মোঙ্গল ঘোড়াগুলো কেমন ছিল : চেঙ্গিস খানের অল ওয়েদার ভেহিকল

একটা অল ওয়েদার ভেহিকলের কথা ভাবুন, যা শূন্যের নিচে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে শূন্যের ওপরে চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত আরামসে পথ চলতে পারে। যা চালাতে আপনি পথে যা কুড়িয়ে পান তা দিয়েই জ্বালানীর কাজ হয়ে যায়, আবার নিজের ওজনের সমান ভার সারাক্ষণই বহন করতে পারে। যার আলাদা কানাে দেখাশােনার দরকার পড়ে না এবং যা আপনাকে খাবার, পানীয় দুটোই দিতে পারে। সেইসঙ্গে সেটার বিভিন্ন অংশ দিয়ে আপনি পোশাক, থাকার জায়গা আর অস্ত্র তৈরি করতে পারেন। এমন কোনাে জাদুকরি বাহন কি আসলেই আছে? মােঙ্গলদের ছিল, আর তা ছিল মােঙ্গল ঘােড়া। 


এই ঘােড়াগুলাে আরবি বা তুর্কি ঘােড়ার চেয়ে আকারে অনেক ছােটো। মঙ্গোলিয়ার কঠিন, রুক্ষ আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় টিকে থাকার জন্য এই আকারে ছােটো হওয়াটা খুবই প্রয়ােজন। মােঙ্গল ঘােড়া প্রতি শীত ও বসন্তে নিজেদের শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশ ওজন হারায়। কারণ, এ সময় তারা খুব সামান্য খাবার খেয়েই টিকে থাকে। এই ওজন তারা গ্রীষ্মে জন্মানাে তাজা ঘাস খেয়ে আবার পূরণ করে ফেলে। শীতের মধ্যে চলতে পারার কারণে যেখানে মধ্যযুগের যেকোনাে বাহিনী শীতকালে চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হতাে, সেখানে মােঙ্গলরা ছুটে বেড়াত প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও ৪ প্রতিটি মােঙ্গল সৈনিকের সঙ্গে তিন থেকে পাঁচটা ঘােড়া থাকত। কোনাে একটা ঘােড়া ক্লান্ত হয়ে গেলে তারা সাথে সাথেই ঘােড়া বদলে ফেলত। এভাবে পালা করে চার পাঁচটা ঘােড়ায় চড়ত বলে তারা অনায়াসে কোথাও না থেমেই পার হয়ে যেত, বিশাল দূরত্ব। একজন মােঙ্গল সওয়ার দৈনিক একশাে বিশ মাইল পথ পাড়ি দিত, যা সেই সময়ের মানুষের কাছে ছিল অকল্পনীয়।


মোঙ্গল বাহিনীর ক্ষিপ্র ঘোড়া। মোঙ্গল ঘোড়ার বৈশিষ্ট্য
মোঙ্গল ঘোড়া

এই ঘােড়াগুলাে ছােটোবেলা থেকেই বেড়ে উঠত মােঙ্গল স্তেপে, যেখানে ঘাস ছাড়া খাওয়ার আর তেমন কিছুই নেই। এদের আলাদাভাবে কোনাে যত্ন নেওয়ার প্রয়ােজন হতাে না। আকারে ছােটা হওয়াতে খাবার লাগত তুলনামূলকভাবে কম। এরা পানি খেতাে খুবই কম, দিনে তিন থেকে চারবার মাত্র। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে এরা বরফের গুড়াে খেয়ে টিকে থাকতে পারে। অন্যান্য জাতের চেয়ে এদের স্ট্যামিনাও হয় বেশি। একটা ২৫০ কেজি ওজনের মোঙ্গল ঘােড়া পিঠে ৩০০ কেজি ওজন নিয়ে দিনে ৬০ কিলােমিটার পথ চলতে পারে ক্লান্তি ছাড়াই। আর একজন সওয়ার নিয়ে ৬০ কিলােমিটার রেসে হারিয়ে দিতে পারে অন্য সব ঘােড়াকে।


মােঙ্গলদের প্রধান খাবার ছিল ঘােড়ার মাংস, বার্লি আর ঘােড়ার দুধ। তাদের জাতীয় পানীয় হলাে ঘােড়ার দুধ দিয়ে বানানাে এক রকম অ্যালকোহল, আইরাগ। তাদের সবার কাছেই থাকত এক বড়াে ব্যাগ ভরা বাের্ট, (শুকনাে ভেড়ার মাংসের গুড়াে) যা তাদের জন্য দূরপাল্লার যাত্রায় দিনের পর দিন খাবারের যােগান দিত। শুকনাে অবস্থায় বা স্যুপ হিসেবে খাওয়ার জন্য এটা ছিল খুবই কার্যকর একটি খাবার। প্রচণ্ড খাদ্যাভাবের সময় ঘােড়ার শিরা কেটে রক্ত পান করে বেঁচে থাকত মাঙ্গলরা। শুধু ঘােড়ার দুধ আর রক্ত পান করেই তারা টিকে থাকতে পারত পুরাে এক মাস। এমন একটা বাহিনীর জন্য লজিস্টিক সাপ্লাইয়ের কোনাে দরকার পড়ত না। তাদের শুধু একটা জিনিসই খেয়াল রাখতে হতোে, চলার পথে যেন ঘােড়াদের খাওয়ার জন্য প্রচুর ঘাস থাকে। এই সুবিধাগুলাে মােঙ্গল সেনাবাহিনীকে পরিণত করেছিল তার সময়ের চেয়ে কয়েকশাে বছর এগিয়ে থাকা এক যুদ্ধের মেশিনে।


সংখ্যা, শক্তি বা প্রযুক্তির চেয়ে মােঙ্গলরা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল মানসিকতায়। অসভ্য এক সমাজে বেড়ে ওঠায় তারা ছিল অন্য যেকোনাে জাতির তুলনায় ভয়ডরহীন। নিজেদের যাযাবর ঐতিহ্য তাদের দিয়েছিল অবিরাম শত শত কিলোেমিটার পথ চলার সামর্থ্য আর শিকারকে ধাওয়া করার প্রবৃত্তি। সেইসঙ্গে, তাদের নেতা ছিলেন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সর্বকালের সেরা জেনারেল, চেঙ্গিজ খান।

Previous Post Next Post