গন্তব্য জেরুজালেম : ইমরান রাইহান

গন্তব্য জেরুজালেম ইমরান রাইহান

দামেশকে সূচিত হলো ৫৮৩ হিজরী সন। 


আগের বছরটি ছিল তূলনামূলক শান্ত, এ সময় ক্রুসেডারদের সাথে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো যুদ্ধ হয়নি। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবিও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন ইলম ও ওয়াজের মজলিসে। যদিও সুলতান শিকার করতে পছন্দ করতেন এবং দামেশকের উপকন্ঠে অবস্থিত বনাঞ্চলে ছিল শিকার করার সুবর্ন সুযোগ, তবু তিনি দুয়েকবারের বেশি শিকারে যাননি।


কিন্তু ৫৮৩ হিজরীর সূচনাকাল জানান দিচ্ছিল আসন্ন সময়টি কতটা অশান্ত ও উত্তাল হতে যাচ্ছে। বছরের শুরুতেই সুলতানের পক্ষ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারে জিহাদের ডাক দেয়া হয়। সিরিয়া, মিসর ও ইরাকের ভুমিতে ছড়িয়ে পড়ে সেই আহ্বান। ‘সুলতান তাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন সাধ্যমত প্রস্তুতি নেয়ার’ লিখেছেন ইবনুল আসির।


উম্মাহর কল্যানচিন্তায় আকুল মুজাহিদরা দল বেঁধে ছুটে চলেন সুলতানের সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে। শহরগুলো থেকে এসেছিল অভিজ্ঞ যোদ্ধারা, তাদের চেহারায় ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। এসেছিল তরুণরাও, প্রথমবারের মত যুদ্ধে লড়ার উত্তেজনায় তারা ছিল অস্থির। অভিজ্ঞ যোদ্ধারা হাতে কলমে তরুণদের শেখালেন যুদ্ধ কৌশল, তরবারী ধরার কায়দা কানুন ও মল্লযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে আছাড় দেয়ায় কৌশল। ‘শুধু শক্তি যথেষ্ট নয়, বিজয়ের জন্য চাই শক্তি ও কৌশলের সমন্বয়’ বলছিলেন বয়সী যোদ্ধারা।


দামেশকের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধের উন্মাদনা। বৃদ্ধ প্রকৌশলীরা চিন্তা করছিলেন মিনজানিক কীভাবে আরো কার্যকর করে তোলা যায়। লোহার বর্মে আঘাত করার ফাঁকে অস্ত্র ব্যবসায়ী দেখলেন শহরের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মুজাহিদদের দল। ইস্পাতের ফলায় লেগে ঝিলিক দিল সূর্যের আলো, সে আলো প্রতিফলিত হলো জামে মসজিদের নীল কাঁচে, বৃদ্ধ হাজিরা মসজিদে যেতে যেতে দেখলেন সে দৃশ্য।


নতুন বছরের প্রথম দিন দামেশকে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবীকে দেখা গেল যোদ্ধার পোশাকে। সুলতানের বয়স তখন ৪৫ এবং এই বয়সের অর্ধেকের বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। লাগাতার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাকে করেছে পরিণত। তিনি দেখেছেন ক্ষমতার নানা উত্থান-পতন, অতিক্রম করেছেন ইতিহাসের নাজুক বাঁক। সুলতান নুরুদ্দিন জেংগির কাছে চাচার সাথে আসা সেদিনের সেই লাজুক তরুণ আজ কাঁধে তুলে নিয়েছে উম্মাহর দায়িত্ব। তার দিকে তাকিয়ে আছে উম্মাহ, নতুন করে দেখছে বাইতুল মাকদিস জয়ের স্বপ্ন।


হয়তো ৫৮৩ হিজরী বছরটিও কেটে যেত শান্ত নিরুপদ্রব, কিন্তু নানা কারণে সুলতান আর বিলম্ব করতে পারছিলেন না। প্রথমত যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও রেজিনাল্ড মিসর থেকে আসা একটি কাফেলায় হামলা করে কাফেলার সদস্যদের মালামাল লুট করে। বন্দী করে কাফেলার সবাইকে। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী সংবাদ পাওয়া মাত্র তাকে বার্তা পাঠিয়ে সতর্ক করেন এবং বন্দিদের মুক্ত করে মালামাল ফিরিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু রেজিনাল্ড সুলতানের কথায় কর্নপাত করেনি। তখনই সুলতান সিদ্ধান্ত নেন, রেজিনাল্ডের সাথে সামনাসামনি মিমাংসা করতে হবে। এছাড়া ক্রুসেডারদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কথাও কানে আসছিল সুলতানের। সার্বিক বিবেচনায় সুলতান আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন দ্রুত যুদ্ধের ময়দানে নেমে এসে ক্রুসেডারদের মুখোমুখি হতে।


