কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় : মুহাম্মদ আল ফাতিহ

কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়। (Hagia Sofia -আয়া সোফিয়া ইস্তাম্বুল)

কনস্টান্টিনোপলের অবস্থান এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে। বর্তমানে এই শহরের নাম ইস্তাম্বুল। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। কালে কালে এই শহর হয়ে উঠে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। নানা বৈশিষ্ট্য এই শহরকে করেছিল অনন্য। বলা হতো, যদি সারা পৃথিবী একটি দেশ হয়, তাইলে কনস্টান্টিনোপল হতে পারে সেই দেশের রাজধানী।


বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে মুসলমানদের জিহাদ শুরু হলে এই শহরের প্রতি মুসলমানদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়। শুরু থেকেই তারা এই শহর দেখলের চেষ্টা চালাতে থাকে। সর্বপ্রথম ৪৪ হিজরীতে হজরত মুয়াবিয়ার শাসনকালে ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপলে অভিযান চালানো হয়। এই অভিযান ব্যর্থ হয়। পরে আরেকটি অভিযান চালানো হয়, সেটিও ব্যর্থ হয়। এই অভিযান চলাকালেই বিখ্যাত সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী ইন্তেকাল করেন। তার অসিয়ত মত তাকে শহরের প্রাচীরের কাছাকাছি স্থানে দাফন করা হয়। এই সাহাবী শুধুমাত্র ফজিলত অর্জনের জন্যই বৃদ্ধবয়সে এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। ৯৮ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা সুলাইমান বিন আব্দুল মালিকের শাসনামলে আবার কনস্টান্টিনোপলে হামলা চালানো হয়। বাইজেন্টাইনরা এই হামলাও রুখে দেয়। ১২১ হিজরীতে আবার হামলা চালানো হয়। এভাবে কনস্টান্টিনোপলে একের পর এক অভিযান চলতেই থাকে। খলিফা হারুনুর রশিদ ও সেলজুকি সুলতান মালিক শাহের শাসনামলেও কনস্টান্টিনোপলে হামলা চালানো হয়। কিন্তু এসব অভিযানের কোনোটিই সাফল্যের মুখ দেখেনি। ৭৯৬ হিজরী তথা ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বায়জিদ এই শহর অবরোধ করেন। সেবার হয়তো তিনি শহর জয় করে ফেলতেন। কিন্তু সেসময় তৈমুর লং উসমানিয়দের সীমানায় হামলা করলে সুলতান অবরোধ তুলে তৈমুর লংকে প্রতিহত করতে ছুটে যান। ৮২৫ হিজরীতে সুলতান মুরাদ আরেকটি অভিযান প্রেরণ করেন, এটিও ব্যর্থ হয়।


সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকেই কনস্টান্টিনোপল জয়ের জন্য মুসলিম যোদ্ধারা একের পর এক অভিযানে অংশ নিচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য এই শহরটি জয় করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। এই শহর জয় করতে মুসলমানদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ৮০০ বছর।


মুসলমানরা অপেক্ষা করছিল এমন এক সেনাপতির , যার দৃঢ়তার সামনে মাথা নোয়াবে এ শহর। যিনি এ শহরে উড়াবেন মুসলমানদের পতাকা। যার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে হাদিসের ভবিষ্যতবানী। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহই হলেন সেই সেনাপতি।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ। কনস্ট্যান্টিনোপল বিজেতা


