মুতার যুদ্ধের ঘটনা : Battle of Mu'tah

মুতার যুদ্ধের ঘটনা


মুতা জর্দানের বাল্ক (বালক বা বল্ক) এলাকার নিকটবর্তী একটি জনপদ। এই জায়গা থেকে বায়তুল মাকদেসের দূরত্ব মাত্র দুই মনযিল । মুতার যুদ্ধ এখানেই সংঘটিত হয়েছিলো।


রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় মুসলমানরা যেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এ যুদ্ধ ছিলো সে সকল যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী । এই যুদ্ধই খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশসমূহ জয়ের পথ খুলে দেয় । অষ্টম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল অর্থাৎ ৬২৯ খৃষ্টাব্দ বা সেপ্টেম্বর মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।


মুতার যুদ্ধের কারণ- মুতা অভিযানের কারণ এই যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারেছ ইবনে ওমায়ের আযদীকে একখানি চিঠিসহ বসরায় গবর্ণরের কাছে প্রেরণ করেন। রোমের কায়সারের গবর্ণর শরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানি সেই সময় বালক এলাকায় নিযুক্ত ছিলো। এই দুর্বৃত্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূতকে গ্রেফতার করে এবং শক্তভাবে বেঁধে হত্যা করে । স্মরণ করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রদূত বা সাধারণ দূতদের হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। এটা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল, এমনকি এর চেয়েও গুরুতর মনে করা হয়।


এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রেরিত দূতের হত্যার খবর শোনার পর খুবই মর্মাহত হন। তিনি সেই এলাকায় মোতায়েনের জন্যে সৈন্যদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তিন হাজার সৈন্য তৈরী করা হয়। খন্দকের যুদ্ধ ছাড়া ইতিপূর্বে অন্য কোন যুদ্ধেই মুসলমানরা তিন হাজার সৈন্য সমাবেশ করেননি।


সেনানায়কদের প্রতি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ ইবনে হারেছা (রা.) কে এই সেনাদলের সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, যায়েদ যদি নিহত হন তবে জাফর এবং জাফর যদি নিহত হন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) সিপাহসালার নিযুক্ত হবেন। 


রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম সেনাদলের জন্যে সাদা পতাকা তৈরী করে তা হযরত যায়েদ ইবনে হারেছার কাছে দেন।৩ সৈন্যদলকে তিনি ওসিয়ত করেন যে, হারেছ ইবনে ওমায়েরের হত্যকান্ডের জায়গায় তারা যেন স্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তো ভালো যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তবে আল্লাহর দরবারে সাহায্য চাইবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর পথে, আল্লাহর সাথে কুফুরকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, খেয়ানত করবে না, কোন নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং গীর্জায় অবস্থানকারী দুনিয়া পরিত্যাগকারীকে হত্যা করবে না। খেজুর এবং অন্য কোন গাছ কাটবে না, কোন অট্টালিকা ধ্বংস করবে না। ইসলামী বাহিনীর রওয়ানা


ইসলামী বাহিনী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণ মুসলমানরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোনীত সেনানায়কদের সালাম এবং বিদায় জানান। সেই সময় অন্যতম সেনানায়ক হযরত আবুদল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) কাঁদছিলেন। তাঁকে এ সময়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ বা তোমাদের সাথে সম্পর্কের কারণে আমি কাঁদছি না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাক কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনে জাহান্নামের ভয়ে আমি কাঁদছি। সেই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমাদের প্রতেকেই তা অতিক্রম করবে, এটা তোমাদের প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।' (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭১)


আমি জানি না যে, জাহান্নামে পেশ করার পর ফিরে আসব কিভাবে? মুসলমানরা বললেন, আল্লাহ তায়ালা সালামতির সাথে আপনাদের সঙ্গী হোন। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের হেফাযত করুন এবং গনীমতের মালসহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনুন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) তখন এই কবিতা আবৃত্তি করেন,


রহমানের কাছে মাগফেরাতের জন্যে

মগয বের করা তলোয়ারের আঘাতের জন্যে

বর্শা নিক্ষেপকারীর হাত, অন্ত্র কলিজা

চিরে ফেলা আঘাত করার শক্তি দানের জন্যে

সাহায্য চাই। আমার কবরের পাশ দিয়ে

যাবে যারা তারা বলবে এই সেই গাজী যাকে আল্লাহ হেদায়াত দিয়েছেন এবং যিনি হেদায়াত প্রাপ্ত।


মুসলিম সৈন্যরা এরপর রওয়ানা হয়ে যান। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছানিয়াতুল অদা পর্যন্ত সেনাদলের সঙ্গে গিয়ে সৈন্যদের বিদায় জানান । 