দামেশক থেকে সুলতান যখন বের হন তখন সাথে তার পুত্র আল মালিকুল আফজালও ছিল। রা’সুল মা নামক এলাকায় এসে সুলতান পুত্রকে বলেন এখানেই অবস্থান করতে, কারণ পেছন থেকে আসা বেদুইন, তুর্কি ও অন্যান্য গোত্রের মুজাহিদদের দেখভাল ও নির্দেশনার জন্য কাউকে তখন দরকার ছিল। সুলতান নিজে মূল বাহিনীসহ এগিয়ে গেলেন বুসরার দিকে। বুসরা তখন ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছিল কারণ, মিসরের হাজিরা হজ্ব সেরে এই পথেই মিসর ফিরে যেত। সে বছর সুলতানের বোন ও ভাগ্নে হুসামুদ্দিন মুহাম্মদও হজ্ব সেরে এ পথে ফেরার কথা ছিল। সুলতানের গোয়েন্দারা সংবাদ এনেছিল রেজিনাল্ড চাচ্ছে হজ্ব কাফেলার উপর আক্রমণ করে মিসর থেকে সিরিয়ার সাহায্য আসার পথ বন্ধ করে দিতে। ফলে সুলতান সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বুসরাতেই অবস্থান করবেন, যতদিন না হজ্ব কাফেলাগুলো নির্বিঘ্নে মিসর পৌঁছে[1]।


সফর মাসের মধ্যে (১১৮৭ সালের মে মাস) হজ্ব কাফেলাগুলো নির্বিঘ্নে মিসর পৌঁছে গেল। সুলতানের বুসরা উপস্থিতির কথা জেনে ক্রুসেডারদের কারো সাহস হয়নি এসব কাফেলায় হামলা করার। এ সময় সুলতানের শিবির ছিল শান্ত কিন্তু সতর্ক। তাদের সামনে দিয়ে প্রতিদিন হজ্ব কাফেলাগুলো এগিয়ে যেত মিসরের দিকে। প্রহরীরা সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এসব কাফেলার দিকে। বালিয়াড়ির আড়ালে কাফেলা যখন হারিয়ে যেত, তখন প্রহরীদের কাধ কিছুটা অলস ভঙ্গীতে নিচু হত।


হজ্বের সর্বশেষ কাফেলাটিও মিসর পৌঁছে গেলে সুলতানের দুর্ভাবনার শেষ হলো। এখন তিনি অন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। সুলতানের পরিকল্পনা ছিল তিনি কার্ক আক্রমন করে রেজিনাল্ডকে শিক্ষা দিবেন। সেনাবাহিনীর নির্বাচিত একটি অংশকে নিয়ে তিনি কির্কের পথ ধরেন। ঝড়ের বেগে এই বাহিনী এসে উপস্থিত হয় কির্কের সামনে। সুলতানের আদেশে শহরের বাইরে আংগুর বাগান থেকে পেড়ে নেয়া হয় আংগুর, ফসলের মাঠ খালি করে ফেলা হয় সকল শষ্য তুলে। বড় গাছগুলোও কেটে ফেলা হলো যেন শহরবাসীর লাকড়ির অভাব হয়। এই পুরো সময়টা রেজিনাল্ড তার বাহিনী নিয়ে কেল্লার ভেতর বসে রইলো। বের হয়ে সুলতানের মোকাবেলা করার সাহস তার ছিল না। কেল্লার প্রাচীর থেকে সে দেখতো সুলতানের বাহিনী দূরের মাঠে শষ্য কেটে নিজেদের সাথে আনা থলে ভরে নিচ্ছে। শীতের বাতাসের মত হিমেল দীর্ঘশ্বাস রেজিনাল্ডের বুক থেকে বের হয়ে শুন্যে মিলিয়ে যেত তবু সুলতানের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার সাহস তার হয়নি। কার্কের পর সুলতান তার বাহিনী নিয়ে গেলেন সুবাক দুর্গে। এই দুর্গেও সরাসরি আক্রমন না করে দুর্গের বাইরের বাগান ও ফসলের মাঠ খালি করে ফেললো সুলতানের সেনারা।


