হুনাইনের যুদ্ধ : আরব বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য | Battle of Hunayn

হুনাইনের যুদ্ধ Battle of Hunayn

এটা ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তী জীবনের শেষ পর্যায়। প্রায় তেইশ বছরের শ্রম সাধনায় তিনি যে কষ্ট করেছিলেন তাঁর জীবনের এই পর্যায় ছিলো সেই স্বীকৃতি ।


এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কা বিজয় ছিলো নবী (সাঃ) এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। এ বিজয়ের ফলে পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় এবং আরবের পরিবেশ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এ বিজয় ছিলো পূর্বাপর সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন। আরব জনগণের দৃষ্টিতে কোরায়শ ছিলো দ্বীনের হেফাযতকারী ও সাহায্যকারী। সমগ্র আরব ছিলো এ ক্ষেত্রে তাদের অধীনস্থ। কোরায়শদের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এই যে, সমগ্র আরব ভূখন্ড মূর্তিপূজা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে চিরদিনের জন্যে।


উল্লিখিত শেষ পর্যায়টি দুইভাগে বিভক্ত। এক. মোজাহাদা ও যুদ্ধ। দুই. ইসলাম গ্রহণের জন্যে বিভিন্ন কওম ও গোত্রের ছুটে আসা। এ উভয় অবস্থা পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।


হোনায়েনের যুদ্ধ- আকস্মিক অভিযানে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো। এতে আরবের জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে এ অপ্রতাশিত অভিযানের মোকাবেলা করার শক্তি ছিলো না। এ কারণে শক্তিশালী অহংকারী উচ্ছৃঙ্খল কিছু গোত্র ছাড়া অন্য সবাই আত্মসমর্পণ করেছিলো। উচ্ছৃঙ্খল গোত্রসমূহের মধ্যে হাওয়াযেন এবং ছাকিফ ছিলো নেতৃস্থানীয়। তাদের সাথে মুযার জোশাম সাদ ইবনে বকর-এর গোত্রসমূহ এবং বনু বেলালের কিছু লোক শামিল হয়েছিলো। এসব গোত্রের সম্পর্ক ছিলো কাইসে আইলানের সাথে মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা তারা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে করছিলো। তাই তারা মালেক ইবনে আওফ নসরীর কাছে গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলো।


শত্রুদের রওয়ানা এবং আওতাস-এ উপস্থিতি সিদ্ধান্তের পর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সকল সমবেত সকল অমুসলিম রওয়ানা হলো। তারা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপাল নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চললো। আওতাস প্রান্তরে তারা উপস্থিত হলো। আওতাস হচ্ছে হোনায়েনের কাছে বনু হাওয়াযেন এলাকার একটি প্রান্তর। কিন্তু এ প্রান্তর হোনায়েন থেকে পৃথক। হোনায়েন একটি পৃথক প্রান্তর। এটি যুল মাজাজ-এর সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাত হয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলের বেশী। 


হুনাইনের প্রান্তর, battle of Hunayn map
হুনাইনের প্রান্তর, মক্কা থেকে মুসলিম বাহিনী হুনাইনের দিকে রওয়ানা করে, পরে কাফিররা পরাজিত হলে তাইফে আশ্রয় নেয়৷

