উসমান গাজী : উসমানী সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা

ঘােড়াটা দুরস্ত বেগে ছুটছে।


দুই পা দিয়ে শক্ত করে ঘােড়াটার পিঠে সেটে আছে এক সুদর্শন তরুণ। তরুণের হাতে ধরা ছােটো একটা বাঁকানাে ধনুক। দু পায়ের গােড়ালি দিয়ে সে নিয়ন্ত্রণ করছে ঘােড়ার গতিপথ। গােড়ালির ভেতরের দিকটা দিয়ে ঘােড়ার পেটের একেক জায়গায় একেকভাবে চাপ দিলে ঘােড়া সেভাবে দিক বদলায়।


ছেলেটির চোখ এই মুহূর্তে সামনের দিকে না, পেছনে। দূরের একটা গাছে দারুণ একটা বেদানা দেখেছে সে, এই বেদানাটা তার খাওয়া চাই, অবশ্যই গাছে না ওঠে। ওঘুজের হাতে তির থাকতে ওঘুজ গাছে উঠে কী করবে?


তরুণ ঠিক করল ঘােড়াটাকে সােজা গাছের দিকে না ছুটিয়ে উলটোদিকে ছােটাবে। সােজা ছুটিয়ে তির তাে বাচ্চারাও লাগাতে পারে, তাতে আর বাহাদুরির কী আছে? ঘােড়ার পেটে চাপ দিয়ে তরুণ ঘােড়ার বেগ আরও বাড়িয়ে দিলাে। প্রায় দুইশাে কদম এসে ঘােড়াটা যখন শুনে্য লাফিয়ে ওঠল, ঠিক তখন সে ধনুকের ছিলা টেনে দিলাে।  


বেদানাটার বােটা ভাল থেকে আলাদা হয়ে নিচে পড়ল। গাছের নিচে গিয়ে বেদানাটা তুলে নিল তরুণ। পাগড়ি খুলে ফেলে নিশ্চিত্তে খেতে শুরু করল সে। তার কুচকুচে কালাে চুল বলমল করে উড়ছিল আনাতােলিয়ার পাহাড় থেকে আসা বাতাসে।


এই ছেলেটার নাম উসমান। উসমান বিন আরতুরুল।


ছুটন্ত ঘােড়ার পিঠে থেকে তির ছােড়া (কাবাক খেলা) তার প্রিয় খেলা। তার আরেকটা প্রিয় খেলা আছে, মঙ্গোলিয়ান কুস্তি।


ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজী

বাগদাদের দেয়াল ভেঙে যেবার হালাকু খানের সৈন্যরা চুকে পড়েছিল, সেই বছরের শীতেই আনাতােলিয়ার উত্তর-পশ্চিমে সােগুত নামের ছােটো এক শহরে কায়ি গােত্রের বে আরতুরুণ গাজির ঘরে এক ফুটফুটে বাচ্চার জন্ম হয়।


বাচ্চটার নাম রাখা হয় উসমান, উসমান মানে হাড় গুড়িয়ে দেওয়া পালােয়ান। উসমানের মা ছিলেন এক সেলজুক শাহজাদি হালিমা সুপতান। তার বাবা অবশ্য সুলতান হতে পারেননি। ওঘুজ মেয়েদের কাছে স্বামীই সব। সেলজুক প্রাসাদের ঐশ্বর্য ছেড়ে স্বামীর আধা যাযাবর কায়ি গােত্রের শিবিরে বউ হয়ে আসা হালিমা নাম থেকে সুলতান শব্দটাই বাদ দিয়েছিলেন। তার বদলে তিনি আর দশজন কায়ি মহিলার মতাে হালিমা খাতুন নামেই পরিচিত হতে পছন্দ করতেন।


