নিজামুল মুলক : রাজ্যের শৃঙ্খলা খাজা হাসান আল তুসী

সেলজুক শাসকদের কাছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার যথেষ্ট কদর ছিলাে। প্রচলিত রাজকীয় বর্ণাঢ্য সাজে তাদের কোন রাজদরবার ছিলা না। এজন্য তারা চাটুকার দরবারীদের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতাে না। যে কোন বিষয়ের ফয়সালা হতাে অনেক বচসার পর। তাদের সফলতার কারণ ছিলাে এটাই।


তুঘরিল বেগ ও চেগরা বেগ এক দেশেরই দুই রাজধানীর দুই সুলতান ছিলেন। চেগরা বেগ ছিলেন মারুতে। একদিন এক সদ্য যুবক তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এলাে। তার পােষাক বলে দিচ্ছিলাে সে কোন সাধারণ প্রার্থী নয়। তার চোখে মুখে সম্ত্রান্ত বংশের ঔজ্জল্য ঝিলিক দিচ্ছিলাে।


আপনি কে-একথা জিজ্ঞেস করলে সুলতানকে কি বলবাে? আর আপনার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যই বা কি?' - সুলতানের মহলের দারােয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলাে।


আমার নাম খাজা হাসান তুসী। নিশাপুর থেকে এসেছি। আমি নিশাপুরের ইমাম মুওয়াফিকের ছাত্র। তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বেরিয়েছি। ফকীহ ও মুহাদ্দিস স্তর পর্যন্ত পড়েছি। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য সুলতানকে বলবাে - সাক্ষাৎপ্রার্থী বললাে।


দারােয়ানদের নির্দেশ দেয়া ছিলাে, দেশের কোন আলেম বা শিক্ষিত নাগরিক সুলতানের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এলে তাকে যেন সাদরে গ্রহণ করা হয়। দারােয়ান তাই সুলতান চেগরা বেগকে গিয়ে জানালাে।


'তাকে কি ফকীহ বা মুহাদ্দিস বলে মনে হয়? - সুলতান জিজ্ঞেস করলেন। হ্যা সুলতানে মুহতারাম! পরিমিতভাষী এবং আলেমদের পােষাকে সজ্জিত। চেহারাও বেশ অভিজাত।

নিজামুল মুলক : রাজ্যের শৃঙ্খলা খাসা হাসান আল তুসী
নিজামুল মুলক (source : aksam.com.tr)

তাহলে তাকে এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা তাে অভদ্রতা! এখনই তাকে পাঠিয়ে দাও। কিছুক্ষণ পর সুলতানের সামনে যে লোকটি সালাম দিয়ে দাঁড়ালাে তার নাম খাজা হাসান তুসী। সুলতান তাকে সসম্মানে বসালেন।


হে যুবক! আমি কি করে মেনে নেবাে তুমি ইমাম মুওয়াফিকের ছাত্র? আমি জানি ইমাম মুওয়াফিকের ছাত্র হওয়াটা কত বড় সম্মানের - সুলতান বললেন।


আমার কাছে তার সনদ আছে - হাসান তুসী কয়েকটি কাগজ সুলতানের হাতে দিয়ে বললেন - 'আমি ফেকাহ ও হাদীস শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়েও তার কাছে থেকে গবেষণা করেছি।


তাহলে কি তােমার লেখাপড়ার পাঠ শেষ?


না সুলতানে আলী মাকাম! আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকে বের হয়েছি, শিক্ষার গণ্ডি থেকে এখনাে বের হইনি। জ্ঞানের তুলনা তাে সমুদ্রের অগাধ জলরাশির মতাে। মণিমুক্তা তার হাতেই শােভা পায় যে সাগরের তলদেশ থেকে ঝিনুকের খােল উদ্ধারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে।


সুলতান চেগরা বেগের চোখে প্রশংসার দৃষ্টি উজ্জ্বল হলাে।


আমার দেখতে ইচ্ছে করছে তােমার বুদ্ধির ধার কতটুকু? কিতাব বা বই বিদ্যা দিতে পারে, বুদ্ধি নয়..... তুমি নিজেকে কতটুকু বুদ্ধিমান মনে করাে?' - সুলতান জিজ্ঞেস করলেন।


