মোঙ্গল বাহিনীর যুদ্ধ কৌশল : বর্বর মোঙ্গল বাহিনী

প্রতিটি মােঙ্গল পুরুষ তার জন্মানাের দিন থেকেই যোদ্ধা, আর মেয়েরা যুদ্ধের সহযােগী। মাত্র তিন বছর বয়সে মােঙ্গল শিশুদের ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হতাে। তারপর ঘােড়াকে ছােটানাে হতাে পূর্ণ গতিতে। ছয় বছর বয়স নাগাদ এই শিশুরা নিজেরাই পুরােদস্তুর সওয়ার হয়ে উঠিত। দশ বছর বয়সের মধ্যে তারা শিখে যেত তিরন্দাজি। যে পুরুষ তির চালাতে আর ঘোেড়ায় চড়তে না জানত, মােঙ্গলদের সমাজে তার পক্ষে বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব।


মেয়েরাও সমান তালে ঘােড়ায় চড়তে জানত, জানত তির চালাতে। মােঙ্গলরা সওয়ার হিসেবে এতই দক্ষ ছিল যে, তারা পূর্ণ বেগে চলা ঘােড়ার ওপর থেকে নিখুঁতভাবে তির চালাতে পারত। তারা যেকোনাে সময় ঘাড়ার পিঠ থেকে একদিকে কাত হয়ে ঘােড়ার পেটের সঙ্গে লেগে থাকতে পারত। তির চালাত ঠিক তখন, যখন ঘােড়ার চার পা মাটি থেকে শূন্যে থাকত। এতে তিরের নিশানা থাকত নিখুঁত। এমনকী তারা উলটো দিকে ফিরেও একই দক্ষতায় তির চালাতে পারত।


ঘোড়ার উপর ঈগল হাতে চেঙ্গিস খান। তাতার মোঙ্গল বাহিনীর যুদ্ধ কৌশল।
চেঙ্গিস খান 

তাদের ধনুকের পাল্লা ছিল প্রায় দুইশাে থেকে সাড়ে তিনশাে মিটার। চীনাদের ধনুকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এই পাল্লার কারণে তারা অনেক অনেক দূর থেকেই শত্রুকে ঘায়েল করতে সক্ষম ছিল।


তিরন্দাজিতে মােঙ্গলদের সেরা অস্ত্র ছিল পার্থিয়ান শট নামের দূর্দান্ত এক কৌশল। শত্রুর সামনে থেকে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালানাের ভান করে তারা ঘােড়া উলটোদিকে ঘুরিয়ে পালানাের ভান করত। ফলে শত্রুরা স্বভাবতই তাদের পিছু নিত। পালানাের ভান করা অবস্থাতেই হঠাৎ ছুটন্ত ঘােড়া থেকে পেছন ফিরে তির মেরে তারা শত্রুর বুক এফোড়ওফোঁড় করে দিত, আর এই ফাঁদে একবার পড়ে গেলে বেঁচে ফেরা যে কারও জন্যই কঠিন হয়ে যেত।


যুদ্ধের ময়দানে তাই মােঙ্গলরা খুব কমই শত্রুর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যেত। তারা শত্রুকে গায়ের জোরে নয়, বুদ্ধির খেলাতে হারিয়ে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে আসত, যেন যুদ্ধ শুরুর আগেই শত্রুর পরাজয় হয়ে ওঠে অবধারিত। 


চেঙ্গিজ খান কখনােই এমন কোনাে যুদ্ধে জড়াতেন না, যেখানে তিনি জিততে পারবেন না। এসব ক্ষেত্রে তিনি স্রেফ যুদ্ধ এড়িয়ে যেতেন। শত্রুর হাড়ির খবর রাখতে যুদ্ধের কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগেই তিনি প্রচুর গােয়েন্দা নিয়ােগ করতেন। বড়াে যুদ্ধগুলােয় চেঙ্গিজ খানের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ, তিনি শত্ৰুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতেন। তাই তার পক্ষে শত্রুর পরবর্তী চাল আন্দাজ করা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। তার গােয়েন্দারা প্রায়ই শত্রুবাহিনীর ভেতরে যারা কমান্ডার কিংবা সম্রাটের বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছে, তাদের চিহ্নিত করত এবং সুযােগ বুঝে তাদের দলে ভিড়িয়ে নিত। মােঙ্গলরা লড়াইয়ের সময় সাধারণত তাদের দুরন্ত ক্যাভালরি নিয়ে শত্রুর যেকোনাে একটা ফ্ল্যাঙ্ক, কখনাে দুই ফ্ল্যাঙ্কই ভেঙে ফেলত। এটা ছিল তাদের প্রাইমারি ট্যাকটিক্স।


