উপনিবেশবাদ : গরম মসলার ইতিবৃত্ত

উপনিবেশবাদ কীভাবে শুরু হলাে, কী করে ইউরোপিয়ানরা ছড়িয়ে পড়ল সারা দুনিয়ায়- তা জানতে আমাদের চলে যেতে হবে পঞ্চদশ শতাব্দীর দুনিয়াতে। তখন স্থলে গান পাউডার আর জলে মসলার রাজত্ব।


আপনি আমি মাংসের সঙ্গে যে গরম মসলার স্বাদ পাই, সেই গরম মসলার দাম এক সময় স্বর্ণের চেয়ে বেশি ছিল। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। সােনার চেয়ে দামি ছিল লবঙ্গ, দারুচিনি, গােলমরিচ, জায়ফল, হলুদ, আদা আর এলাচি। গরম মসলা জন্মাতে প্রয়ােজন হয় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা এবং ৮০%-এর কাছাকাছি আর্দ্রতা। এই তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ইউরােপে কোনাে দিনই ছিল না। ফলে ইউরােপের মানুষ মসলা কী, তা মােটামুটিভাবে জানতই না। তারা প্রথম মসলার ব্যবহার শেখে মাত্র তিন হাজার বছর আগে, লেবানিজদের কাছ থেকে। এই যে তারা মসলার প্রেমে পড়ল, আর কোনাে দিন তারা এই প্রেম থেকে বেরােতে পারেনি।


মসলার কদর তাদের কাছে কতখানি ছিল তার একটা উদাহরণ হলোে, ভিসিগথরা ৪১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন রােম অবরােধ করে, তখন তারা সােনা-রূপা চাওয়ার বদলে রােম অবরােধ তুলে নেওয়ার বিনিময়ে সম্রাটের কাছে তিন হাজার পাউন্ড গােলমরিচ চেয়েছিল। রােমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র ক্ষমতার একটা বড়াে উৎস ছিল এই মসলার বাণিজ্যপথের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ।


তখনকার দুনিয়ার সবচেয়ে বড়াে বাণিজ্য ছিল মসলা। তাই এই বাণিজ্য পথ যারা নিয়ন্ত্রণ করত, বিশ্ব অর্থনীতির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকত তাদেরই কবজায়। ভারতের কেরালা, মালাবার, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, আচেহ, বালি, জাভা, তিমুর, নিউগিনিতে ছিল মসলার খনি। এই অল্প কিছু জায়গা ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও তখন গরম মসলা চাষ হতাে না। যখন এসব জায়গার লােকজন টের পেয়ে গেল যে মসলা বেশ দামি জিনিস, তখন তারা মসলা ফলানোর রেসিপিটা রাতারাতি গুম করে দিলাে। ফলে ভারতীয় বণিকরা এসব দ্বীপ থেকে মসলা জাহাজে ভাসিয়ে নিয়ে যেত মালাক্কা প্রণালি হয়ে উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ড সেখান থেকে আরব বণিকেরা মসলার কাফেলা নিয়ে রওনা হতাে পশ্চিমে। পর্যন্ত জাহাজগুলাে চলাচল করত শ্রীলঙ্কা, গুজরাট, করাচি, হরমুজ প্রণালি হয়ে বাবেল মান্দেব প্রণালি হয়ে এডেন, আলেকজান্দ্রিয় হয়ে সিরিয়া, লেবানন, আনাতােলিয়া হয়ে রােমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। পূর্বে কনস্ট্যান্টিনাপল, পশ্চিমে রােম।

গরম মসলার ইতিহাস। উপনিবেশিক যুগ। ঔপনিবেশবাদ কি৷ উপনিবেশিক
ঔপনিবেশবাদ গরম মসলার ইতিবৃত্ত 

