ইমাম আবু জাফর আত তাহাবী রহিমাহুল্লাহ : জীবন ও কর্ম

তাঁর প্রকৃত নাম আহমদ, উপনাম আবু জাফর। পিতার নাম মুহাম্মদ। তাঁর বংশ পরিক্রমা হলাে- আবু জাফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামা ইবনে মাসলামাহ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে সালামা ইবনে সুলাইমান ইবনে হারবুল আযদী আল হাজারী আল মিসরী আত তৃহাবী (র.)।


ইয়ামেনের একটি বিখ্যাত গােক্রের নাম আযদ। এরই একটি শাখার নাম হাজার। ত্বহা নামক এলাকায় তিনি বাস করতেন। বর্ণিত সব দিকেই সম্বন্ধ করে তাঁকে কখনাে আযদী, কখনাে হাজরী আবার কখনাে ত্বহাবী বলা হয়। তবে তিনি ত্বহাবী নামেই সমধিক পরিচিত।


জন্ম : ইমাম তাহাবী (র.) ১১ই রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্য তাঁর জন্ম সন নিয়ে বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। ইবনে আসাকির (র.) ইবনে ইউনুস (র.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, ইমাম ত্বহাবী (র.) ২৩৯ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল কাদের কুরাশী, ইবনে নুকতা, ইয়াকৃত ইমাবী, আল্লামা ইবনে জাওযী, আল্লামা সুযুতী, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী, আল্লামা হাফেজ ইবনে কাসীর, ইবনুত তাগরী, শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ও মিসরীয় ব্যক্তিবর্গের মতেও ইমাম ত্বহাবী (র.)-এর জন্ম ২৩৯ হিজরি সনে হয়েছে।


Image of books, ইমাম তাহাবীর জীবনী, ইমাম তাহাবী জীবন ও কর্ম, ইমাম তাহাভী (র.),  এর পরিচয়

শৈশবকাল : খােদাভীরু আলেম পরিবারে ইমাম ত্বহাবী (র.) জন্মগ্রহণ করায় তাঁর শৈশবকাল শুরু হয় ধর্মীয় পরিবেশে। তাঁর শৈবকাল অতিবাহিত হয়েছে মা বাবার সুশাসন ও সুদৃষ্টির মধ্য দিয়ে। পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের মতাে তাঁর শৈশব কাটেনি। তিনি সকলের নিকটই অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।


শিক্ষা জীবন : ইমাম ত্বহাবী (র.) ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। স্বীয় পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস, যুগ শ্রেষ্ঠ ফকীহ, ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর একনিষ্ঠ শীর্ষ ইমাম ইসমাঈল মুযানী (র.)-এর নিকট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর মামা শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন বিধায় তিনিও ছােটকাল থেকে শাফেয়ী মাজহাব অনুযায়ী গড়ে উঠেন । তিনি আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে আমরুসের নিকট কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন। ইমাম আহমদ ইবনে আবূ ইমরান, জাফর ইবনে আবূ ইমরান, কাজি আবদুল হামীদ ইবনে জা'ফর, কাজি বকর ইবনে কুতাইবা ও আবূ আজীম প্রমুখ ওলামাদের নিকট তাফসীর হাদীস, ফিকহ ও আকাইদ, যুক্তিবিদ্যা ও ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।


শিক্ষা সফর : ইমাম ত্বহাবী (র.) তৎকালীন সর্বাপেক্ষা বড় আলেম এবং প্রখ্যাত হাদীস বিশারদগণের নিকট জ্ঞানার্জন করার পরও উচ্চতর জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে সিরিয়া, জেরুজালেম, গাজা এবং আসকালানসহ বিভিন্ন শহরে সফর করেন। এছাড়াও তিনি ইয়ামান, বসরা, হেজাজ, কৃফা ও খুরাসান দেশ জ্ঞানাম্বেষণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন।


কর্মজীবন : ইমাম ত্বহাবী (র.) সূদীর্ঘকাল জ্ঞানাম্বেষণের পর শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়ােগ করেন। পূর্ণ মন মানসিকতা তাতে ঢেলে দেন। ফলে তিনি সকলের নিকট একজন সফল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হন। তাঁর দরসে অনেক দূর থেকে জ্ঞান পিপাসু ছাত্ররা এসে ভিড় জমাতেন। এ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখা লেখিতে মনােনিবেশ করেন। যার ফলে তাঁর কর্মময় জীবনের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়ে পড়ে।


মাজহাব পরিবর্তন : যখন ইমাম ত্বহাবী বিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেন তখন তিনি হানাফী মাজহাব গ্রহণ করেন। এর পূর্বে তিনি শাফেয়ী মাজহাব-এর অনুসারী ছিলেন। তাঁর এই পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে ওলামাদের অনেক মতামত রয়েছে। আবার বানােয়াট ও অসারতাও রয়েছে। নিম়ে তাঁর মাজহাব পরিবর্তনের সর্বাধিক বিশুদ্ধতম কারণ তুলে ধরা হলাে।


