রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ : রোজার মাসায়েল (২য় পর্ব)

সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে ইচ্ছাকৃতভাবে পান, আহার ও যৌন তৃপ্তি থেকে বিরত থাকাকে রােযা বলা হয়। প্রত্যেক আকেল (বােধ সম্পন্ন), বালেগ (বয়সপ্রাপ্ত) ও সুস্থ্য নর-নারীর উপর রমযানের রােযা রাখা ফরয। ছেলে মেয়ে দশ বৎসরের হয়ে গেলে তাদের দ্বারা (শাস্তি দিয়ে হলেও) রােযা রাখানাে কর্তব্য। এর পূর্বেও শক্তি হলে রােযা রাখার অভ্যাস করানাে উচিত।  রোজা পালন উপলেক্ষ আল্লাহ তাআলা বলেন, 

"হে মুমিন সকল! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা-১৮৩)"

রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ। রোজা মাকরূহ হওয়ার কারন। রোজার কাফফারা
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ (কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব)

নিম্নোক্ত কাজগুলো করলে রোজা ভেঙে যায় এবং রোজা পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়াটাও ওয়াজিব হয়ে যায় এমনকি এর জন্য কাফফারাও দিতে হয়। 

১। রােযার নিয়ত (রাতে) করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে।

২। রােযার নিয়ত করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী সম্ভোগ করলে। স্ত্রীর উপরও কাযা কাফ্ফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। স্ত্রী যােনির মধ্যে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ প্রবেশ করালেই কাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়ে যাবে, চাই বীর্যপাত হােক বা না হােক।

৩। রােযার নিয়ত করার পর (পাপ হওয়া সত্ত্বেও) যদি পুরুষ তার পুরুষাঙ্গ স্ত্রীর পায়খানার রাস্তায় প্রবেশ করায় এবং অগ্রভাগ ভিতরে প্রবেশ করে (চাই বীর্যপাত হােক বা না হােক) তাহলেও পুরুষ স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা এবং কাফ্ফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে।

৪। রােযা অবস্থায় কোন বৈধ কাজ করল যেমন স্ত্রীকে চুম্বন দিল কিংবা মাথায় তেল দিল তা সত্ত্বেও সে মনে করল যে, রােযা নষ্ট হয়ে গিয়েছে; আর তার পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ইত্যাদি করল, তাহলেও কাযা কাফ্ফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে।

রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ (কাযা ওয়াজিব)

নিম্নোক্ত কাজগুলো করলে রোজা ভেঙে যায় এবং রোজা পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়াটাও ওয়াজিব হয়ে যায় কিন্তু এজন্য কাফফারা আদায় করতে হবে না৷ অর্থাৎ একটি রোজার পরিবর্তে শুধু একটি রোজা রাখলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।

১। কানে বা নাকে ঔষধ দিলে ।

২। ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে বা অল্প বমি আসার পর তা গিলে ফেললে।

৩। কুলি করার সময় অনিচ্ছাবশতঃ কণ্ঠনালীতে পানি চলে গেলে।

৪। স্ত্রী বা কোন নারীকে শুধু স্পর্শ প্রভৃতি করার কারণেই বীর্যপাত হয়ে গেলে।

৫। এমন কোন জিনিস খেলে যা সাধারণতঃ খাওয়া হয় না। যেমন কাঠ, লােহা, কাগজ, পাথর, মাটি, কয়লা ইত্যাদি।

৬। বিড়ি, সিগারেট বা হুক্কা সেবন করলে।

৭। আগরবাতি প্রভৃতির ধোঁয়া ইচ্ছাকৃতভাবে নাকে বা হলকে পৌছালে।

৮। ভুলে পানাহার করার পর রােযা ভেঙ্গে গছে মনে করে আবার ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কিছু পানাহার করলে।

৯। রাত আছে মনে করে সুবৃহে সাদেকের পরে সেহরী খেলে।

১০। ইফতারীর সময় হয়নি, দিন রয়ে গেছে অথচ সময় হয়ে গেছে -এই মনে করে ইফতারী করলে।

১১। দুপুরের পরে রােযার নিয়ত করলে।

১২। দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে তা যদি থুথুর চেয়ে পরিমাণে বেশী হয় এবং কণ্ঠনালীর নীচে চলে যায়।