শত্রুদের সেনা সমাবেশ- আওতাস-এর অবতরণের পর লোকেরা কমান্ডার মালেক ইবনে আওফের সামনে হাজির হলো। এদের মধ্যে প্রবীণ সমর বিশারদ দুরাইদ ইবনে ছোম্মাও ছিলো। এই লোকটি বয়সের ভারে ছিলো ন্যুব্জ। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। এক সময় সে ছিলো বীর যোদ্ধা। এখন অভিজ্ঞতা বর্ণনা এবং সে আলোকে পরামর্শ দেয়া ছাড়া তার কিছু করার নেই। সে মালেককে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমরা কোন প্রান্তরে রয়েছো? তাকে বলা হলো, আওতাস প্রান্তরে। সে বললো, এটা সৈন্য সমাবেশের উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু গাধা, উট, ঘোড়ার ডাকাডাকি, শিশু সন্তানের কান্না মেয়েদের গলার আওয়ায পাচ্ছি। তাকে জানানো হলো যে, কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ সৈন্যদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপালও নিয়ে এসেছে। দুরাইদ এর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হলো যে, প্রত্যেক যোদ্ধা তার কাছে মজুদ স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পশুপালের আকর্ষণে বীরত্বের সাথে লড়াই করবে। মালেক ইবনে আওফের এ জবাব শুনে দুরাইদ বললো, আল্লাহর কসম, তুমি ভেড়ার রাখাল। পরাজিত ব্যক্তিকে কোন কিছু কি ধরে রাখতে পারে? দেখো, যুদ্ধে যদি তুমি জয়ী হও, তবে তলোয়ার এবং বর্শা দ্বারাই উপকৃত হবে। আর যদি পরাজিত হও তবে অপমানিত হবে। কারণ পরাজিত যোদ্ধার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার এবং পশুপাল কিছুই নিরাপদ থাকবে না। দুরাইদ বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। সব কথা শোনার পর কমান্ডারকে বললো, হে মালেক, তুমি বনু হাওয়াযেন গোত্রের পরিবার-পরিজন ও পশুদল নিয়ে এসে ভালো কাজ করোনি। তাদেরকে নিজ নিজ এলাকার নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দাও। পরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তোমরা বে-দ্বীনদের সাথে লড়াই করো। যদি তুমি জয়লাভ করো তবে পেছনের যারা থাকবে তারা এসে তোমার সাথে মিলিত হবে। যদি পরাজিত হও, তবে ওরা নিরাপদ থাকবে।


কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললো, খোদার কসম, আমি তা করতে পারি না। তুমি বুড়ো হয়েছো তোমার বুদ্ধিও বুড়ো হয়ে গেছে। হয়তো হাওয়াযেন গোত্র আমার আনুগত্য করবে অথবা আমি তলোয়ারের ওপর হেলান দিয় আত্মহত্যা করবো। মোটকথা, দুরাইদের নাম বা তার পরামর্শ এ যুদ্ধে শামিল হোক, এটা মালেক পছন্দ করলো না। হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা বললো, আমরা তোমার আনুগত্যে অটল রয়েছি। দুরাইদ বললো, আমি এ যুদ্ধের সাথে নাই। এ যুদ্ধের কোন দায়দায়িত্ব আমার নাই। হায়, আজ যদি আমি জওয়ান হতাম, যদি আমার ছুটোছুটি করার মতো বয়স থাকতো, তবে আমি লম্বা পশমের মাঝারি সাইজের বকরির মতো ঘোড়ার নেতৃত্ব করতাম।


শত্রুদের গুপ্তচর- মুসলমানদের খবর সংগ্রহে মালেক ইবনে আওফ দু'জন গুপ্তচর পাঠালো। তারা গন্তব্যে পৌছার আগেই ফিরে এলো। তারা ছিলো চলৎশক্তিহীন। কমান্ডারের কাছে তাদের হাযির করার পর কমান্ডার বললো, তোমাদের সর্বনাশ হোক, এ অবস্থা হলো কেন? তারা বললো, আমরা কয়েকটি চিত্রল ঘোড়া এবং মানুষ দেখেছি, এরপরই আমাদের এ অবস্থা হয়েছে।


একদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের নানারকম খবর পাচ্ছিলেন। তিনি আবু হাদরাদ আসলামিকে বললেন, তুমি যাও, শত্রুদের মাঝে গিয়ে অবস্থান করে তাদের খবরাখবর এনে দাও। তিনি তাই করলেন।


মক্কা থেকে হোনায়েনের পথে যাত্রা অষ্টম হিজরীর ৬ই শওয়াল রোববার দিনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এটা ছিলো তাঁর মক্কায় আগমনের উনিশতম দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলো ১২ হাজার সৈন্য। এদের মধ্যে ১০ হাজার মদীনা থেকে মক্কায় এসেছিলেন, বাকি ২ হাজার মক্কা থেকে রওয়ানা হন। মক্কার ২ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নও মুসলিম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে অস্ত্রসহ একশত বর্ম ধার নিলেন। আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গবর্নর নিযুক্ত করলেন। দুপুরের পরে একজন সাহাবী এসে বললেন, আমি অমুক অমুক পাহাড়ে উঠে দেখেছি বনু হাওয়াযেন সপরিবারে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা নিজেদের পশুপালও সঙ্গে এনেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, ইনশাল্লাহ আগামীকাল এগুলো মুসলমানদের গনীমতের মাল হবে। রাতের বেলা হযরত আনাস ইবনে মারছাদ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলেন।


