স্পেনে মুসলিম শাসন : স্পেন বিজয়ের ফলাফল (৪র্থ পর্ব)

স্পেনের রাজনৈতিক কোলাহল ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। ভিজিগথিক রাজতন্ত্রের শেষ বীরপুরুষ ছিলেন রাজা উয়ামবা। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত হয় আরভিজিয়াস। এরপর তার জামাতা এযিজা। এযিজার পর তার পুত্র উইটিজা। উইটিজা নিহত হলে রাজবংশের বহির্গত ৮২ বছর বয়স্ক রডারিক ৭০৯ সালে আইবেরীয় উপদ্বীপটির সিংহাসন দখল করে। তাতে উইটিজার ভ্রাতুষ্পুত্র, জামাতা এবং আত্মীয়স্বজনরা রডারিকের শত্রু হয়ে পড়ে। তারা রডারিককে ভালাে চোখে দেখত না। সুযােগ পেলে তাকে উৎখাত করার পরিকল্পনায় মেতে উঠত। তা ছাড়া রাষ্ট্রে সুষঠু ও সুসংগঠিত কোনাে সেনাবাহিনীও ছিল না। সময়ে অসময়ে দাসদেরকে জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ করে তাদের প্রতি নির্মম নির্যাতন করা হতাে। ফলে দেশপ্রেম ও দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার প্রেরণা তাদের মধ্যে ছিল না। আর যারা সেনাবাহিনীতে ছিল তাদের মধ্যেও শৃঙ্খলা ও ঐক্যের ছিল যথেষ্ট অভাব। যার কারণে এক লক্ষ সেনার বিশাল বাহিনী বার হাজারের এক ছােট দলের নিকট পরাজিত হয়। নির্যাতনে নিষ্পেষিত সাফ, বর্গাদার ও ইহুদিরা এক বৈপবিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষায় ছিল। তারা মনে প্রাণে এই কামনা করত যে, এ শাসনের অবসান হােক। কিন্তু এ শাসনাবসান বিদেশি না স্বদেশী কারা করছে তা বিবেচনা করার সময় ছিল না। কারণ যেখানে মানুষের বাঁচার অধিকার নেই সেখানে এরকম চিন্তার অবকাশ কোথায়? তবে তারা মুসলমানদের শৌর্যবীর্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত ছিল। তাই তারা মুসলমানদেরকে তাদের ত্রাণকর্তারূপে সাধ্যমতাে সমর্থন জানায়।


মুসা বিন নুসায়ের যখন সেনাপতির দায়িত্বভার নিয়ে আফ্রিকায় আসলেন তখন আফ্রিকার বার্বারগণ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু সেনাপতি নিতান্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ায় তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ও ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করে তাদের মন জয় করে নেন। তিনি বিভিন্ন গােত্রে ইসলামের বাণী প্রচারে সক্ষম হন। পরে বহু বার্বারকে সেনাবাহিনীতে যােগ্য পদমর্যাদা প্রদান করেন। তন্মধ্যে তারিক বিন যিয়াদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার অফুরন্ত উদ্যম, তুলনাহীন সমরশৌর্য্য, বার্বার সৈন্যদের বাহুবল ও রণনিপুণতা স্পেন বিজয়ের অন্যতম কারণ। 


স্পেনের ভৌগােলিক অবস্থানও মুসলমানদের জন্য সহায়ক ছিল। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র ১৭ মাইল বিশিষ্ট এক প্রণালি। তাই আফ্রিকা থেকে স্পেনে যাওয়ার পথে কোনাে বাধা-বিপত্তি ছিল না। তা ছাড়া মুসলিম বাহিনীর অভিযান অন্যদিকে চলার উপায় ছিল না। কারণ একদিকে সাহারা মরুভূমি অন্যদিকে বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর। ফলে স্বভাবতই স্পেন বিজয় একমাত্র লক্ষ্য ও সহজসাধ্য ছিল। সর্বোপরি ইসলামের বীর মুজাহিদদের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রের ছিল-'মরলে শহিদ, বাঁচলে গাজি। তাই দুর্বার গতিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্পেনের ভূমিতে। তাদের বুকে কোরআন আর মুখে কালিমা। এক হাতে তলােয়ার অপর হাতে ইসলামি ঝান্ডা। ফলে অত্যাচারী গথিক রাজশক্তির পতন হয়ে টলেডাের প্রাসাদ শিখড়ে উড্ডীন হয় ইসলামের হেলালি নিশান।