আরতুরুলের বেইলিকটা ছিল ছােটো কিন্তু ভিনি ছিলেন দুর্বর এক যােদ্ধা। মােঙ্গল আক্রমণ এড়িয়ে আনাতােলিয়ায় আসার পর সুলতান আলাউদ্দিনকে সহযােগিতা করে জায়গির হিসেবে প্রথমে কারাজা দাঘ পর্বতের কাছে কিছু জমি পান আরতুরুল বে। তারপর সেখান থেকে তাকে সুলতান আলাউদ্দিন পাঠান সেলজুকদের সীমান্তের একেবারে পাশ্চিমে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে লাগােয়া সােগুতে ধীরে ধীরে বড়াে হতে লাগলেন উসমান। সেইসঙ্গে বড়াে হতে লাগল আরতুরুল বে আর হালিমা সুলতানের ছােটো বেইলিকটাও।


আরতুরুল বে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রিয় বন্ধু দরবেশ এদেব আলির বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। সঙ্গে নিয়ে যাবেন হালিমা খাতুন আর উসমানকে। এক বৃহস্পতিবার দুপুরে রওনা দিয়ে বিকেল নাগাদ বন্ধুর বাড়িতে পৌছে গেলেন তারা। সঙ্গে অল্প কয়েকজন আলপ। 


এদেব আলি একজন বিখ্যাত আলেম ও দরবেশ। তার অসংখ্য গুণগ্রাহীর মধ্যে আরতুরুল বে নিজেও একজন। রাতে আরতুরুল বের সম্মানে এক ভােজের আয়ােজন করলেন এদেব আলি। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানাের জন্য যখন সবাই যার যার কামরায় গেলেন। নিজের শােওয়ার ঘরে ঢুকে উসমান খেয়াল করলেন, দেয়ালের তাকে পবিত্র কুরআন শরিফ রাখা। কুরআন শরিফ ঘরে থাকা অবস্থায় শুয়ে পড়া তার কাছে বেয়াদবি বলে মনে হলাে। আল্লাহর কালামকে সম্মান দেখানাের জন্য তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন, ভাবলেন সারা রাত ঘুমাবেন না। ভােরের কাছাকাছি সময়ে তার ঘুম এসে গেল। তিনি স্বপ্ন দেখলেন। অদ্ভুত এক স্বপ্ন।


শায়খ এদেব আলির বুক থেকে একটা চাঁদ ওঠল। উসমানের বুকে এসে ঠাই নিল সেই চাঁদ। তারপর তার নাভি থেকে গঞ্জিয়ে ওঠল এক বিশাল গাছ। গাছটি সুন্দর সবুজ ভালপালায় ভরে ওঠল। সময়ের সাথে সাথে গাছটি বড়াে হতে হতে পেরিয়ে যেতে লাগল চারটি পর্বতমালা; কলকান, আলবুর্জ, ককেশাস আর অ্যাটলাস। গাছের শেকড় থেকে বইতে লাগল চার চারটি নদী, দানিয়ুব, ইউফ্রেতিস, তাইগ্রিস আর নীল। গাছের পাতাগুলাে হঠাৎ রূপ নিলাে তরবারির ফলায়। তারপর হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করল কনস্ট্যান্টিনােপলের দিকে, বসন্তের বাতাস। সে বাতাসে একেকটা পাতা একেকটা তরবারি হয়ে উড়ে যেতে লাগল কনস্ট্যান্টিনােপলে। দুই মহাদেশ আর দুই সমুদ্রের শহর। তারপর কনস্ট্যান্টিনােপল পরিণত হলাে একটা আংটির কেন্দ্রে। সেই আংটি উসমান যখন হাতে পরতে গেঁলেন, তখন তার ঘুম ভেঙে গেল ।


ঘুম থেকে উঠে শায়খ এদেব আলিকে এই স্বপ্নের কথা জানালেন উসমান। শায়খ এদেব আলি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে খুশিতে উচ্ছুসিত হয়ে ওঠলেন। তিনি উসমানকে বললেন, তােমাকে আল্লাহ বাদশাহি দান করবেন। আমার মেয়ে রাবিয়াকে তােমার সঙ্গে বিয়ে দিতে বলা হয়েছে। আমি আল্লাহর এই ফায়সালা মেনে নিলাম।


তথ্যসূত্রঃ

১. সানজাক-ই উসমান/গাজীর ঘোড়া/আরতুগ্রুল এদেব আলী ও ওসমান/পৃঃনঃ ১৪৮-১৫০

Post a Comment

Previous Post Next Post