মুহাম্মদ আল ফাতিহের জন্ম ১৪৩২ খিস্টাব্দের ৩০ মার্চ (২৬ রজব ৮৩৫ হিজরী), ততকালিন উসমানি সাম্রাজ্যের রাজধানী এডিরনিতে। তিনি ছিলেন উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সন্তান। বাল্যকাল থেকেই সুলতান মুরাদ তার সন্তানের জন্য শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেন। সেকালের সেরা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে মুহাম্মদ আল ফাতিহের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। সেকালের রীতি অনুযায়ি মুহাম্মদ আল ফাতিহকে প্রথমে কুর আনুল কারিম, এরপর ক্রমান্বয়ে হাদিস ও ফিকহের পাঠ দেয়া হয়। এসময় মুহাম্মদ আল ফাতিহের শিক্ষকদের মধ্যে মোল্লা গুরানীর নাম উল্লেখযোগ্য। সুলতানের জীবন গঠনে মোল্লা গুরানির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সুলতান হ ওয়ার পরেও মুহাম্মদ আল ফাতিহ কখনো গুরানিকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাননি। যখনি দরকার হ্তো নিজে গুরানির কাছে ছুটে যেতেন। গুরানিও কখনো সেকালের রীতি অনুযায়ী সুলতানের হাতে চুমু দিতেন না। তিনি সুলতানকে নাম ধরেই ডাকতেন।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ বিজ্ঞান ও ইতিহাসচর্চায় বেশ মনোযোগী ছিলেন। বেশিরভাগ সময় তিনি ইতিহাসের বই পড়েই কাটাতেন। এসময় মুহাম্মদ আল ফাতিহ আরবী, ফারসি, তুর্কি, সার্বীয়, গ্রীক, ল্যাটীনসহ ৭ টি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেন। এসব ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।


১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ সিংহাসন ত্যাগ করে মুহাম্মদ আল ফাতিহকে রাজত্বের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। এসময় হাংগেরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে মুহাম্মদ আল ফাতিহ পিতাকে নেতৃত্বদানের আহবান জানান। সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ দায়িত্ব হাতে নেন, এবং ভার্নায় সংঘটিত যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুহাম্মদ আল ফাতিহের বয়স কম থাকার কারনে উজির খলিল পাশা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদকে পুনরায় সিংহাসনে বসতে পীড়াপিড়ি করেন। সুলতান এ দাবী মেনে নেন।


১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ইন্তেকাল করলে পরবর্তী সুলতান হন মুহাম্মদ আল ফাতিহ। মুহাম্মদ আল ফাতিহ সিংহাসনে আরোহন করে সাম্রাজ্য দৃঢ় করার কাজে মনোযোগ দেন। তিনি সেনবাহিনীর বেতন ভাতা বৃদ্ধি করেন এবং একইসাথে সকল অনিয়ম বন্ধের জন্য কঠোরতা আরোপ করেন।


সুলতান স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করবেন। বাল্যকালে তার উস্তাদ শায়খ আক শামসুদ্দিন বারবার তাকে কনস্টান্টিনোপল বিজয় সংক্রান্ত হাদিসগুলো শুনিয়েছেন। তখনই বালক মুহাম্মদের মনে গেথে গেছে কনস্টান্টিনোপল জয়ের স্বপ্ন।


সেসময় কনস্টান্টিনোপল শাসন করছিল বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টাইন। অন্য সময়ের তুলনায় বাইজেন্টাইনরা দূর্বল হয়ে পড়েছিল, একথা সত্য , কিন্তু কনস্টান্টিনোপলের মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শহরটিকে যে কোনো শক্তিশালী বাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট ছিল।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ যখন দ্বিতীয়বারের মত সিং হাসনে আরোহন করেন তখন তার বয়স ১৯ বছর। এই তরুণ সুলতানকে ৪৯ বছর বয়সী বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টাইন মোটেও হুমকি হিসেবে দেখছিলেন না। মুহাম্মদ আল ফাতিহের কাছে প্রেরিত পত্রে কনস্টান্টাইন স্পষ্টতই তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছিলেন। মুহাম্মদ আল ফাতিহ সরাসরি কোনো মারমুখো জবাব দিয়ে কনস্টান্টাইনকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে মন ঢেলে দেন। ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে মুহাম্মদ আল ফাতিহ বসফরাস প্রনালিতে একটি দূর্গ নির্মানের কাজ শুরু করেন। কনস্টান্টিনোপলের কয়েক মেইল উত্তরে নির্মিত এই দুর্গের আয়তন ছিল ৩১ হাজার ২৫০ বর্গমিটার। এই দুর্গ নির্মানের উদ্দেশ্য ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া। দুর্গটির নাম ছিল রোমেলি হিসার। বাইজেন্টাইনরা বিপদের আভাস পেয়ে দুর্গ নির্মানে বাধা দেয়, কিন্তু সুলতান দুর্গ নির্মানে অনড় থাকেন। আগস্টে দুর্গের নির্মানকাজ সমাপ্ত হয়। দূর্গে বড় বড় কামান বসানো হয়, এবং চারশো সেনা মোতায়েন করা হয়। এই দুর্গ নির্মানের মাধ্যমে মুহাম্মদ আল ফাতিহ বসফরাস প্রনালীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। একইসাথে তিনি বাইজেন্টাইনদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।


