আবু আইয়ুব আল আনসারি (রাঃ) : কনস্ট্যান্টিনোপলের মাটিতে

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস। মদিনায় প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ছে।

শহরের দক্ষিণে থাকা খেজুর গাছগুলি থেকে গতকাল সব খেজুর কেটে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও খেজুর কাটার সময় এখনও হয়নি, তবুও মদিনার কৃষকদের এবার কিছু করার ছিল না। আরবের সম্মিলিত বাহিনী চলে এসেছে মদিনার ঘাড়ের ওপর। উহুদ পর্বত পেরিয়ে দশ হাজার পদাতিক যােদ্ধার বাহিনী অবস্থান নিয়েছে শহরের গেটে। এমতাবস্থায় খেজুর না কাটা আর খেজুর তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনাে পার্থক্য থাকে না।


আরবদের সম্মিলিত বাহিনীতে দশ হাজার পদাতিকের সঙ্গে যুদ্ধের ঘােড়া ছিল ছয়শাে, সঙ্গে ছিল বেদুইন ক্যাভালরি, প্রায় দুই হাজার। গােটা মদিনার জনসংখ্যা তখনাে দশ হাজার ছাড়ায়নি। মােট সক্ষম পুরুষ ও কিশােরদের সংখ্যা মিলে হলাে তিন হাজার। এই তিন হাজারকে যুদ্ধের সাজে সাজানাের মতাে অস্ত্র মদিনার সরদারের কাছে নেই। সর্বোচ্চ দেড় হাজার যােদ্ধাকে অস্ত্রসজ্জিত করা যাবে। মদিনার সরদার পরামর্শ সভা ডাকলেন।


সরদারের নাম হজরত মুহাম্মাদ (সা.)।


দুই পরামর্শ সভায় এক অভিনব সিদ্ধান্ত হলাে। মদিনার দুই দিকে বিশাল এক পরিখা খনন করা হবে। এই বুদ্ধি এসেছে ইরান থেকে আসা একজন মুক্ত দাস, সালমান ফারসি (রা.)-এর মাথা থেকে। পরিখা খননের কাজ শুরু হয়ে গেল। মহানবি (সা.) ঘােষণা করলেন, এই কাজে সব মুসলিমকে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হবে।


প্রতিটি ঘর থেকে পুরুষরা বেরিয়ে এলেন। শুরু হয়ে গেল কাজ। দিনরাত খেটে চলছিল ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজ। পুরুষরা মাটি কাটবে, মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাবে মেয়েরা পুরুষদের খন্তা-কোদাল, খাবার-পানি এগিয়ে দেবে। পাঁচ গজ গভীর, দশ গজ চওড়া ট্রেঞ্চে মদিনার এক পাশ ঘিরে দেওয়া হলাে। এরমধ্যে বেঁধে গেল এক সমস্যা। বিশাল এক পাথর পড়ল ট্যাকটিক্যালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গাতে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার সময়। মুসলিম বাহিনীর সেরা বীররা কুঠার চালালেন। জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) এবং সবশেষে আলি ইবন আবি তালিব (রা.)। কোনােভাবেই পাথরটা কাটা গেল না। এই পাথর কাটতে না পারলে এখান দিয়ে ট্রেঞ্চ খোঁড়া যাবে না।


খবর শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) নামলেন কুঠার হাতে। আল্লাহু আকবার রবে প্রথম আঘাত হানলেন তিনি। কুঠারের আঘাতে অত্যন্ত উজ্বল আগুনের ফুলকি উঠল পাথরের গা থেকে। পাথর কাটল না। দ্বিতীয়বার একইভাবে আল্লাহু আকবার রবে পাথরে আঘাত হানলেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। এবার আরও উজ্জ্বল আলাে দেখা গেল, কিন্তু পাথর কাটল না। তিন বারের বার আল্লাহু আকবার রবের সঙ্গে সঙ্গে পাথর টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল। এবার আরও উজ্জ্বল আগুনের ফুলকি দেখা গেল। পাথর কাটার পর রাসূলুল্লাহর (সা.) চারপাশে জড়াে হলেন সাহাবিরা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রথমবারের আগুনের ফুলকিতে আমাকে কিসরার প্রাসাদসমূহ দেখানাে হয়েছে। আমার উম্মত ওগুলাে জয় করবে। দ্বিতীয়বারের আগুনের ফুলকিতে আমাকে সিরিয়া ও কন্তুনতুনিয়ার প্রাসাদসমূহ দেখানাে হয়েছে। তিনবারের বার আমি দেখেছি বিশাল জমিন ও সমুদ্র, যা আমার উম্মতের অধীন হবে।