১৩। কেউ জোর পূর্বক রােযাদারের মুখে কান কিছু দিলে এবং তা কণ্ঠনালীতে পৌছে গেলে।

১৪। দাঁতে কোন খাদ্য-টুকরা আঁটকে ছিল এবং সুবৃহে সাদেকের পর তা যদি পেটে চলে যায় তবে সে টুকরা ছােলা বুটের চেয়ে ছােট হলে রােযা ভেঙ্গে যায় না, তবে এরূপ করা মাকরূহ। কিন্তু মুখ থেকে বের করার পর গিলে ফেললে তা যতই ছােট হােক না কেন রােযা কাযা করতে হবে।

১৫। হস্ত মৈথুন করলে যদি বীর্যপাত হয়।

১৬। পেশাবের রাস্তায় বা স্ত্রীর যােনিতে কোন ঔষধ প্রবেশ করালে।

১৭। পানি বা তেল দ্বারা ভিজা আঙ্গুল যােনিতে বা পায়খানার রাস্তায় প্রবেশ করালে।

১৮। শুকনাে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে পুরোেটা বা কিছুটা বের করে আবার প্রবেশ করালে। আর যদি শুকনাে আঙ্গুল একবার প্রবেশ করিয়ে একবারেই পুরােটা বের করে নেয়-আবার প্রবেশ না করায়, তাহলে রােযার অসুবিধা হয় না।

১৯। মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে গেলে এবং এ অবস্থায় সুবহে সাদেক হয়ে গেলে।

২০। নস্যি গ্রহণ করলে বা কানে তেল ঢাললে।

২১। কেউ রােযার নিয়তই যদি না করে তাহলেও শুধু কা্যা ওয়াজিব হয়।

২২। স্ত্রী বেহুশ থাকা অবস্থায় কিংবা বে-খবর ঘুমন্ত অবস্থায় তার সাথে সহবাস করা হলে ঐ স্ত্রীর উপর শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

২৩। রমযান ব্যতীত অন্য নফল রােযা ভঙ্গ হলে শুধু কাযা ওয়াজিব হয়।

২৪। এক দেশে রােযা শুরু করার পর অন্য দেশে চলে গেলে সেখানে যদি নিজের দেশের তুলনায় আগে ঈদ হয়ে যায় তাহলে নিজের দেশের হিসেবে যে কয়টা রােযা বাদ গিয়েছে তার কাযা করতে হবে। আর যদি সেখানে গিয়ে রােযা এক দুটো বেড়ে যায় তাহলে তা রাখতে হবে।

যে সব কারণে রােযা ভাঙ্গে না (তবে মাকরূহ হয়)

১। বিনা প্রয়ােজনে কোন জিনিস চিবানাে।

২। তরকারী ইত্যাদির লবণ চেখে ফেলা দেয়া। তবে কোন চাকরের মুনিব বা কোন নারীর স্বামী বদ মেজাজী হলে জিহবার অগ্রভাগ দিয়ে লবণ চেখে তা ফেলে দিলে এতটুকুর অবকাশ আছে।

৩। কোন ধরনের মাজন, কয়লা, গুল বা টুথপেষ্ট ব্যবহার করা মাকরূহ। আর এর কোন কিছু সামান্য পরিমাণও গলার মধ্যে চলে গেলে রােযা ভঙ্গ হয়ে 

যাবে।

৪। গােসল ফরয-এ অবস্থায় সারা দিন অতিবাহিত করা।

৫। কোন রােগীর জন্য নিজের রক্ত দেয়া। 

৬। গীবত করা, চোগলখুরী করা, অনর্থক কথাবার্তা বলা, মিথ্যা বলা।

৭। ঝগড়া ফ্যাসাদ করা, গালি-গালাজ করা।

৮। ক্ষুধা বা পিপাসার কারণে অস্থিরতা প্রকাশ করা।

৯। মুখে অধিক পরিমাণ থুথু একত্র করে গিলে ফেলা।

১০। দাঁতে ছােলা বুটের চেয়ে ছােট কান বস্তু আটকে থাকলে তা বের করে মুখের ভিতর থাকা অবস্থায় গিলে ফেলা।