দুর্গ নির্মান কাজ শেষ হতেই মুহাম্মদ আল ফাতিহ ঘোষণা দেন, এই কেল্লার কামানের পাল্লার আওতায় যাতায়াতকারী জাহাজগুলোকে কর দিতে হবে। যারা কর দিতে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে গোলা মেরে ডুবিয়ে দেয়া হবে। ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে একটি ভেনিসিয় জাহাজ কর না দিয়ে যেতে চাইলে গোলা মেরে এটি ডুবিয়ে দেয়া হয়। ভেনিস ও জেনোয়ার সরকারদ্বয় এ কর্মকান্ডকে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার লক্ষণ মনে করলেও ভয়ে নীরব থাকে।


বাইজেন্টাইন সম্রাট এতদিনে মুহাম্মদ আল ফাতিহের অভিপ্রায় নিশ্চিত হয়ে দিশেহারা হলেন। কনস্টান্টাইন আসন্ন বিপদের আশংকায় ইউরোপিয়ানদের সাহায্য চাইলেন। সেসময় গির্জার আভ্যন্তরিন বিরোধের কারনে তার সাহায্যের আবেদন খুব একটা ফলপ্রসু হয়ে উঠেনি। তবে নিজের স্বার্থে কেউ কেউ কনস্টান্টাইনকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।


সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি তার নৌবাহিনীর জন্য চারশো জাহাজ নির্মান করেন (সাল্লাবী)। উরবান নামে একজন হাংগেরিয়ান প্রকৌশলীকে শক্তিশালী তোপ নির্মানের দায়িত্ব দেয়া হয়। সে ১০০ টন ওজনের একটি তোপ নির্মান করে। এটি ছিল দৈর্ঘ্যে ২৭ ফুট। পাথর দিয়ে তৈরী ৬০০ পাউন্ডের গোলা, এই তোপের সাহায্যে ১ মাইল দূরে নিক্ষেপ করা যেত। এই তোপের নাম দেয়া হয় সুলতানী তোপ।


বাইজেন্টাইন অভিযানে ব্যবহৃত কামান
সুলতানি কামান

আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে দুদিকেই। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে জেনোয়া থেকে একটি সৈন্যদল আসে কনস্টান্টিনোপলের সাহায্যে। সম্রাটের আদেশে বসফরাস প্রনালীর গোল্ডেন হর্নে ভাসমান কাঠের উপর লোহার শিকল স্থাপন করা হয়। উসমানিদের কাঠের জাহাজগুলো আটকে দেয়ার জন্য এই শিকল খুবই মজবুত ছিল। গোল্ডেন হর্ন ছিল প্রনালীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে সংকীর্ণ। ফলে এই শিকল উসমানিদেরকে জোর প্রতিরোধ করবে এটাই ধরে নেয়া হয়েছিল, এবং পরে বাস্তবেও তাই হয়েছিল। সম্রাট কনস্টানটাইনের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল শহরের প্রতিরক্ষ প্রাচীর। প্রাচীরের সামনে ছিল ৬০ ফুট প্রশস্ত পরিখা। এবং প্রাচিরের দেয়ালে ৪০/৪৫ মিটার দূরত্বে একটি করে টাওয়ার। দূর্গে বেশকয়েকটি কামানও ছিল।