'মহামান্য সুলতান! মানুষ নিজেকে যতটুকু বুদ্ধিমান মনে করে সে ততটুকুই নির্বোধ এবং সে নিজেকে যত বড় মনে করে ততই সে ছােট। কে বুদ্ধিমান আর কে নির্বোধ এই ফয়সালা ক'জনই বা করতে পারে।


আচ্ছা তুসী! একটা কথার জবাব দাও। কোন শাসক যদি চায় সে প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয় হবে এবং মৃত্যুর পর প্রজারা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে তাহলে তার কি গুণ আর মানসিকতা থাকা উচিত?- সুলতান আশ্বস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।


সে তার ধর্ম ও দেশের জন্য হবে অগ্নিঝড়। প্রজাসাধারণের জন্য হবে শীতল পানি, হবে উর্বর মাটির মতাে স্বচ্ছন্দ, আকাশের বিশালতার মতাে উদার, ঈগলের মতাে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিধারী, কাকের মত সদা সতর্ক, কোকিলের মতাে মিষ্টভাষী, বাঘের মতাে নির্ভীক এবং চাঁদ তারার মতাে বিশুদ্ধ পথনির্দেশক। এমন নয় যে, আজ এদিকে কাল ওদিকে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়' - হাসান তুসী বললেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।


এসব কি আমার মধ্যে আছে?' - সুলতান কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।


আমি যদি বলি হ্যা, তাহলে এটা তােষামােদি হবে। তােষামােদি আর মুনাফিকী এক জিনিস। আমি মুনাফিক হতে চাই না। আর যদি বলি সুলতানের মধ্যে এসব গুণের কমতি আছে তাহলে অসন্তোষের পাত্র হবাে। কারাে অসন্তোষের পাত্র হওয়া আমার কাম্য নয়। - হাসান তুসী বললেন।


'হে যুবক!' - সুলতান বললেন- 'তােমার স্পষ্টভাষিতা সত্যিই প্রশংসার যােগ্য। কিন্তু একটা কথা বলাে... যদি এসব গুণের দু'একটি আমাদের মধ্যে না থাকে তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?


মহামান্য সুলতান। তসবীহতে সাধারণত দানা থাকে একশটি আর গ্রন্থি থাকে একটি। যদি এই একটি মাত্র গ্রন্থি খুলে যায় তাহলে তসবীহর সবগুলাে দানাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। হতে পারে আপনার সেই গুণটি বা এর স্থলের তুটিটি আপনার গুণ-গাঁথার মূল্যায়ন রাখে। এর কারণে যে কোন সময় আপনার অর্জিত গুণ-গাঁথার গ্রন্থির দানাগুলাে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।


'হাসান তুসী!' - সুলতান চেগরা বেগ উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন- 'আমি তােমাকে আমার বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ােগ করলাম। যদি তুমি তােমা সত্যভাষিতা ও সত্যময় নীতির স্বচ্ছতা ধরে রাখতে পারাে তাহলে এটা আমার ভবিষ্যদ্বাণী যে, একদিন তুমি এই সালতানাতের ওযীরে আজম-প্রধানন্ত্রী হবে।


পরবর্তীতে সুলতান চেগরা বেগের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন ঘটে। হাসান তুসী ওযীরে আজম পদে সমাসীন হন। তখন সুলতান চেগরাবেগের পৌত্র মালিক শাহ সুলতান ছিলেন। মারু অর্থাৎ দ্বিতীয় রাজধানীতে ছিলেন সুলতান আলিপ আরসালান। সেলজুকি সুলতানরা হাসান তুসীর উপাধি দিয়েছিলেন 'নেযামুল মুলক'-রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পরিচালক বা রাজ্যের শৃঙ্খলা। পুরাে দেশ তাকে এই নামেই চিনতাে। তার হাসান তুসী নামটা একসময় সেলজুকিদের আরােপিত উপাধির আড়ালে চলে যায়। নেযামুল মুলক বাগদাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাদরাসায়ে নেজামিয়া নামক এক ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও বিখ্যাত মনীষী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ এখান থেকেই এক সঙ্গে বৃত্তি নিয়ে বেরিয়েছিলেন।



তথ্যসুত্রঃ 
১. ফেরদৌসে ইবলিস/এনায়েতুল্লাহ আলতামাস

Previous Post Next Post