সুলতান জানতেন এক দুটি ঝটিকা অভিযানে এসব কেল্লার পতন ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন ক্রুসেডারদের শক্তি যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনতে। সর্বশেষ গন্তব্য বাইতুল মাকদিসে পৌঁছার আগে উপর্যপুরী আঘাতে এসব দুর্গ যেন দূর্বল হয়ে পড়ে, সেটাই ছিল সুলতানের ইচ্ছা। এই অভিযান চলাকালেই সুলতান একটি পত্র পাঠান আল মালিকুল আফজালের কাছে। পত্রে নির্দেশ ছিল আল মালিকুল আফজাল যেন আক্কা ও তার আশপাশের এলাকায় গেরিলা হামলা চালান। টগবগে তরুণ আল মালিকুল আফজাল পূর্ব থেকেই ছিলেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, ইতিপূর্বে একাধিকবার সুলতানের কাছে ক্রুসেডারদের হামলা করার অনুমতি চেয়েও পাননি তিনি। আক্কা আক্রমনের অনুমতি পেয়েই আল মালিকুল আফজাল তার দক্ষ আমির মুজাফফরুদ্দিন কোকাবরি, দিলদারাম ইয়াকুতি ও সারিমুদ্দিন কাইমাজকে পাঠালেন আক্কার উদ্দেশ্যে। কালেমাখচিত পতাকা বহন করে এই বাহিনী যখন রওনা হলো আক্কার উদ্দেশ্যে, তাকবির ধবনীতে উচ্চকিত হল চারপাশ।


এই বাহিনী দ্রুতবেগে পথ চলে ৫৮৩ হিজরীর সফর মাসের শেষদিকে সী অব গ্যালিলির[2] ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে সাফফারিয়া  নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। তারা পেছনে ফেলে এসেছিল প্রাচীরবেষ্টিত টাইবেরিয়াস[3] শহর, যা সুলতানের সাবেক শত্রু ও বর্তমান মিত্র রেমন্ডের আবাসস্থল[4]।


টাইবেরিয়াস ছিল রেমন্ডের প্রিয় শহর। যদিও শহরের মূল কতৃত্ব ছিল তার স্ত্রীর অধিকারে, তবে রেমন্ড এখানে সময় কাটাতেই ভালোবাসতেন। এটি ছিল সী অব গ্যালিলির তীরে অবস্থিত চমৎকার একটি শহর, যা তার মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মুগ্ধকর স্থাপনার জন্য বিখ্যাত ছিল। কালো পাথরের তৈরী কেল্লাটি মুসাফিরদের চোখে প্রায়ই ভীতিকর দেখাতো, কিন্তু প্রাচীরের ভেতর ছিল আনন্দের নানা উপাদান, যা নিমিষেই যে কোনো যুদ্ধবাজ নেতার ক্লান্তি দূর করতে সক্ষম ছিল। রাজপ্রাসাদগুলো বিস্তৃত ছিল হ্রদের তির পর্যন্ত, সকাল ও সন্ধ্যায় ভেজা বাতাস এসে পরশ বুলাতো প্রাসাদের গায়ে। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে হ্রদের পানিতে চিকচিক করে প্রায়ই চোখ ধাধিয়ে দিত, রোদের তীব্রতা কমে গেলে ভিড় জমাতো মাছ শিকারিদের দল। শহরের উত্তর দিকে ছিল সুউচ্চ পর্বত, যা ছিল সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির রাজত্বের সীমানা। নানা গাছপালা বেষ্টিত পর্বতটিকে আপাতদৃষ্টিতে শান্ত মনে হলেও ক্রুসেডারদের জানা ছিল পর্বতের ভেতর রয়েছে আইয়ুবি সাম্রাজ্যের সীমান্ত-চৌকি। সাদা পাগড়ি পরা তরুণ সেনারা ঘোড়ায় চড়ে সবসময় পাহারা দিত পর্বতের নিচের দিকটা।


পর্বতের পাশ দিয়ে কয়েকটি রাস্তা টাইবেরিয়াস শহরে প্রবেশ করেছিল, এসব রাস্তার কোনো কোনোটি বিস্তৃত ছিল দামেশক পর্যন্ত। এই পথে মুসলমানরা প্রায়ই যাতায়াত করতো। রেমন্ড চাইলে সহজেই এই রাস্তায় বাধা দিতে পারতো, কিন্তু রেমন্ড সুলতানের সাথে চলমান সন্ধি ভঙ্গ করতে রাজি ছিলেন না। রেমন্ডের জানা ছিল শীঘ্রই সুলতান চুড়ান্ত অভিযান চালাবেন সিরিয়ার উপকূলে, সে সময় মুসলিম সেনারা নানাভাবে এসব রাস্তা ব্যবহার করবে, কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন না সুলতানের সাথে নতুন কোনো দ্বন্দে জড়াতে।


