জাহেলি যুগে নারীর অধিকার : উত্তরাধিকার আইন

জাহেলী যুগে নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। চতুষ্পদ জন্তু বা ভােগ্যপণ্যের ন্যায় তাদেরকে উত্তরাধিকার সম্পদ রূপে গণ্য করা হত। এমনকি পুরুষদের জন্য এমন কিছু খাবার নির্দিষ্ট ছিল, যা নারীদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। সে সময় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করাকে অবমাননাকর মনে করা হত এবং তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হত। মহান আল্লাহ বলেন,

 

তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালাে হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগােপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে দিবে (নাহল ৫৮-৫৯)। 


অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

'যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল' (তাকভীর ৮-৯)।


শুধু তাই নয়, জাহেলী যুগে নারীরা মীরাছ লাভ থেকে বঞ্চিত হত। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,


জাহেলী যুগের লােকেরা নারী ও শিশুদেরকে উত্তরাধিকারী করত না। এমনকি শিশু পুত্রসন্তান হলেও। তারা বলত, মীরাছ কেবল তাকেই দেওয়া হবে যে অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করে যুদ্ধ করে, বর্শা দ্বারা আঘাত করে, তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করে এবং গনীমত লাভ করে'।


জাহেলি যুগে নারীর অধিকার : উত্তরাধিকার আইন

মুফাসসির আব্দুর রহমান ইবনে নাছির আস-সাদী (রহঃ) বলেন,  


শক্তিমত্তা ও নির্দয়তার কারণে জাহেলী যুগের আরবরা দুর্বলদেরকে তাদের উত্তরাধিকারী করত না। যেমন নারী ও শিশু। তারা বীর পুরুষদের জন্য মীরাছ নির্ধারণ করত। কারণ তাদের ধারণা অনুযায়ী পুরুষরাই যুদ্ধ- বিগ্রহ এবং লুণ্ঠন করার যােগ্য। মােদ্দাকথা, জাহেলী যুগে উত্তরাধিকার লাভের মানদণ্ড ছিল পৌরুষ ও শক্তি-সামর্থ্য।


জাহেলী যুগে উত্তরাধিকার লাভের তিনটি মাধ্যম ছিল। ১. আত্মীয়তার সম্পর্ক ২. পালকপুত্র হওয়া ও ৩. চুক্তি


১. আত্মীয়তার সম্পর্ক :


জাহেলী যুগে আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে মীরাছ লাভ করা যেত। কিন্তু বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার পরেও মা, কন্যা, বােন, শিশু ও বৃদ্ধরা মূতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হত। কারণ এদের মধ্যে শত্ৰুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি-সামর্থ্য ছিল না এবং তারা কোনভাবেই স্বীয় গােত্রের প্রতিরক্ষায় কাজে লাগত না। যুবক ও বীরযােদ্ধারাই কেবল মূতের ওয়ারিছ হত। ইসলামের প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত এ নিয়মই বলবৎ ছিল। অতঃপর সূরা নিসার ১১নং আয়াত নাযিলের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে।


২. পালকপুত্র হওয়া :


জাহেলী আরবদের মধ্যে অন্যের পুত্রকে নিজের পুত্র হিসাবে গ্রহণ করার রীতি প্রচলিত ছিল। পালকপুত্র পালক পিতার দিকেই সম্পর্কিত হত এবং তার সম্পত্তির ওয়ারিছ হত। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, 


জাহেলী যুগে কারাে দৃঢ়তা ও বুদ্ধিমত্তা যখন কোন ব্যক্তিকে মুগ্ধ করত, তখন সে তাকে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে নিত (পালকপুত্র বানিয়ে নিত) এবং তার মীরাছ থেকে তার পুত্র সন্তানদের মতাে তার (পালকপুত্র) জন্য মীরাছ নির্ধারণ করত। আর তাকে তার দিকে সম্পর্কিত করে বলা হত, অমুকের ছেলে অমুক। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নবুঅত লাভের পূর্বে যায়েদ বিন হারেছাকে আযাদ করে নিজের পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। তাকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ নামে ডাকা হত। ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলােতে এ রীতি বিদ্যমান ছিল।


অতঃপর সূরা আহযাবের ৪ ও ৫ নং আয়াত অবতীর্ণ করে এ বিধান মানসূখ বা রহিত করা হয়েছে।

৩. চুক্তি :


জাহেলী যুগে চুক্তির মাধ্যমে একজন অন্যজনের ওয়ারিছ হত। তারা আমার রক্ত তােমার রক্ত এবং আমার মৃত্যু তােমার মৃত্যুর মতাে। তুমি আমার ওয়ারিছ হবে এবং আমি তােমার ওয়ারিছ হব। তুমি আমার (সম্পদের) প্রত্যাশা করবে এবং আমি তােমার (সম্পদের) প্রত্যাশা করব।  


চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর একজনের মৃত্যু হলে অন্যজন তার সম্পত্তির অংশ বা  মীরাছ লাভ করত। পরবর্তীতে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াত নাজিল হওয়ার পর চুক্তির মাধ্যমে ওয়ারিছ হওয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে।



রেফারেন্সঃ

১. কুরআনুল কারিম

২. আস-সীরাতুন নাবাবিইয়াহ / আবুল হাসান নদবী রহিমাহুল্লাহ 

৩. তাফসীরে কুরতুবি, পঞ্চম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩১

৪. তাফসীরে কারিমুর রহমান ফি তাফসীরে কালামিল মান্নান, আব্দুর রহমান ইবনে নাসির আস-সাদী।

৫. ইসলাম কা কুনুনে ওরাসাত, পৃষ্ঠা নং ৩৫-৩৭

৬. তাফসির ইবনে কাছীর 


Previous Post Next Post