ইমাম তৃবহাবী (র.)-এর আপন মামা ইমাম মুযানী (র.)-এর নিকট শাফেয়ী মাজহাবের শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর মামা ইমাম শাফেয়ী (র.) -এর একজন বিশিষ্ট ও মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও নিজ ভগ্নি পুত্রের জ্ঞানের পিপাসা নিবারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। যার কারণে ফিকহের ময়দানে ইমাম ত্বহাবী (র.) যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ততই তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কারণ উসূল ও মূলনীতির পটভূমি খুটিনাটি বিষয়ের সমাধানে তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতেন। তাঁর মামার পক্ষে তাঁর অনুসন্ধিৎসা নিবৃত করা সম্ভব হতােনা। এ অবস্থায় ইমাম ত্বহাবী খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে, তাঁর মামা মতবিরােধপূর্ণ মাসআলার সমাধান দেওয়ার জন্য হানাফী মাজহাবের কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন এবং সে আলােকে সমস্যার সমাধান দেন। এ অবস্থা দেখে তিনি নিজেও হানাফী মাজহাবের গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। 


আর এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেন, আমি মামাকে সর্বদা হানাফী মাজহাবের গ্রন্থাবলি অধ্যয়ন করতে দেখে আমি নিজেও তাতে লেগে পড়ি এবং আমি তুলনামূলকভাবে প্রত্যক্ষ করি যে, হানাফী মাজহাবের দলিল আদিল্লা শাফেয়ী মাজহাবের প্রমাণাদি হতে অধিক শক্তিশালী ও অকাট্য। যার ফলে তা আমার হৃদয়ে রেখাপাত করে। আমার মামা যখন আমার এ অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন, তখন তিনি আমার প্রতি রাগ হয়ে বললেন, এ আল্লাহর শপথ, তােমার দ্বারা কিছু হবে না। 


অতঃপর তিনি মামার সঙ্গ ত্যাগ করে হানাফী মাজহাবের বিশিষ্ট আলেম, কাজি আহমদ ইবনে আবু ইমরান বাগদাদীর নিকট ফিকহে হানাফীর জ্ঞানার্জন শুরু করেন। পরিশেষে হানাফী মাজহাবের প্রতি পূর্ণ আকৃষ্ট হয়ে শাফেয়ী মাজহাব ত্যাগ করে হানাফী মাজহাব গ্রহণ করেন।


এতদ সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আশ শুরুতী (র.) বলেন, আমি ইমাম ত্বহাবী (র.) কে তাঁর মাজহাব পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, আমার মামা আবু ইবরাহীম ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া আল মুযানীকে হানাফী মাজহাবে গ্রন্থাবলি অধ্যয়ন করতে দেখেছি এবং তিনি তা থেকে অনেক ফায়দা হাসিল করতেন। যার ফলে আমার অন্তরেও হানাফী মাজহাবের গ্রন্থাদি অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি হলাে এবং আমিও অধ্যয়ন করতে লাগলাম। আর এই অধ্যয়নই আমার অন্তরে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করলাে। যার ফলে আমি হানাফী মাজহাব গ্রহণ করি।


ইমাম ত্বহাবী (র.) কে মুসলিম সমাজে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়ােজন পড়ে না। তাঁর জীবন এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তাঁর জীবনীর উপর অনেকেই ডক্টরেট ডিগ্রী পর্যন্ত অর্জন করেছে। তৃতীয় শতকের খ্যাতনামা মনীষীদের অন্যতম হলেন তিনি। ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহ উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল অসামান্য জ্ঞান। হাদীস মুখস্থ করার সাথে সাথে ফিকহ ও ইজতিহাদেও তাঁর অবস্থান ছিল অনেক উপরে। তাকে অনেক উঁচু পর্যায়ের মুজতাহিদগণের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি একজন মুজতাহিদ মুনতাসিব ছিলেন। তিনি হানাফী মাজহাবের শুধু মুকাল্লিদই ছিলেন না; বরং অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে স্বয়ং আবূ হানীফা (র.)-এর ভিন্ন মতও পােষণ করেছেন। এ কারণে আল্লামা আবদুল হাই লক্ষ্ণবী (র.) বলেছেন, ইমাম ত্বহাবী (র.) ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর স্তরের ইমাম। তাঁর মর্যাদা তাদের থেকে কোনাে অংশেই কম নয়।


ইন্তেকাল : এই ধর্মভীরু আলেমে দীন, স্বনামধন্য ভাষা বিজ্ঞানী, জ্ঞান তাপস, হানাফী মাজহাবের স্বনামধন্য মুজতাহিদ-মুজাদ্দিদ ইমাম ত্বহাবী (র.) ৩২১ হিজরি সনের জিলকদ মাসের এক সুন্দর রাতে আল্লাহ তা'আলার সান্নিধ্যে চলে যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তাঁকে কারাকা নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়। 


তথ্যসূত্রঃ

আক্বীদাতুত্বত্বহাী, ইমাম তাহাবীর আক্বীদা বিষয়ক গ্রন্থের ইমাম তাহাবীর জীবনি অংশ থেকে নেয়া।

أحدث أقدم