কিন্তু আল মালিকুল আফজালের হাতে বেশকজন হসপিটালার ও টেমপ্লার নাইট নিহত হলে ক্রুসেডাররা রেমন্ডকে বাধ্য করে তাদের সাথে হাত মেলাতে। নাইটরা নিহত হয় রেমন্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার ভেতরে, ফলে ক্রুসেডাররা আগুন উস্কে দেয়ার সুযোগ পায়[5]। পাদ্রিরা রেমন্ডকে বিধর্মী বলে আখ্যা দেয়, নিজের সেনাবাহিনীর কাছেও রেমন্ড অপমানিত হন। গুজব ছড়ানো হয়, রেমন্ড গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাই তিনি ক্রুসেডার সাথে ঐক্য করছেন না। হতাশ রেমন্ড নিজের সম্মান বাঁচাতে নিজের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী গাইয়ের সাথে হাত মেলাতে সম্মত হন। ‘এক জাকজমকপূর্ন অনুষ্ঠানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আলিঙ্গনাবদ্ধ হন’ লিখেছেন লেনপুল।


রেমন্ড, গাই ও অন্য ক্রুসেডার সেনাপতিদের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় ক্রুসেডারদের সম্মিলিত বাহিনী সাফফারিয়া অঞ্চলে একত্রিত হয়ে মুসলমানদের সাথে লড়াই করবে।


সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী এই সময়টায় অবস্থান করছিলেন কার্কের কাছে। যদিও তিনি সরাসরি কোনো যুদ্ধে তখন ব্যস্ত ছিলেন না, তবু তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল পরিস্থিতির উপর। নাইটদের হত্যার সংবাদ শুনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ক্রুসেডাররা এই অপমান সহজে মেনে নিবে না, অবশ্যই তারা প্রতিশোধ নিতে আসবে. সুলতান বিন্দুমাত্র দেরি করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি রাতারাতি শিবির তুলে সেনাদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন উত্তর দিকে। পথে তার কাছে বার্তা এলো, রেমন্ড সন্ধি ভঙ্গ করে ক্রুসেডারদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। সংবাদ শুনে স্থির রইলেন সুলতান। বাহ্যত তিনি কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাননি, তবে মনে মনে যুদ্ধের পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন তিনি।


ইতিমধ্যে তকিউদ্দিন উমর নিজের পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে এসে সুলতানের সাথে মিলিত হলেন। দীর্ঘ যাত্রার ফলে তকিউদ্দিনের সেনারা ছিল ক্লান্ত, কিন্তু সুলতান যখন তাদের চেহারার দিকে তাকালেন সেখানে দেখলেন উদ্যমতা। তারা দাঁড়িয়েছিল শান্তভাবে, কিন্তু তাদের চোখের ক্ষীপ্রতা ও সুঠামদেহ জানান দিচ্ছিল তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সুলতান অনুভব করলেন বাইতুল মাকদিস জয়ের জন্য যে সেনাবাহিনী তার দরকার, তার বড় অংশ পেয়ে গেছেন তিনি।


সুলতান আশতারা পৌঁছে সেনাবাহিনীকে বিন্যাস করলেন। তার নিয়মিত সেনা ছিল ১২ হাজার, যাদের বেশিরভাগ এসেছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকের পক্ষ থেকে। স্বেচ্ছাসেবক সেনাদের সংখ্যা ছিল এর বাইরে, প্রায়ই সংখ্যাটা উঠানামা করতো বলে সংখ্যা নির্ধারণ করতে ইতিহাসবিদদের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।