এতে কাজ না হলে তারা অনেক সময় একটা দুর্বল বাহিনী পাঠিয়ে শত্রুকে লড়াইয়ে নামতে উদ্বুদ্ধ করত। মূল বাহিনী লুকিয়ে থাকত চতুর্দিকে। লড়াই শুরুর পর তারা শত্রুকে হঠাৎ ঘিরে ফেলত সবদিক থেকে। এই অবস্থায় সাধারণত কোনাে বীর সেনাপতি জীবন বাজি রেখে শত্রুকে আক্রমণ করেন। সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হতে পারত অনেক বেশি। এই ক্ষয়ক্ষতি কমানাের জন্য মােঙ্গলরা পালানাের একটা পথ রেখে দিত শত্রুর একেবারে সামনেই। ফলে শত্ৰু চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে লড়াই করার ঝুঁকি না নিয়ে ওই পথ দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাত। কিন্তু এখানেই শেষ ছিল না। ওই পথের শেষের দিকে তৈরি হয়ে থাকত লুকিয়ে থাকা মােঙ্গল তিরন্দাজের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে তির মেরে তারা পালাতে থাকা শত্রুদের মেরে সাফ করে ফেলত। এসবের সাথে সাথে মােঙ্গল বাহিনী কঠোর পরিশ্রম করে শিখেছিল যুদ্ধ কৌশলের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ট্যাকটিক্সগুলাের একটা, ফেইন্ড রিট্রিট বা ছদ্ম পলায়ন।


লড়াই করতে করতে হঠাৎ একটা সময়ে পুরাে মােঙ্গল বাহিনী পিছু হটে পালানাের অভিনয় করত। এতে শত্রুসেনাদের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যেত। তারা মহা সমারােহে মােঙ্গলদের ওপর ঝঁপিয়ে পড়ত। এভাবে শত্রুদের নিজেদের পছন্দমতাে জায়গায় নিয়ে এসে তারা ঝঁপিয়ে পড়ত শত্ৰুদের ওপর, শুরু হতাে হত্যাযজ্ঞ। ঘন সন্নিবিষ্ট ব্যাটল ফরমেশনগুলাের বিপরীতে ঝাঁকে ঝাঁকে তির মেরে তারা সেগুলাে ভেঙে ফেলত। মােঙ্গলদের শক্তিশালী তির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চামড়ার বর্ম ভেদ করে ফেলত। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ধাতব বর্মও। ফরমেশন ভেঙে পাতলা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হতাে হেভি ক্যাভালরি চার্জ। এটা ছিল মােঙ্গলদের চূড়ান্ত আঘাত।


কাতারের পর কাতার শত্রুরা লাশ হয়ে যেত এই চেইনের মতাে সাজানাে একের পর এক আক্রমণ কৌশলের পুনরাবৃত্তিতে। এই ফিল্ড স্ট্র্যাটেজিগুলাে বাস্তবায়ন করতে এক একটা বাহিনীকে হতে হয় দ্রুতগতির, কিন্তু সুশৃঙ্খল, আত্মবিশ্বাসী এবং হিসেবি। চেঙ্গিজ খান বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের বাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন নির্মম এক যুদ্ধের মেশিন হিসেবে। তিনি তার সেনাপতিদের ওপর চরম আস্থা রাখতেন। তাদেরকে তিনি দিয়েছিলেদন নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবাধ স্বাধীনতা। এতে তাদের পক্ষে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে গিয়েছিল। মােঙ্গলরা ব্যক্তিগতভাবে যােদ্ধা হিসেবে তাদের অধিকাংশ প্রতিপক্ষের চেয়েই ছিল আকারে খৰ্বকায়, শারীরিকভাবে দুর্বল আর অশিক্ষিত। 


কিন্তু তারা এগিয়ে ছিল সাহস, একতা, আর আত্মবিশ্বাসে। তারা বিশ্বাস করত তারা ঈশ্বরের মনােনীত এক জাতি, যাদের পরাজিত করা অসম্ভব। তাদের বিশ্বাস জন্মেছিল, চেঙ্গিজ খান কখনােই পরাজিত হবেন না। তাই তারা ছিল নেতার প্রতি চরমভাবে অনুগত এক জাতি। ইতালিয়ান পর্যটক জিওভান্নি লিখে গেছেন-


'The Tatars that is, the Mongols-are the most obedient people in the world in regard to their leaders, more so even than our own clergy to their superiors. They hold them in the greatest reverence and never tell them a lie'.


যুদ্ধে জিততে যে গুণগুলাে প্রয়ােজন তার সবগুলাই তাদের ভেতর পুরােমাত্রায় হাজির ছিল। কিন্তু তাদের আরও অনেক এগিয়ে দিয়েছিল তাদের সরবরাহ, কৌশল আর বাহন।



তথ্যসূত্রঃ

সানজাক-ই উসমান/ চেঙ্গিস খান

أحدث أقدم