বাঙ্গালির ইতিহাস : মুসলিমদের হাতেই বাংলার জন্ম

একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১২০৩ সাল অবধি সেন শাসনে ছিলাে এই দেশ। সেন রাজাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন ভারতের দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে। তাঁরা এ দেশে সৃষ্টি করেন হিংস্রতার রাজত্ব। বহু আগে, ৬৩৭ সালে গুপ্তবংশীয় রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে এ দেশে সূচিত হয়েছিলাে এক ভয়াবহ অরাজকতা। ১১৩ বছর ধরে যা ছিলাে অব্যাহত। এই অরাজকতার শাসনকে বলা হতা মাতসান্যায়, বােয়াল মাছের রাজত্ব। ৭৫০ সালে তা হয় অবসিত। সেন রাজারা অরাজকতাকে ফিরিয়ে আনেন আবারও। বায়াল মাছের শাসন মানেই জোর যার মুল্লুক তার। নিয়ম নেই, বিচার নেই। যার দাঁত যত ধারালাে, চোয়াল যত মজবুত, গায়ে যত বল, প্রভুত্ব তার, রাজত্ব তার। সে যা ইচ্ছে তাই করবে। যাকে ইচ্ছে তাকে ধরবে, মারবে, খাবে, টুকরাে টুকরাে করে ফেলবে। এমনই চলছিলোে চারদিকে।


বাঙালির ইতিহাস। মুসলিমদের হাতে বাংলাদেশের জন্ম। বাঙালি মুসলিম শাসন ব্যবস্থা

বৈদিক সংস্কৃতি ও সেন রাজত্বে এই দেশ, এই জনপদ বােয়াল মাছের চোয়ালে কাতরাচ্ছিলাে। নিম্নশ্রেণীর কোটি কোটি মানুষ বাধ্য হয় হীনতর ও হেয়তর জীবন যাপনে। সবচেয়ে বেশি বিপদ আসে বাংলাভাষীদের ওপর। বৈদিক সেনরা এই সব জনপদকে শাসন করেছে, কিন্তু ভালোবাসেনি। কারণ, এ দেশের কোনােই সম্মান ছিলাে না মনুসংহিতায়। সেখানে বরং আছে।তীর্থযাত্রা ছাড়া এ দেশে এলে প্রায়শিচিত্ত করতে হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী ঋষিরা এই জনপদের সন্তানদের মানুষ বলতে অপারগ ছিলাে। তারা তাদের বলতাে দাস, দস্যু, সর্প। বলতাে অসুর, পিশাচ, পক্ষীজাত ধর্মগ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে দেবতার ভাষায় তাদেরকে দেবতার শত্রু বলে অভিহিত করতাে। বলতাে, ওরা হলাে রাক্ষস, স্লেচ্ছ ইত্যাদি। তাদের রক্ত ঝরানােতে ছিলাে গৌরব। তাদের উচ্ছেদ ও অপমানে ছিলাে দেবতার তুষ্টি। তাদের হত্যা ও নির্মূল ছিলো ধর্মাচারের মতাে। এ ভূমির সন্তানরা ভয়ে ভয়ে থাকতাে, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতো। কিন্তু লুকিয়ে থাকা সহজ ছিলাে না। কারণ তারা কথা বলতাে বাংলায়। আর বাংলাকে ঘৃণা করতাে আর্যেরা। সেনদের রাজভাষা ছিলাে সংস্কৃত। বাংলার চর্চা ছিলাে নিষিদ্ধ। বাংলাভাষীদের আশীর্বাদগ্রহণকেও শাস্ত্রমতে নিষিদ্ধ করা হয়। তাচ্ছিল্য করে বলা হয়-


আশীর্বাদং ন গৃহীয়াৎ পূর্ববঙ্গ নিবাসিনঃ

শতায়ুরিতি বক্তব্যে হতায়ুর্বদতি যতঃ


অর্থ হচ্ছে, পূর্ববঙ্গের লােকদের আশীর্বাদ গ্রহণ করাে না। কারণ তারা শতায়ু বলতে গিয়ে হতায়ু বলে বসে। ঐতরেয় আরণ্যকে বাংলা ভাষাকে ইতর ভাষা হিসেবে দেখানাে হয়। পাখির ভাষার মতাে দুর্বোধ্য বলে একে আখ্যা দেয়া হয়। আর্যদের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষা অন্ত্যজ ছিলাে বলেই শুদ্রদের জন্য বরাদ্ধ করা হয় এ ভাষার পাঁচালি। সংস্কৃত ভাষায় রচিত পুরাণ পাঠের অধিকার তাদের নেই। প্রচার করা হতাে শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা-