সুলতান সেনাদের সাজালেন ডান বাহু, বাম বাহু ও মধ্যভাগ আকারে। মধ্যভাগের নিয়ন্ত্রন রইলো সুলতানের হাতে। ডান বাহুর দায়িত্বে থাকলেন তকিউদ্দিন উমর, দক্ষ সেনানায়ক হিসেবে ততদিনে তার সুনাম ছড়িয়েছিল। বাম বাহুর দায়িত্বে রইলেন মুজাফফরুদ্দিন কোকুবরি, ইবনুল আসির তাকে শীর্ষস্থানীয় আমিরদের একজন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ৫৮৩ হিজরির ১৭ রবিউস সানি সেনাবাহিনী উপকূলের দিকে অগ্রসর হলো। দিনটি ছিল শুক্রবার। সুলতানের অভ্যাস ছিল অভিযানে যাত্রা শুরুর জন্য জুমার দিন, এমনকি সম্ভব হলে জুমার নামাজের সময়টিকে বেছে নিতেন। ‘তিনি এটি করতেন, যেন মিম্বরে বসা খতিবদের দোয়ার বরকত হাসিল করা যায়’ ব্যাখ্যা করেছেন সুলতানের জীবনিকার বাহাউদ্দিন ইবনু শাদ্দাদ।


সম্ভবত এটি ছিল সুলতানের জন্য এটি অনুপ্রেরণা যা তিনি অর্জন করেছিলেন তার পূর্বসূরী সেলজুক সুলতান আলপ আরসালানের কাছ থেকে। ১২০ বছর আগে সুলতান আলপ আরসালান যখন রোমানদের সাথে লড়াইয়ের জন্য মানজিকার্টের উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন তিনিও জুমার নামাজের সময়টিই বেছে নিয়েছিলেন।


দিনের সফর শেষে সুলতান রাত কাটালেন হাস্পিনে[6], পরদিন তিনি প্রবেশ করলেন জর্ডানের সীমান্তে। ইতিমধ্যে তিনি পৌঁছে গেছেন সী অব গ্যালিলির তীরে। এখানে ছোট একটি গ্রাম উকহুয়ানাতে ৫ দিন কাটালেন সুলতান। সময়টা তিনি ব্যয় করলেন সেনাদের যুদ্ধের মহরা দেখে, এই ফাঁকে তিনি সেনাপতিদের বুঝিয়ে দিলেন যুদ্ধের বিস্তারিত পরিকল্পনা। সুলতানের সেনারা ছাউনি ফেলেছিল সী অব গ্যালিলির তীরে। রাতের বেলা যখন তাবুতে আলো জ্বলে উঠতো, তখন সী অব গ্যালিলির পানিতে প্রতিফলিত হতো সে আলো[7]।


ক্রুসেডাররা বসে ছিল না। তারাও নিচ্ছিল সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি। ঘর্মাক্ত চেহারার কৃষকরা এসেছিল ফসলি জমির কাজ ছেড়ে, পাদ্রিদের স্বর্গের প্রতিশ্রুতি আর মোটা অংকের অর্থ দুদিকেই লোভ ছিল তাদের। তীরন্দাযরা শেষবারের মত নিজেদের নিশানা পরীক্ষা করছিল। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে সেনাদের মাঝ দিয়ে চলছিল টেমপ্লার নাইটরা। সদ্য হারানো সতীর্থদের শোকে তাদের মন ছিল আচ্ছন্ন, যে কোনো মূল্যে চুড়ান্ত প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল তারা। এই ক্রুসেডারদের অনেকেই ছিল মাআররাতুন নুমানে নৃশংস ঘটনার জন্ম দেয়া ক্রুসেডারদের বংশধর, ফলে আরো একবার উন্মত্ত প্রতিশোধ ও নৃশংসতায় মেতে উঠার সুযোগ খুজছিল তারা।


সূত্রঃ

[1] আর রওযাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন, ৩/২৭৬। আল কামিল ফিত তারিখ, ১০/১৪৩।  

[2] ইসরাইলে অবস্থিত একটি হ্রদ।

[3] আরবিতে এর নাম তবারিয়্যা।

[4] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫৮৩ হিজরি। তারিখে ইবনে খালদুন, ৫/৩০২। আল কামিল ফিত তারিখ, ১০/১৪৩।  

[5] লেনপুলের ভাষ্য থেকে জানা যায়, এই নাইটরা রেমন্ডের কাছে আসছিল গাইয়ের চিঠি নিয়ে। পথে তারা মুসলমান সেনাদের সামনে পেয়ে আক্রমণ করে বসে। মুসলিম সেনারা বীরত্বের সাথে এ আক্রমনের জবাব দিলে নাইটদের প্রায় সকলেই নিহত হয়।

[6] বর্তমানে ইসরাইলের একটি শহর।

[7] আল কামিল ফিত তারিখ, ১০/১৪৪।

Previous Post Next Post