হুনাইনের পথে সাহাবীরা- যাতে-আনওয়াত নামক একটি কূল গাছ দেখলেন। মক্কার মোশরেকরা এ গাছের সাথে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। এর পাশে পশু যবাই করতো এবং এর নীচে মেলা বসাতো। কয়েকজন সহযোদ্ধা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ওদের যেমন যাতে-আনওয়াত নামে গাছ রয়েছে আপনি আমাদের জন্যেও ওরকম একটি গাছ তৈরী করে দিন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে মক্কা থেকে আসা বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন নওমুসলিম।  তাদের কথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবর, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তোমরাতো সেইরকম কথা বলছো, যে রকম কথা হযরত মূসার কওম তাঁকে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, এজআল লানা এলাহান কামা লাহুম আলেহাতুন।' অর্থাৎ আমাদের জন্যে একজন মাবুদ বানিয়ে দিন, যেমন ওদের জন্যে মাবুদ রয়েছে। তোমরা তো দেখছি পূর্ববর্তীদের তরিকার ওপরই উঠে পড়েছো।


অন্যদিকে কিছু লোক সৈন্য সংখ্যার আধিক্য দেখে বললেন, আমরা আজ কিছুতেই পরাজিত হব না যদিও তাদের অনেকেই মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মক্কা বিজয়ের প্রভাবে মুসলমান হয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাটিও পছন্দ করলেন না


মুসলমানদের উপর হামলা- ১০ই শওয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইসলামী বাহিনী হোনায়েনে পৌঁছুলো। মালেক ইবনে আওফ আগেই এ জায়গায় পৌছে রাতের অন্ধকারে তার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের মধ্যে গোপনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, মুসলমানরা আসা মাত্র তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করবে এবং কিছুক্ষণ পর একজোটে হামলা করবে।


এদিকে খুব প্রত্যুষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। খুব ভোরে মুসলিম সৈন্যরা হোনায়েনের প্রান্তরে পদার্পণ করলেন। শত্রুসৈন্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। শত্রুরা যে ওঁৎ পেতে রয়েছে এ সম্পর্কে অনবহিত মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিন্তে অবস্থান নেয়ার সময় হঠাৎ করে তাদের ওপর তীরবৃষ্টি শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরই শত্রুরা একযোগে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলমানরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলেন। এটা ছিলো সুস্পষ্ট পরাজয়। নও মসুলিম আবু সুফিয়ান বললেন, ওরা সমুদ্রপারে না গিয়ে থামবে না (হুনাইনের প্রান্তর থেকে মক্কা পাড় হয়ে লোহিত সাগর অবস্থিত, চিত্র দ্রষ্টব্য)। জাবালা অথবা কালদা ইবনে জোনায়েদ বললো, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে। ইবনে ইসহাক এটা বর্ণনা করছেন। বারা ইবনে আযেব বলেন, সহীহ বোখারীতে উল্লেখ রয়েছে যে, বনু হাওয়াযেন ছিলো তীরন্দাজ, আমরা হামলা করলে তারা পালিয়ে গেলো। এরপর আমরা গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা তীর বৃষ্টি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। 


হুনাইনের যুদ্ধের মানচিত্র Battle of Hunayn map
হুনাইনের যুদ্ধের মানচিত্র। মক্কার পিছনে অবস্থিত লোহিত সাগর। হুনাইন প্রান্তরের পাশে অবস্থিত তায়েফ যেখানে পরবর্বিতে পরাজিত দলের সাথে তায়েফের যুদ্ধ হয়।

সহীহ মুসলিম শরিফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস বলেন, আমরা মক্কা জয় করেছি। পরে হোনায়েনে অভিযান চালিয়েছি। মোশরেকরা চমৎকার সারিবদ্ধভাবে এসেছিলো। অমন সুশৃঙ্খল অবস্থা আমি কখনো দেখিনি। প্রথমে সওয়ারদের সারি, এরপর পদব্রজীদের সারি, তাদের পেছনে মহিলারা এর পেছেনে ভেড়া বকরি, তারপর পশুপাল। আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক। আমাদের সৈন্যদের ডানদিকে ছিলেন হযরত খালেদ (রা.)। কিন্তু আমাদের সওয়ার আমাদের পেছনে আত্মগোপন করতে লাগলেন, কিছুক্ষণ পর তারা পলায়ন করলেন। আরবরাও পলায়ন করলো। ওরাও পলায়ন করলো, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো। সাহাবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডানদিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল, তোমরা আমার দিকে এসো, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন মোহাজের এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। 