আরেকটা বাণিজ্যপথ আছে, সেটা আরও বিখ্যাত। ইতিহাস পড়াশােনা করেছেন কিন্তু সিল্করোডের নাম শােনেননি, এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গােনা। সিন্করােড ছিল ভারত-চীন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চলে যাওয়া বাণিজ্যপথ। প্রাচীনকালে এই পথ নিয়ন্ত্রণ করতেন রােমান সম্রাট। ইসলাম তার অভ্যুদয়ের ত্রিশ বছরের মধ্যে সিন্ক রােডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে জলে-স্থলে মসলার ব্যবসাটা চলে যায় আরব মুসলিমদের হাতে। সম্ভবত আলিফ লায়লার সিন্দাবাদ এই মসলা ব্যবসায়ীদেরই একজন ছিলেন। মুহাম্মাদ আল ফাতিহ যখন কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করে নিলেন, তখন এই দুটো বাণিজ্যপথ সরাসরি ব্লকড হয়ে গেল। কনস্ট্যান্টিনােপল/ইসলামবুল থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যেত সিন্করােডের প্রবেশপথ। আর অবশ্যই ভূমধ্যসাগর থেকে লােহিত সাগরে প্রবেশের লাইসেন্সটাও ছিল কনস্ট্যান্টিনােপল ইসলামবুলের মালিকের একচেটিয়া দখলে।


ফলে মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে দুনিয়ার এক নম্বর ব্যবসাটা মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে এলাে। সমুদ্রপথে মসলার বাণিজ্যের ওপর মুহাম্মাদ আল ফাতিহ উঁচুদরের ট্যাক্স বসিয়ে দিলেন। ফলে ইউরােপের রাজ-রাজড়ার ডাইনিং টেবিলে মসলার আমদানি কমে গেল। মসলার দাম শেষে এত বাড়ল যে, এক পাউন্ড জায়ফল কিনতে তখন সাত সাতটা মােটাতাজা ষাঁড়ের প্রয়ােজন হতাে।


এই পরিমাণ দামে মসলা কেনা খুবই কঠিন হয়ে যেতে থাকল ইউরােপের মানুষের জন্য। ইউরােপের ব্যবসায়ীরা কড়া করে ধরলেন কিং-কুইন-মনার্কদের। কিন্তু কোনাে কাজ হচ্ছিল না। মুহাম্মাদ আল ফাতিহর সঙ্গে যুদ্ধ করার মতাে সাহস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা বিকল্প বাণিজ্যপথ বের করার কথা ভাবতে লাগলেন। সেই পথ বড়াে কঠিন পথ। সমগ্র আফ্রিকার পশ্চিম-দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল ঘুরে গিয়ে ভারত মহাসাগরে পাল তােলার পথ। ইউরােপিয়ান সম্রাটদের স্পন্সরশিপে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগলেন দুঃসাহসী নাবিকেরা।


কলম্বাস, অ্যামেরিগাে ভেসপুচি, ক্যাব্রালদের মতাে বেপরােয়া নাবিকরা মসলার দ্বীপে পৌছানাের জন্য জান বাজি রেখে বেরিয়ে পড়লেন। শুরু হলাে দি এজ অফ ডিসকভারির। পরের তিনশাে বছর ইউরোপের সিবাের্ড নেশনগুলাে যুদ্ধ করেছে এই মসলার ব্যবসার একচেটিয়া দখল নিয়ে। যােড়ােশ শতাব্দীর অটোমান-পর্তুগিজ ওয়ার, অটোমান-ভেনেশিয়ান ওয়ার, স্প্যানিশ-পর্তুগিজ ওয়ারের মূল কারণ ছিল লবঙ্গ ব্যবসা নিয়ে বিবাদ। সেভেন্টিস্থ সেঞ্চুরিতে ব্রিটিশ-স্প্যানিশ ওয়ার, ডাচ-ব্রিটিশ ওয়ারের মূলে ছিল গােলমরিচের ব্যবসা।


গরম মসলার গরম, একটা সময় সােনার চেয়েও বেশি ছিল।


আধুনিক উপনিবেশবাদের জন্মদাতা যদি রেনেসাঁ হয়, তবে জননী অবশ্যই গরম মসলা।



তথ্যসূত্রঃ

সানজাক-ই উসমান / মসলা

أحدث أقدم