পুরান পড়িতে নাই শুদ্রের অধিকার

পাঁচালি পড়িয়া তব এ ভব সংসার


বাংলা ভাষা তাদের চোখে এতােই হেয় ছিলাে যে, এ ভাষায় আঠারােটি পুরান কিংবা রামের জীবনী পাঠ করলে, শুনলে নিশ্চিত হতাে নরক। বাংলাভাষীদের জন্য বরাদ্ধ নরকের নাম ছিলো রৌরব।


চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ে আছে এর ভাষ্য-

অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ।

ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ


অর্থাৎ আঠারােটি পুরাণ আর রামের জীবনচরিত দেশীয় ভাষায় শুনলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে। নরকে শাস্তির জন্য বাঙালিদের রৌরবে যাওয়া লাগতাে না। এ দেশই তাদের জন্য হয়ে উঠেছিলাে নরক। রাজসভায় আদর পেতেন সংস্কৃতের পণ্ডিত ও কবিরা। এ দেশে প্রধান পণ্ডিত তখন হলায়ূধ। লক্ষণ সেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ছিলেন পুরােষতম, পশুপতি, ঈষাণ প্রমুখ। তাঁরা বাংলাকে করতেন ঘৃণা, এর বিরুদ্ধে দেখাতেন পাণ্ডিত্য। এ দেশে প্রধান কবি তখন ধােয়া, শরণ, গােবরধন, উমাপতি প্রমুখ। তাঁরা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতেন না। লিখতেন সংস্কৃতে। কবিতার ছত্রে ছত্রে থাকতাে বাংলার প্রতি বিদ্বেষ ও তাচ্ছিল্য। হিন্দু গণস্তরে এর প্রভাব পড়ে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূলে। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন, আর্যদের পদানত এই ভূখণ্ডের ততকালীন অধিবাসীরা তাদের মুখের ভাষা ভুলে যেতে বাধ্য হয়।


বাংলার সেরা সন্তানরা এ দেশে থাকতে পারতেন না। তাঁরা ছিলেন বৌদ্ধ, কথা বলতেন বাংলায়। তাঁদের পালাতে হতাে। প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা যেতেন বার্মায়, তিব্বতে, নেপালে। নির্বাসিত হয়েও তারা রক্ষা করতেন এ মাটির সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য। এরই ফলে নেপালে পাওয়া সম্ভব হয়েছে বাংলা সাহিত্যের আদিনিদর্শন। চর্যাপদ। এ দেশে যতাে নিদর্শন থাকার কথা, কোনাে কিছুই থাকেনি। থাকতে দেয়া হয়নি। বাংলা ভাষায় লিখলে হাত নিরাপদ ছিলাে না। বললে নিরাপদ ছিলাে না জিহ্বা। আর্যদের হাতে বাংলা ভাষা ও বঙ্গীয় জীবনে নেমে এলাে মৃত্যুদশা। অনেক আগ থেকেই বাংলার আর্তনাদ উচ্চারিত হচ্ছিলাে লুইপাদের মতাে কবিদের কণ্ঠে-দুখেতে নিচিত মরি সই। আর তখনই...