সেই নাযুক সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযিরবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নাবিউ লা কাযেব আনা ইবনু আবদুল মোত্তালেব অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র। (নিচের ভিডিওতে হুনাইনের প্রান্তরটি দেখানো হয়েছে যেখানে নবীজি সাঃ একথা বলেছিলেন)


সেই সময় আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চর ধরে রেখেছিলেন যাতে করে খচ্চর সামনের দিকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করেন। হযরত আব্বাসের ছিলো দরাজ গলা। হযরত আব্বাস বলেন, আমি উচ্চ কণ্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা, বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা। সাহাবারা আমার কণ্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়ায শুনে বাছুর ছুটে আসে। সাহাবরা বললেন, আমরা আসছি।


সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে একশত সাহাবী সমবেত হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর মোকাবেলা করলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। এ অবস্থায় বিশ্বনবী (সা.) আল্লাহর সাহায্য চান এবং কাফিরদের ওপর পাল্টা হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। হযরত আলী (আ.) শুরু করেন এক বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ। বিশ্বনবী (সা.)'র কাছ থেকে উপহার পাওয়া তরবারি জুলফিকারের অপরাজেয় আঘাত হেনে আলী (আ.) ভয়ানক কাফির যোদ্ধা আবু জারুলসহ বেশ ক'জন দুর্ধর্ষ কাফির কমান্ডারকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন।


এরপর আনসারদের ডাকা হলো। ক্রমে বনু হারেস ইবনে খাযরাজের মধ্যে এই ডাক সীমিত হয়ে পড়লো। এদিকে সাহাবারা রণাঙ্গন থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলে ‘শাহাতুল উজুহ' বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চোহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো। 


রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধূলো নিক্ষেপের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে গেলো শত্রুরা পরাজিত হলো। ছাকিফা গোত্রের ৭০ জন কাফের নিহত হলো। তাদের নিয়ে আসা অস্ত্র ধন-সম্পদ, রসদ, সামগ্রী, নারী, শিশু, পশুপাল সবকিছু মুসলমানদের হস্তগত হলো ।


আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন, 'আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে হোনায়েনের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিলো তোমাদের সংখ্যাধিক্য এবং তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং পরে তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছ থেকে তাঁর রসূল এবং মোমেনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটা কাফেরদের কর্মফল।' (সূরা তাওবা, আয়াত ২৫-২৬)


শত্রুদের পরাজয়- উভয় পক্ষে কিছুক্ষণ মোকাবেলার পরই মোশরেকরা পলায়নের পথ ধরলো। পরাজয়ের পর একদল শত্রু তায়েফের পথে অগ্রসর হলো। একদল নাখলার দিকে এবং একদল আওতাসের পথে অগ্রসর হলো। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবু আমের আশআরী শাহাদাত বরণ করেন। তিনি একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন।


একদল সাহাবী নাখলার পথে গমনকারী অমুসলিমদের ধাওয়া করলেন দুরাইদ ইবনে ছোম্মাকে পাকড়াও করা হলো। হযরত রাবিয়া ইবনে রফি তাকে হত্যা করলেন। পরাজিত শত্রুদের সবচেয়ে বড় দল তায়েফের দিকে অগ্রসর হলো। রসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল জমা করার পর তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।


গনীমত- গনীমতের মালের বিবরণ নিম্নরূপ। যুদ্ধবন্দী ৬ হাজার, উট ২৪ হাজার বকরি ৪০ হাজারের বেশী। চঁাঁদি ৪ হাজার উকিয়া। অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার দিরহাম। এর ওজন ৬ কুইন্টালের চেয়ে কয়েক কিলো কম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদয় মালামাল জমা করার নির্দেশ দিলেন। যেরানা নামক জায়গায় সমদুয় সম্পদ একত্রিত করে হযরত মাসউদ ইবনে আমর গেফারী (রা.)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। তায়েফ যুদ্ধ থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্টন করা হয়নি।



বন্দীদের মধ্যে শায়মা বিনতে হারেস সাদিয়াও ছিলেন। ইনি ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুধবোন। তাঁকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এসে তাঁর পরিচয় দেয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চিহ্নের দ্বারা তাকে চিনতে পারেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দেন সাদিয়ার মতামত অনুসারে তার প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি তাকে নিজের গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।

Previous Post Next Post