যাদের একথা শােনানাে হচ্ছিল তাদের বেশিরভাগই তখন অভুক্ত। অবরােধের কারণে বাইরের সঙ্গে মদিনার যােগাযােগ বন্ধ। অবরােধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাই মদিনার মােট খাবারের মজুদ একসঙ্গে করে সবাইকে দু বেলা করে রেশন দেওয়া হবে। অভুক্ত এই মানুষগুলাের কাছে তখন কনস্ট্যান্টিনােপল নামক নগরী পর্যন্ত ভ্রমণ করাই ছিল বিশাল গর্বের ব্যাপার। তখন পর্যন্ত কনস্ট্যান্টিনােপল ছিল বাইজান্টাইন রােমান সাম্রাজ্যের রাজধানী।


এরপর নবিজি (সা.) তাঁর সারা জীবনে একাধিকবার বলেছেন, আমার উম্মতের এক সেনাদল কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করবে। কতই না মুবারক সেই সেনাদল, আর কতই না মুবারক তাদের সেনাপতি!


এই ধারণা পরবর্তীকালে সাহাবিদের মনে গেঁথে যায়। কনস্ট্যানটিনােপল জয় পরিণত হয় এক কিংবদন্তিতে।

কনস্ট্যান্টিনোপল | ইসলামবুল বা ইস্তাম্বুল | হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারি (রাঃ)
Istanbul-AyaSofia (https://unsplash.com/photos/HywGjvT39Dk)
৬৭২ সাল। আমির মুয়াবিয়া (রা.) তখন খলিফা। খালিদ ইবন ওয়ালিদের (রা.) তলােয়ারের আঘাতে রােমানরা সিরিয়া-ফিলিস্তিন আর পূর্ব আনাতােলিয়া থেকে পালিয়েছে ত্রিশ বছর আগেই, যদিও তখন তাদের দখলে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সভ্য ইউরােপ। মুয়াবিয়া (রা.) সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কনস্ট্যান্টিনােপলে অভিযান চালাবেন। আলি (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে যুদ্ধের পর থেকে নিজেদের রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেওয়া সাহাবিদের বেশিরভাগই তখন মদিনায়। সরকারি কোনাে কাজের ধারে কাছে তারা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।


নবিজির পতাকাবাহক আবু আইয়ুব আল আনসারি (রা.)-এর বয়স তখন আশিরও বেশি। দুর্বল শরীর। চোখে ভালাে দেখেন না। মদিনার রাস্তায় তিনি শুনতে পেলেন, কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে। আবু আইয়ুবের (রা.) মস্তিষ্কে ধ্বনিত হলাে কুরআনের আয়াত- "তােমরা আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়াে, হালকা কিংবা ভারী, যেকোনাে অবস্থায়... (সূরা আত তাওবা ৪১)


আবু আইয়ুব দেখলেন, কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযানের খবরে মদিনাতে হইচই পড়ে গেছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবন উমার, আব্দুল্লাহ ইবন জুবায়ের, আবু শাইবা আল আনসারি, হামিদুল্লাহ আল আনসারি, কাব ইবন মালিক, হাফিজ (রা.)-সহ তখনকার সব জীবিত সাহাবিরা তােড়জোড় শুরু করেছেন কনস্ট্যান্টিনােপলে যাওয়ার জন্য। তারা সবাই শুনেছেন, যে সেনাদল প্রথম কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করবে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে।