রোমেলি দুর্গ নির্মানের পর থেকেই বাইজেন্টাইনরা ধরে নিয়েছিল মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল আক্রমন করতে যাচ্ছেন। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে মুহাম্মদ আল ফাতিহ এড্রিয়ানোপলে সেনা সমাবেশ করেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে কনস্টান্টিনোপলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল উসমানি সেনাবাহিনী গোল্ডেন হর্নের দক্ষিনে অবস্থান নেয়। শহরের প্রাচীর বরাবর ছিল কারাদজা পাশার বাহিনী। ইসহাক পাশার সেনারা অবস্থান করছিল লুকাস নদীর দক্ষিন তীর থেকে মর্মর সাগর পর্যন্ত। জগন পাশার সেনারা অবস্থান করছিল গোল্ডেন হর্নের উত্তরে। ১২ এপ্রিল গ্যলিপলি থেকে উসমানি নৌবহর এসে পৌছে। এই বহরে প্রায় ২০০ জাহাজ ছিল।


১২ এপ্রিলে উসমানিদের কামানগুলো একসাথে গর্জে উঠে। প্রায় চার মেইল দীর্ঘ ফ্রন্টলাইন থেকে একযোগে সবকটা কামান গোলাবর্ষণ করে। অনেকের মতে এটি ছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম সমন্বিত গোলাবর্ষণ। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই বিবিসি গান্স অব কনস্টান্টিনোপল শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমে বিকট শব্দ করে আগুন ধরে যায় এবং নিচের মাটি কেপে উঠে। অগ্নিশিখায় চারদিক আলোকিত হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য গতিতে একের পর এক গোলা শহরের প্রাচীরে আঘাত করতে থাকে।


কনস্টান্টিনোপলের চারদিকে ছিল অত্যন্ত মজবুত প্রাচীর। যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। বাইজেন্টাইনরা আশা করছিল এই প্রাচীর উসমানিদের হামলা ঠেকিয়ে দিতে পারবে। এরমধ্যে ইউরোপ থেকে সাহায্য চলে আসবে। অবরোধের শুরুর দিকেই মুহাম্মদ আল ফাতিহ তার বাহিনী প্রেরণ করে থেরাপিয়া ও স্টুডিয়াস দুর্গ দখল করেন। দুর্গদুটির অবস্থান ছিল বসফরাস প্রনালী ও মর্মর সাগরের কাছে।

বাইজেন্টাইন অভিযানে ব্যবহৃত কামান

কনস্টান্টিনোপলে গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। বেশিরভাগ গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল, এই সুযোগে বাইজেন্টাইনরা ক্ষতিগ্রস্থ দেয়াল মেরামত করে ফেলে। এদিকে গোল্ডেন হর্নের মুখে শিকল ফেলে রাখায় সোলাইমান বাটুর নেতৃত্বাধীন উসমানি বাহিনী জলাশয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। ২০ এপ্রিল জেনোয়া ও গ্রীসের চারটি জাহাজের একটি বহর উসমানিদের দিকে এগিয়ে আসে। এসময় কিছু সং ঘর্ষ হয় যাতে উসমানি নৌবহর বেশ নাজেহাল হয়।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ বিলম্ব করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন ইউরোপ থেকে সাহায্য আসার আগেই শহর দখল করে নিতে। কিন্তু গোল্ডেন হর্নের শিকলগুলো তাকে সমস্যায় ফেলছিল। এই শেকলের কারনে উসমানি নৌবহর সামনে এগুতে পারছিল না। শেকল ছাড়াও গোল্ডেন হর্নে ২৮ টি বাইজেন্টাইন যুদ্ধজাহাজ পাহাড়া দিচ্ছিল। সুলতান ভাবছিলেন কী করে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করা যায়।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ একটি অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নেন। তার এই সিদ্ধান্ত ছিল বিস্ময়কর। তখন পর্যন্ত কারো কল্পনাতেও আসেনি এমনকিছু। তিনি সিদ্ধান্ত নেন গোল্ডেন হর্নের উত্তরাংশে গালাটা খাড়ির দিকে স্থল দিয়ে জাহাজ গুলো সামনে টেনে নিয়ে যাবেন। শেকল পাশ কাটিয়ে জাহাজগুলো গোল্ডেন হর্নে ঢুকে পড়বে। তিনি সেনাপতিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সবার কথা ছিল, এটি অসম্ভব। কিন্তু মুহাম্মদ আল ফাতিহ দমলেন না। তিনি স্থলে কাঠ বিছিয়ে এক মাইল দীর্ঘ রাস্তা করার আদেশ দিলেন। কাঠের উপর তেল ও চর্বি মাখানো হলো, যেন এর উপর দিয়ে সহজেই জাহাজগুলো টেনে নেয়া যায়। মাত্র একরাতের মধ্যে রাস্তা প্রস্তুত করা হয়। পুরো ব্যাপারটিতে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, এমনকি বাইজেন্টাইনরা কিছুই টের পায়নি। ২২ এপ্রিল এই কৃত্রিম রাস্তা দিয়ে ৮০ টি জাহাজ টেনে নেয়া হয়। জাহাজগুলো শেকল পাশ কাটিয়ে আবার গোল্ডেন হর্নে নেমে পড়ে। বাইজেন্টাইনের বাহিনী বিস্মিত চোখে এ দৃশ্য দেখছিল কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাদের আর কিছুই করার ছিল না। উসমানি বাহিনী প্রবেশ করেছে গোল্ডেন হর্নে। এবং এভাবেই উসমানিরা জল স্থল দুদিক থেকেই কনস্টান্টিনোপলের কাছাকাছি পৌছে গেল। এই ঘটনার ফলে বাইজেন্টাইনদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।