গ্রানাডা প্রাসাদ/স্পেনে মুসলিম শাসন
গ্রানাডা প্রাসাদ ( image source: https://wallpapercave.com/granada-wallpapers)

স্পেন বিজয়ের ফল

মুসলমানদের স্পেন বিজয় ইউরােপের জন্য ছিল আশির্বাদস্বরূপ। খ্রিস্টান ইউরোপ মুসলিম স্পেনের সংস্পর্শে এসে ঘাের-অন্ধকার ও কুসংস্কার থেকে নিজেকে টেনে তােলে। আরব মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণ প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার মন্তব্য করেছেন,


"মধ্যযুগের প্রথমভাগে এই আরবজাতি মানব সভ্যতার প্রগতির ক্ষেত্রে। অবদান রেখেছে এমন আর কোনাে জাতিই রাখেনি।"


শার্লেমন ও তার লর্ড যখন নাম দস্তখত করতে শিখছিল বলে কথিত, তখন আরব-পণ্ডিতেরা এ্যারিস্টটলের গ্রন্থ অধ্যয়নে ব্যস্ত। কর্ডোাভার মুসলিম বিজ্ঞানীরা সতেরােশ লাইব্রেরিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নিমগ্ন। সে লাইব্রেরিসমূহের এক একটি লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪০,০০০। সেই পণ্ডিতেরা যখন আরামদায়ক স্নানাগার ব্যবহার করত, তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিকে এক ভয়ংকর অনাচার বলে বিবেচনা করা হতাে। খ্রিষ্টান ইউরােপের অশুচি ও অনাচার সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ একইভাবে বিরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি। একজন সন্যাসিনী সুদীর্ঘ ৬০ বছর পর্যন্ত স্নান অথবা দেহের কোনাে অংশ ধৌত না করে কেবল ধর্মগ্রন্থ পাঠের সময় আঙুলের অগ্রভাগ পানিতে ডুবিয়ে পবিত্রতা 'অর্জন' করার এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সৃষ্টি করেছিলেন। অথচ মুসলমানরা অজু-গােসলের সাহায্যে পবিত্রতা অর্জনের জন্য কত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা করেছেন। 


এমনিভাবে বছরের পর বছর ধরে স্পেনের মুসলমানেরা খ্রিষ্টান ইউরােপকে সভ্যতার আলােকে টেনে আনেন। এ জন্য বর্বরতা, অজ্ঞতা, আত্মকলহে অতিষ্ঠ, যুদ্ধ ও বিবাদবিসংবাদে জর্জরিত স্পেনের সাধারণ জনগণ।মুসলমানদেরকে তাদের ত্রাণকর্তা ও হিতাকাঙ্ক্ষীরূপে দেখেছিল। রােমান ও ভিজিগথিকদের নির্যাতনমূলক শাসনব্যবস্থার নাগপাশ থেকে তারা মুক্তি লাভ করে হাঁফ ছেড়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মুসলমানদের মাধ্যমে সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা সামাজিক নিরাপত্তা ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। অনেকে ইসলামের সাম্যবাদী দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল। 


এক কথায়, মুসলমানদের আগমনে স্পেনে সামাজিক বিপ্লব সৃচিত হয়েছিল। ইউরােপে এ সময় থেকেই প্রকৃত রেনেসার সূত্রপাত হয়। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী, গোঁড়া খ্রিষ্টান ও ধর্মীয় যাজকশ্রেণি মুসলমানদের এ বিজয়কে এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নিতে পারেনি। তারা পদে পদে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিরােধিতা ও তার পতনের জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাতে থাকে। এদের একটি অংশ দক্ষিণের পার্বত্য এলাকায় চলে যায়। সেখান থেকে তারা সংঘবদ্ধভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এক সময় তাদের এ প্রচেষ্টার ফলেই পুরাে স্পেন খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যায়।


সম্পর্কিত পাতাঃ
৪. স্পেনে মুসলিম শাসন (৪র্থ পর্ব)
Previous Post Next Post