১১। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না-এরূপ মনে হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে চুম্বন করা ও আলিঙ্গন করা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের আস্থা থাকলে ক্ষতি নেই।

১২। নিজের মুখ দিয়ে চিবিয়ে কোান বস্তু শিশুর মুখে দেয়া। তবে অনন্যোেপায় অবস্থায় এরূপ করলে অসুবিধা নেই।

১৩। পায়খানার রাস্তা পানি দ্বারা এত বেশী ধৌত করা যে, ভিতরে পানি পৌছে যাওয়ার সন্দেহ হয়-এরূপ করা মাকরহ। আর প্রকৃত পক্ষে পানি পৌছে গেলে রােযা ভঙ্গ হয়ে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। এ জন্য রােযা অবস্থায় পানি দ্বারা ধৌত করার পর কোন কাপড় দ্বারা বা হাত দ্বারা পানি পরিষ্কার করে ফেলা নিয়ম

১৪। ঠোটে লিপিষ্টিক লাগালে যদি মুখের ভিতর চলে যাওয়ার আশংকা হয় তাহলে তা মাকরূহ। 

যে সব কারণে রােযা ভাঙ্গে না (মাকরূহও হয় না)

১। মেসওয়াক করা। যে কোন সময় হােক, কাঁচা হােক বা শুষ্ক।

২। শরীর বা মাথা বা দাড়ি গোঁপে তেল লাগানাে।

৩। চোখে সুরমা লাগানাে বা কোন ঔষধ দেয়া। 

৪। খুশবু লাগানাে বা তার ঘ্রাণ নেয়া।

৫। ভুলে কিছু পান করা বা আহার করা বা স্ত্রী সঙ্ভোগ করা।

৬। গরম বা পিপাসার কারণে গােসল করা বা বারবার কুলি করা।

৭। অনিচ্ছা বশতঃ গলার মধ্যে ধোঁয়া, ধুলাবালি বা মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করা।

৮। কানে পানি দেয়া বা অনিচ্ছাবশতঃ চলে যাওয়ার কারণে রােযা ভঙ্গ হয় না, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দিলে সতর্কতা হল সে রােযা কাযা করে নেয়া।

৯। অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হওয়া। ইচ্ছাকৃতভাবে অল্প বমি করলে মাকরূহ হয় না, তবে এরূপ করা ঠিক নয়।

১০। স্বপ্ন দোষ হওয়া।

১১। মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা।

১২। যে কোন ধরনের ইনজেকশন বা টীকা লাগানাে। (G2) তবে রােযার কষ্ট যেন বােধ না হয়-এ উদ্দেশ্যে শক্তির ইনজেকশন বা স্যালাইন লাগানাে মাকরূহ। 

১৩। রােযা অবস্থায় দাঁত উঠালে এবং রক্ত পেটে না গেলে।

১৪। পাইরিয়া রােগের কারণে যে সামান্য রক্ত সব সময় বের হতে থাকে এবং গালার মধ্যে যায় তার কারণে। 

১৫। সাপ ইত্যাদিতে দংশন করলে। 

১৬। পান খাওয়ার পর ভালভাবে কুলি করা সত্ত্বেও যদি থুথুতে লালভাব থেকে যায়।

১৭। শাহওয়াতের সাথে শুধু নজর করার কারণেই যদি বীর্যপাত ঘটে যায় তাহলে রােযা ফাসেদ হয় না।

১৮। রােযা অবস্থায় শরীর থেকে ইনজেকশনের সাহায্যে রক্ত বের করলে রােযা ভাঙ্গে না এবং এতে রােযা রাখার শক্তি চলে যাওয়ার মত দুর্বল হয়ে পড়ার আশংকা না থাকলে মাকরূহও হয় না। তবে যুবকদের এহেন অবস্থা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। আর রােযা অবস্থায় স্ত্রীর ঠোট মুখে নেয়া সর্বাবস্থায় মাকরূহ।

৫. রোজার মাসায়েল (৫ম পর্ব)

তথ্যসূত্রঃ
১. আহকামে জিন্দেগী/ইবাদত/রোজার মাসায়েল/

أحدث أقدم