বাইজেন্টাইন অভিযানে ব্যবহৃত জাহাজগুলো মাটির উপর দিয়ে টেনে নেয়া হচ্ছে।
বাইজেন্টাইন অভিযানে এভাবেই মাটির উপর চলছে জাহাজ

শহরের প্রাচীরে উসমানিদের গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। বাইজেন্টাইনরা রাতের বেলা প্রাচীর মেরামত করার চেষ্টা চালাতো। তারা ইউরোপ থেকে আসা সাহায্যের অপেক্ষা করছিল, কিন্তু তখনো কাংখিত সাহায্যের দেখা মেলেনি। ২৮ এপ্রিল রাতে বাইজেন্টাইনরা উসমানিদের যুদ্ধ জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উসমানিরা আগেই সাবধান হয়ে যায়, ফলে তাদের এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন হয়নি। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ৭ মে রাতে বিধবস্ত প্রাচীরে জোরদার হামলা চালানো হয়। ১২ মে রাতে আবার হামলা করা হয়। হামলাগুলো কোন ফলাফল দিচ্ছিল না।


২১ মে মুহাম্মদ আল ফাতিহ একজন দূত প্রেরণ করেন কনস্টান্টাইনের কাছে। তিনি প্রস্তাব দেন, শহর হস্তান্তর করতে হবে এবং এক লাখ স্বর্নমুদ্রা জিযিয়া দিতে হবে। তাহলে তিনি অবরোধ তুলে ফিরে যাবেন। সুলতান একইসাথে নগরবাসীর জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার ওয়াদা করেন। কনস্টান্টাইন কর দিতে রাজি হলেও শহর হস্তান্তরে রাজি হয় নি। সে সাফ জানিয়ে দেয়, আমরা এই শহর রক্ষায় নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত।


