিলেও আমি তা করব না। ইয়াজিদ বিন হুবাইরার আদেশে ইমাম আবু হানিফাকে ১০০ বা ১১০টি দোররা মারা হয়। প্রতিদিন ১০টি করে দোররা মারা হতো। ইমাম আবু হানিফা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেই শাস্তির মোকাবেলা করতেন। 

আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহকে যে ব্যক্তি বেত্রাঘাত করতেন তিনি একবার নিরুপায় হয়ে ইয়াযিদের নিকট যায় এবং আক্ষেপ করে বলে, এই বিশাল রাজ্যে এমন একজন মানুষও কি নেই, যে এই লােকটার প্রতি সদয় হবে।

বেত্রাঘাতকারীর এই অনুযােগ ইয়াযিদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। অগত্যা সে বলে, 'তাকে মুক্ত করে দাও। 

জালিমের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ইমাম আবু হানিফা সােজা মক্কায় চলে যান। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন।
ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ কষ্টে মোড়ানো জীবন
ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহঃ কষ্টে মোড়ানো জীবন 
উমাইয়াদের পতনের পর এলাে আব্বাসিরা। এবার আবু জাফর মানসুর ইমাম আবু হানিফাকে কাজির পদ নিতে অনুরােধ করলেন। ইমাম আবু হানিফা এবারও প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। ইমাম বললেন, আমি এই পদের উপযুক্ত নই। আবু জাফর মানসুর বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। ইমাম বললেন, আপনার কথামতাে আমি একজন মিথ্যাবাদী। আর একজন মিথ্যাবাদী কী করে কাজির পদে আসীন হতে পারে! খলিফার আদেশে ইমামকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানা হয়। সেখানে তার উপর নির্যাতন করা হয়। এ সময় ইমামের বয়স ছিল ৭० এর কাছাকাছি। কিন্তু তবু তিনি নিজের অবস্থানে অবিচল ছিলেন। খলিফা ভয় পাচ্ছিলেন ইমাম যদি কারাগারে মারা যান তা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তাই তিনি ইমামকে গৃহবন্দি করে রাখলেন। ইমাম কারাে সাথে কথা বলতে পারতেন না। সালাতের জন্য মসজিদে যেতে পারতেন না। ফতওয়া দেওয়ার অনুমতি ছিল না। তবু ইমাম নিজের অবস্থানে অটল ছিলেন। এই অবস্থায় ১৫০ হিজরিতে (৭৬৮ খ্রিষ্টব্দ) তিনি ইনতেকাল করেন। অভিযােগ আছে, আবু জাফর মানসুর তার খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে।

তিনি বলেছিলেন, আমাকে এমন মাটিতে কবর দিবে না, যা শাসকরা তলােয়ারের জোরে কারাে কাছ থেকে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে। 

আবু হানিফা একাই আবু জাফরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। সে সময়কার অন্যান্য অনেক আলেমই খলিফার অনুগত ছিলেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ ইমামকে খারেজিও বলেছিলেন। আমরা ইমামের অবস্থা কল্পনা করতে পারি। তার ছাত্ররা ব্যতীত কেউই তার পাশে ছিল না। তার ছাত্রদের নিশ্চয় তখন 'উঠতি তরুণ' বা 'জজবাতি' বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিলা করা হতাে। একদিকে ছিল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতা গ্রহণকারী আলেমসমাজ। খলিফা চাচ্ছিলেন তারা মানুষের কাছে সমাদৃত হােক। কারণ, তারা খলিফার পক্ষে জনমত গড়ে দিবে। এই আলেমরা আবু হানিফাকে কটাক্ষ করেছিল। ইমামের অনুসারীরা ছিল অসহায়। রাষ্ট্র তাদের পাশে ছিল না। তাদের ইলমের স্বীকৃতি দিচ্ছিল না। পৃথিবীর সব যুগের জালেমদের চিত্র এমনই। 

তারা নিজেদের পক্ষে একদল আলেম গড়ে নেয়। এই আলেমদের তারা মানুষের সামনে সমাদৃত করে গড়ে তােলে। তারপর হকপন্থিদের বিরুদ্ধে এই দুনিয়ালোভী আলেমদের লেলিয়ে দেয়। তখন এই দুনিয়ালোভী আলেমরা হকপন্থিদের বিরুদ্ধে তাদের জবান ও কলম উন্মুক্ত করে দেয়। তাদেরকে 'সন্ত্রাসী উগ্রবাদী বলে অপবাদ দেয়। তখন হকপন্থিদের করণীয় হলাে, ইমাম আবু হানিফার মতাে সত্যের উপর অটল অবিচল থাকা। দরবারি আলেমরা হকপন্থিদের নানা কথা বলবে। তাদেরকে ভয়। দেখিয়ে বলবে, তােমরা বড় জামাআতের সাথে নেই। তােমরা জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছ। তখন হকপস্থিদের সাহস যােগাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেই উক্তি, যেখানে তিনি বলেছিলেন, যা হক অনুসরণ করে, তা-ই জামাত, যদি তুমি একাও হও।" যতক্ষণ আপনি হকের অনুসরণ করছেন ততক্ষণ আপনি নিজেই জামাআত, যদি আপনি একাও হন।

তথ্যসূত্রঃ
১. আব্বাসী খিলাফাহ/ইমরান রাইহান/আবু জাফর মনসূর/পূঃ ৫৯-৬১
২. ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ / জীবন ও কর্ম /কষ্টে মোড়ানো জীবন/ ১৫০

Post a Comment

أحدث أقدم