তখনই প্রতাপশালী রাজা লক্ষণ সেনের দুঃশাসনের মাথা গুড়িয়ে দিলেন বঙ্গবিজয়ী বীর বখতিয়ার খিলজি। ১২০৩ মতান্তরে ১২০৪ সালে তাঁর বঙ্গজয়ের ফলে অবসান ঘটে আর্যশাসনের, ব্রাহ্মণ্যবাদী দুর্যোগের। এক ফোঁটা রক্তও এ জন্য ঝরেনি এ দেশে। সূচিত হয় নতুন দিন। রক্ত ও শ্রেণীগত বর্ণবাদের পরাজয় হলাে। ঘােষিত হলাে সাম্য ও মানবতার জয়বার্তা। ইসলামের একত্ববাদ, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কল্যাণকামিতা এদেশের মানুষকে বিশেষভাবে সেবাধর্মিতা, সকল করে আকর্ষিত। ইসলামের প্রচারকরা মানবপ্রেম ও মানবমর্যাদার বাণী নিয়ে নতুন উদ্যমে ছড়িয়ে পড়লেন চারদিকে। এ বাণী বহুকাল ধরেশুনে আসছিলাে এই মাটি, এই মানুষ। এ বাণী নিয়ে ৬১৭ সালে এসেছিলেন মহান সাহাবি আবু ওয়াক্কাস, মালিক ইবনে ওহাব, কায়েস ইবনে হুজাইফা, উরওয়া ইবনুল আছাছা, আবু কায়স ইবনুল হারিস রা.। ৬৪৬ সালে এসেছিলেন মহান তাবেয়ি মুহাম্মদ মামুন ও মুহাম্মদ মােহাইমিন রহ.। ৮৭৪ সালে এসেছিলেন মহান আওলিয়া বায়েজিদ বােস্তামি, মাহমুদ মাহি সওয়ার, বদর শাহ রহ.। এ দেশের মানুষের কাছে ইসলামের বাণী তখন নতুন কিছু নয়। 


তারা শত শত বছর ধরে ইসলামের জীবন্ত রূপ দেখে আসছে প্রচারকদের জীবনে। উত্তম চরিত্রে মানুষ দেখতে পায় ইসলামকে। মাহাত্ম্য, মহৎ আচার-আচরণ ও মানবতার জন্য তাঁদের আত্মনিবেদনে জনগণ বুঝে নেয় ইসলামের কল্যাণী ভূমিকা। তাদের হৃদয়ের দরােজা খােলে দেয় ইসলামের জন্য।


বখতিয়ার খিলজি যখন বিনাযুদ্ধে এ দেশ জয় করেন, তখন ইসলাম কোনাে বহিরাগত ধর্ম নয় এখানে। শত শত বছর ধরে এই আলাে, এই বায়ু, এই নদী ও বিহঙ্গের মতােই ইসলাম জনগণের আত্মীয় ও প্রতিবেশী। গণমনে ইসলাম আগ থেকেই বিজয়ের জমি তৈরি করে রেখেছিলাে। বখতিয়ারের জয় তাই আকস্মিক কিছু ছিলাে না। ইসলামের প্রচারক সুফি-দরবেশরা এই মাটি ও মানুষকে দিতেন ভালােবাসা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জানাতেন সম্মান। নিজেদের ভাষা পরিহার করে শিখতেন বাংলা ভাষা। কথা বলতেন বাংলায়। নিবাস গড়ে নিতেন এখানে। হয়ে যেতেন বাঙালি। সাধক-দরবেশদের কর্মপন্থাই অবলম্বন করলেন মুসলিম শাসকগণ। তারা এই দেশ ও জনগণকে করে নিলেন আপন, দিলেন সেবা, ভালােবাসা, শ্রদ্ধা। তাঁরা বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত বাংলাকে করলেন একত্রিত। বঙ্গ, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, সমতট, বাঙ্গাল, প্রজা, বরেন্দ্রী, রাঢ়, সুম্ম, বজ্রভূমি, তাম্রলিপি, গৌড় প্রভৃতি জনপদকে প্রথমবারের মতাে একত্রিত করে গড় তােলেন ঐক্যবদ্ধ বাংলা। শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা বাংলার সকল জনপদকে একত্রিত করতে চেয়েছিল গৌড় নাম। অবজ্ঞা অবহেলার কারনে তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেই কাজটিই সফলভাবে সম্পন্ন করেন মুসলিম শাসকরা। মুসলিমরাই ছিলেন বাংলা নামের একটি দেশের রুপকার ও প্রতিষ্ঠাতা। তাদের সেই বাংলা থেকেই আজকের বাংলাদেশের জন্ম। 


তথ্যসূত্রঃ শতাব্দীর চিঠি / মুসা আল হাফিজ

Previous Post Next Post