এই সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে ভেনিসিয় ও হাংগেরীয় বাহিনী বাইজেন্টাইনদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছে। ২৫ মে রাতে মুহাম্মদ আল ফাতিহ তার সেনাপতিদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন৷ উজির খলিল পাশা ছিলেন অবরোধ তুলে নেয়ার পক্ষে। শুরু থেকেই তিনি এ অভিযানের বিপক্ষে ছিলেন৷ বৈঠকে জগন পাশা, খলিল পাশার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বারবার সুলতানকে চুড়ান্ত আক্রমন জানানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন৷ এসময় তিনি কনস্টান্টিনোপল বিজয় সংক্রান্ত হাদিসগুলো পাঠ করছিলেন, যেন সুলতান উদ্বুদ্ধ হন৷ সুলতান সিদ্ধান্ত নেন, এবার চুড়ান্ত আক্রমন চালানো হবে৷ পরদিন সকাল থেকে উসমানিরা সেনা সমাবেশ করতে থাকে। টানা ৩৬ ঘন্টা সেনা সমাবেশ চলে৷ ২৮ মে সেনাদের বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হয়। এদিকে ভেনিস থেকে বারোটি যুদ্ধ জাহাজ বাইজেন্টাইনদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। সম্রাটকে জানানো হয় আপাতত আর কোনো সাহায্য আসছে না। ২৮ মে শহরের প্রাচীর মেরামত করা হয়৷ সোফিয়া গির্জায় করুণ সুরে ঘন্টা বাজতে থাকে৷ শহরবাসী বুঝতে পেরেছিল শহরের পতন আসন্ন। তারা শেষবারের মত প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ করে৷ রাতে কনস্টান্টাইন শহরের প্রাচীর ঘুরে দেখেন।


২৯ মে ফজরের পর তুর্কি রণদামামা বেজে উঠে। শহরের প্রাচীর অভিমুখে উসমানিরা এক যোগে ঝাপিয়ে পড়ে৷ উসমানি সেনারা সেদিন রোজা রেখেছিল। নগরীর বাসিন্দারাও এদিন যুদ্ধে নেমে আসে। উসমানিদের গোলার আঘাতে প্রাচীরে বড় ধরনের কয়েকটি ফাটল দেখা দেয়। উসমানিদের ছোট একটি সেনাদল শহরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়৷ তবে শীঘ্রই বাইজেন্টাইনরা তাদের তাড়িয়ে দেয়। উলুবাটলি হাসান নামক একজন সেনাপতির নেতৃত্বে ৩০ জন সেনা শহরের প্রাচীরে আরোহণ করে৷ তিনি সেখানে উসমানিদের পতাকা উড়িয়ে দেন। এসময় ২৭ টি তীরবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর৷ আক্রমনের তীব্রতা সইতে না পেরে বাইজেন্টাইনরা প্রাচীর থেকে নেমে আসে৷ উসমানিরা একে কে প্রাচীরে উঠতে থাকে। তারা শহরে প্রবেশ করে। তারা শহরে প্রবেশ করেছিল সান রোমনো প্রাচীর দিয়ে। এটি তারা আগেই কামানের গোলায় উড়িয়ে দিয়েছিল। তুর্কিরা সেন্ট মার্কের পতাকা নামিয়ে আনে এবং টুকরো টুকরো করে ফেলে। উসমানিদের পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়৷ শহরবাসী যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে। কনস্টান্টাইনের শেষ পরিণতি নিশ্চিত হওয়া যায় নি। কারো কারো মতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন৷


কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের মুহুর্ত। কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের ইতিহাস
কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়

কনস্টান্টিনোপলের পতন হল। বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করলেন সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ৷ খ্রিস্টানদের জাহাজগুলো শরনার্থী বোঝাই করে শহর ত্যাগ করে। কাউকে বাধা দেয়া হয়নি৷ তবে শহরে তখনো কিছু লড়াই চলছিল৷ এতে দুপক্ষের অনেকেই হতাহত হয়৷ ৩ জুন মুহাম্মদ আল ফাতিহ শহর প্রদক্ষিণ করতে বের হন৷ তিনি দেখলেন শহর অনেকটাই নির্জন ও জনমানবহীন৷ তিনি সম্রাট সিজারের পরিত্যাক্ত প্রাসাদ দেখে শেখ সাদীর এই কবিতা আবৃত্তি করেন, কায়সারের প্রাসাদে জাল বুনেছে মাকড়সা, আফ্রাসিয়াবের গম্বুজে দেখো ডাকছে হুতুমপেঁচা৷