বৃদ্ধ আবু আইয়ুব (রা.)-কে সবাই মিলে চেপে ধরলেন। এই অবস্থাতে অভিযানে তাকে নেওয়া কোনােমতেই ঠিক হবে না। তিনি কারও কথাই শুনলেন না। ৬৭৩ সালে মুসলিম ফ্লিট রওনা হলাে কনস্ট্যান্টিনােপল অভিযানে। 


তিন দিক থেকে কনস্ট্যান্টিনােপল ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল মুসলিম বাহিনী। রােডস দ্বীপ জয় করে আব্দুল্লাহ ইবন কায়েসের নৌবাহিনী মার্মারা সাগরে গাল্লিপলি উপদ্বীপের দিক থেকে ঢুকলেন কনস্ট্যান্টিনাপলের পশ্চিমে। পূর্বে আরও এক নৌবাহিনী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে অবরােধ করল বসফরাস, স্মার্নাতে থাকা রােমানদের নৌবহর তাদের সামনে টিকতে না পেরে পালাল। ওদিকে স্থলপথে ইয়াজিদ আর ফুজাইল ইবন উবায়েদের বাহিনী এগোতে লাগল আনাতােলিয়ার বুক চিরে। রােমানরা এগােল তাদের ঠেকাতে। আনাতােলিয়ার তীব্র শীতে মুসলিম বাহিনী টিকতে পারল না রোমানদের সামনে। ত্রিশ হাজার শহিদের লাশ রেখে তাদের পিছু হটতে হলাো আনাতােলিয়ার দিকে। আসার পথে সাইলেনিকাতে তারা পড়লেন ঝড়ের মুখে। প্রচণ্ড ঝড়ে প্রায় পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে গেল মুসলিম স্থলবাহিনী। জলে তখন অন্য বিপদ। কনস্ট্যান্টিনােপলের দেয়াল পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু রােমানদের বিখ্যাত গ্রিক ফায়ারের সামনে একের পর এক মুসলিম জাহাজ পুড়ে যেতে থাকল। তার মধ্যেই কনস্ট্যান্টিনােপলের বিখ্যাত থিওডােসিয়ান ওয়ালে হানা দিলেন অভিজ্ঞ মুসলিম বীরদের নিয়ে গড়া বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হলাে না। থিওডােসিয়ান ওয়ালের সামনে রােমানদের তিরে শহিদ হলেন আবু শাইবা আল আনসারি, হাফিজ আনসারি, হামিদুল্লাহ আল আনসারি, কাব ইবন মালিক (রা.)।


পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে যখন অবরোেধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে মুসলিম বাহিনী, আবু আইয়ুব (রা.) তখন মুসলিম বাহিনীর কমান্ডারকে ডাকলেন। তার হাতে হাত রেখে বললেন, 'যদি কনস্ট্যান্টনোপল জয় না-ও হয়, আর আমি মারা যাই, তাহলে কনস্ট্যান্টিনােপলের সবচেয়ে কাছে যতদূর তােমরা যেতে পার, সেখানে আমাকে কবর দিও।'


এর দুদিন পর মারা গেলেন আবু আইয়ুব আল আনসারি (রা.)। ফিরে আসার আগে তাকে কবর দিয়ে আসা হলাে থিওডােসিয়ান ওয়ালের ভেতরের দিকের একটা জায়গাতে। ধীরে ধীরে তার কবরটা পরিণত হলো এক তীর্থস্থানে। আল তাবারি, আল বালাজুরি, জাকারিয়া আল কাজওয়াইনি, রােমান সম্রাট ম্যানুয়েল ওয়ান এবং পিকে হিট্টি, সবাই লিখে গেছেন, যখনই কনস্ট্যান্টিনােপলে খরা দেখা দিত, খ্রিষ্টান পাদ্রিরা তখন আবু আইয়ুব আল আনসারির (রা.) কবর খুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।৫ যতবার এভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে, প্রতিবারই খরা দূর হয়েছে, আকাশ থেকে নেমে এসেছে অঝাের ধারায় বৃষ্টি।



তথ্যসূত্রঃ 
সানজাক-ই উসমান/বারুদী সালতানাত/আল ফাতিহ/পৃঃনং ২৮৫-২৮৮
Previous Post Next Post