সুলতান তার তিন উযির খলিল পাশা, জগন পাশা ও সারিকা পাশাকে সম্মানিত করেন৷ তাদের নামে রুমেলি দুর্গের তিনটি টাওয়ারের নামকরণ করেন। তিনদিন পর সুলতান সকল লুন্ঠন বন্ধের আদেশ দেন। যারা ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের ঘরে ফিরে আসার আহবান জানান। একইসাথে তিনি বলেন, সবাইকে সবার সম্পদ ফেরত দেয়া হবে। এরপর সুলতান শহর মেরামতে মন দেন। তিনি আয়া সোফিয়া গির্জাকে মসজিদে রুপান্তরিত করেন৷ যেহেতু এই শহর যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করা হয়েছিল, তাই শরিয়াহর আলোকে এখানকার উপাসনালয়গুলো মসজিদ বানানো জায়েজ ছিল। গির্জা থেকে সকল মূর্তী অপসারণ করা হয়। জুনের প্রথমদিকে এখানে জুমার নামাজ আদায় করা হয়। আয়া সুফিয়াই ছিল ইস্তাম্বুলের প্রথম শাহী মসজিদ।


কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের ইতিহাস। ইস্তাম্বুলের প্রথম শাহী মসজিদ
ইস্তাম্বুলের প্রথম শাহী মসজিদ

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ইসলামের ইতিহাসে মুহাম্মদ আল ফাতিহকে অমর করে রেখেছে। এই শহরের পতনকে রোমান সাম্রাজ্যের পতন বলে ধরে নেয়া যায়।


কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর মুহাম্মদ আল ফাতিহ এগিয়ে যান সার্বিয়ার দিকে। ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে উসমানিদের সাথে হাংগেরিয়ানদের লড়াই হয়। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে উসমানিদের হাতে সার্বিয়ার পতন হয়। ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ আল ফাতিহ আলবেনিয়া জয় করেন।


১৪৮১ সালের শুরুর দিকে মুহাম্মদ আল ফাতিহ রোডস দ্বীপ ও ইতালীর দক্ষিনাঞ্চল অভিমুখে অভিযান শুরু করেন। ইস্তাম্বুলের নিকট মালটোপি এলাকায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দিনটি ছিল ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৪৯ বছর। তাকে ইস্তাম্বুলের ফতেহ মসজিদের নিকটে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর সংবাদে ইউরোপে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। গির্জাগুলোতে ঘন্টা বাজানো হতে থাকে। ভেনিসে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করার সময় বলা হয়, la grande aquila e morta (বিশাল ঈগলের মৃত্য হয়েছে)


মুহাম্মদ আল ফাতিহ ছিলেন একজন অসাধারণ সমরনায়ক। তিনি খুবই সাহসী ছিলেন। বলকানের যুদ্ধে বনের আড়াল থেকে উসমানিদের উপর তীর চালানো হয়। সেনারা আচমকা হামলায় ভীত হয়ে পিছু হটে। মুহাম্মদ আল ফাতিহ পিছু না হটে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যান। সুলতানকে এগুতে দেখে সেনারাও এগিয়ে যায়। যুদ্ধে উসমানিদের বিজয় হয়।


মুহাম্মদ আল ফাতিহ যখন কনস্টান্টিনোপল জয় করেন তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। এই বয়সেই তিনি সুবিশাল উসমানি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, দুর্ভেদ্য শহর কনস্টান্টিনোপল জয় করেছেন। নানা বাধা বিপত্তির মুখেও পিছু হটেননি। বাল্যকালে শিক্ষক আক শামসুদ্দিন তার ভেতর জিহাদের যে প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন, সুলতান সারা জীবন তা বুকের ভেতর লালন করেছিলেন।



কীওয়ার্ডঃ কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের ইতিহাস, বাইজেন্টাইন বিজয়, কনস্ট্যান্টিনোপল বর্তমান ইস্তাম্বুল কে বিজয় করেন, কনস্ট্যান্টিনোপল এর পতনের কারণ, কনস্ট্যান্টিনোপল এর পতন, কনস্ট্যান্টিনোপল এর ইতিহাস, কনস্ট্যান্টিনোপল এর বিজেতা।

লেখকঃ ইমরান রাইহান।

Previous Post Next Post