মুসলিম বাহিনীর সঙ্কট- উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মুসলিম সৈন্যরা মাআন নামক এলাকায় পৌঁছুলেন। এ স্থান ছিলো হেজাজের সাথে সংশ্লিষ্ট জর্দানী এলাকায়। মুসলিম বাহিনী এখানে এসে অবস্থান নেন। মুসলিম গুপ্তচররা এসে খবর দিলেন যে, রোমের কায়সার বালকা অঞ্চলের মাআব এলাকায় এক লাখ রোমক সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছে। এছাড়া তাদের পতাকাতলে লাখাম, জাজাম, বলকিন, বাহরা এবং বালা গোত্রের আরো এক লাখ সৈন্য সমবেত হয়েছিলো। উল্লিখিত শেষোক্ত এক লাখ ছিলো আরব গোত্রসমূহের সমন্বিত সেনাদল ।


মুতার যুদ্ধের প্রান্তরের চিত্র।
মুতার যুদ্ধ এখানেই সংগঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুতার যুদ্ধের প্রান্তর

মজলিসে শূরার বৈঠক- মুসলমানরা ধারণাই করতে পারেননি যে, তারা কোন দুর্ধর্ষ সেনাদলের সম্মুখীন হবেন। দূরবর্তী এলাকায় তারা সত্যিই সঙ্কটজনক অবস্থার সম্মুখীন হলেন। তাদের সামনে এ প্রশ্ন মূর্ত হয়ে দেখা দিল যে, তারা কি তিন হাজার সৈন্যসহ দুই লাখ সৈন্যের দুর্ধর্ষ সৈন্যের সাথে মোকাবেলা করবেন? বিস্মিত চিন্তিত মুসলমানরা দুইরাত পর্যন্ত পরামর্শ করলেন। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিঠি লিখে উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হোক। এরপর তিনি হয়তো বাড়তি সৈন্য পাঠাবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন। সেই নির্দেশ তখন পালন করা যাবে।


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) দৃঢ়তার সাথে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, 'হে লোক সকল, আপনারা যা এড়াতে চাইছেন এটাতো সেই শাহাদাত, যার জন্যে আপনারা বেরিয়েছেন। স্মরণ রাখবেন যে, শত্রুদের সাথে আমাদের মোকাবেলার মাপকাঠি সৈন্যদল, শক্তি এবং সংখ্যাধিক্যের নিরিখে বিচার্য নয়। আমরা সেই দ্বীনের জন্যেই লড়াই করি, যে দ্বীন দ্বারা আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। কাজেই সামনের দিকে চলুন। আমরা দুইটি কল্যাণের মধ্যে একটি অবশ্যই লাভ করবো। হয়তো আমরা জয়লাভ করবো অথবা শাহাদাত বরণ করে জীবন ধন্য হবে। অবশেষে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহার মতামতের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো


মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা- মাআন নামক এলাকায় দুই রাত অতিবাহিত করার পর মুসলিম বাহিনী শত্রুদের প্রতি অগ্রসর হলেন। বালকার মাশারেফ নামক জায়গায় তারা হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদের মুখোমুখি হলেন। শত্রুরা আরো এগিয়ে এলে মুসলমানরা মুতা নামক জায়গায় গিয়ে সমবেত হন। এরপর যুদ্ধের জন্যে সৈন্যদের বিন্যস্ত করা হয়। ডানদিকে কোতাবা ইবনে কাতাদা আজরিকে এবং বামদিকে ওবাদা ইবনে মালেক আনসারী (রা.)-কে নিযুক্ত করা হয়।


সেনা নায়কদের শাহাদাত- মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে অত্যন্ত তিক্ত লড়াই হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিস্ময়কর ছিলো এ যুদ্ধ। দুনিয়ার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ঈমানের বাহাদুরি চলতে থাকলে এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে।


সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা.) পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত করণ করেন। এ ধরনের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি।


হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তাঁর ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। বাঁ হাত কেটে গেলে দুই বাহু দিয়ে ইসলামের পতাকা বুকের সাথে জড়িয়ে রাখেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।


The tomb of Muslim commanders Zayd ibn Harithah, Ja'far ibn Abi Talib, and Abd Allah ibn Rawahah in Al-Mazar near Mu'tah, Jordan
মুসলিম সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারেসা, জাফর ইবনে আবু তালিব ও আবু আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এর মাজার, জর্ডানের মুতার যুদ্ধের প্রান্তরে অবস্থিত

বলা হয়ে থাকে যে, একজন রোমক সৈন্য তরবারি দিয়ে তাকে এমন আঘাত করে যে, তার দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বেহেশতে দুটি পাখা দান করেছিলেন। সেই পাখার সাহায্যে তিনি জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা উড়ে বেড়ান। এ কারণে তাঁর উপাধি 'জাফর' তাইয়ার' এবং জাফর যুল জানাহাইন। তাইয়ার অর্থ উড্ডয়নকারী আর যুল জানাহাইন অর্থ দুই পাখাওয়ালা।


ইমাম বোখারী নাফে-এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধের দিনে হযরত জাফর শহীদ হওয়ার পর আমি তার দেহে আঘাতের চিহ্নগুলো গুণে দেখেছি। তাঁর দেহে তীর ও তলোয়ারের পঞ্চাশটি আঘাত ছিলো। এ সব আঘাতের একটিরও পেছনের দিকে ছিলো না।


অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গে ছিলাম। জাফর ইবনে আবু তালেবকে সন্ধান করে নিহতদের মধ্যে তাদেরকে পেয়ে যাই। তাঁর দেহে বর্শা ও তীরের ৯০টির বেশী আঘাত দেখেছি। নাফে থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ইবনে ওমরের বর্ণনায় এও আছে যে, আমি এসকল জখম লক্ষ্য করেছি তাঁর দেহের সম্মুখভাগে 


বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত জাফর (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) পতাকা গ্রহণ করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সামনে অগ্রসর হন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেন,


ওরে মন খুশী বেজার যেভাবে হোক

মোকাবেলা কর। যুদ্ধের আগুন জ্বেলেছে ওরা

বর্শা রেখেছে খাড়া। জান্নাত থেকে কেনরে তুই থাকতে চাস দূরে?’


এরপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর চাচাতো ভাই গোশত লেগে থাকা একটা হাড় তাঁর হাতে দেন। তিনি এক কামড় খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেন। এরপর লড়াই করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।


আল্লাহর তলোয়ার খালিদ বিন ওয়ালিদ- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহার শাহাদাতের পর বনু আযলান গোত্রের ছাবেত ইবনে আরকাম নামক একজন সাহাবী পতাকা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, হে মুসলমানরা, তোমরা উপযুক্ত একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দাও। সাহাবারা ছাবেতকেই সেনাপতির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেন, আমি একাজের উপযুক্ত নই। এরপর সাহাবারা হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি পতাকা গ্রহণের পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহীহ বোখারীতে স্বয়ং খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো। অপর এক বর্ণনায় তাঁর যবানীতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, আমার হাতে মুতার যুদ্ধের দিনে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে এবং একটি ছোট সাইজের ইয়েমেনী তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।


এদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, যায়েদ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর জাফর পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীদ হন। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীদ হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ারসমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার। তাঁর যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জয়যুক্ত করেন।


যুদ্ধের সমাপ্তি- বীরত্ব, বাহাদুরি ও নিবেদিত চিত্ততা সত্তেও মুসলমানদের মাত্র তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সামনে টিকে থাকা ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ এ (রা.) সময়ে যে বীরত্বের পরিচয় দেন, ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না।


মুতার প্রান্তর Site of battle of mutah

এ যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। সকল বর্ণনা পাঠ করার পর জানা যায় যে, যুদ্ধের প্রথম দিন শেষ পর্যায়ে হযরত খালেদ (রা.) রোমক সৈন্যদের মোকাবেলায় অবিচল ছিলেন। তিনি সেই সময় এক নতুন যুদ্ধকৌশলের কথা ভাবছিলেন, যাতে রোমকদের প্রভাবিত করা যায়। সেই কৌশলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুসলমানদের পিছিয়ে নেয়াই ছিলো উদ্দেশ্য । তবে, কোন অবস্থায়ই রোমকরা যেন ধাওয়া করতে না পারে, সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা রোমকরা ধাওয়া করলে তাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া হবে খুবই কঠিন।


পরদিন সকালে হযরত খালেদ (রা.) সেনাদল রদবদল করে বিন্যস্ত করলেন। ডানদিকের সৈন্যদের বাঁ দিকে এবং বাঁদিকের সৈন্যদের ডানদিকে মোতায়েন করলেন। পেছনের সৈন্যদের সামনে আর সামনের সৈন্যদের পেছনে নিয়ে গেলেন। এরূপ অদল বদলের দৃশ্য থেকে শত্রুরা বলাবলি করতে লাগলো যে, মুসলমানরা সহায়ক সৈন্য পেয়েছে, তাদের শক্তি পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে।


সেনা বিন্যাস অদল বদল করে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) মুসলমানদের ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিলেন। রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো না কারণ তারা তখন ভাবছিলো যে, মুসলমানরা ধোঁকা দিচ্ছে। তারা মরুপ্রান্তরে নিয়ে পাল্টা হামলা করে পর্যুদস্ত করবে। এরূপ চিন্তা করে রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের ধাওয়া না করে নিজেদের এলাকায় ফিরে গেলো। এদিকে মুসলমানরা পিছাতে পিছাতে মদীনায় গিয়ে পৌঁছালেন।


মুতার যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা- মুতার যুদ্ধে ১২ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। রামকদের মধ্যে কতোসংখ্যক হতাহত হয়েছে তার বিবরণ জানা যায়নি। তবে যুদ্ধের বিবরণ পাঠে বোঝা যায় যে, তাদের বহু হতাহত হয়েছে। কেননা, একমাত্র হযরত খালেদের হাতেই ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছিলো। এতেই শত্রু সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা সহজেই আন্দাজ করা যায়। 


মুতার যুদ্ধের প্রভাব- যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। সমগ্র আরব জগত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, রোমকরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আররা মনে করতো যে, রোমকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। কাজেই, উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য দুই লাখ সৈন্যের মোকাবেলায় সাহসিকতাপূর্ণ বিজয় গৌরব সহজ কথা নয়। আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইতিপূর্বে পরিচিত সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহর সাহায্য মুসলমানদের সাথে রয়েছে। তাদের নেতা মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃসন্দেহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কারণেই দেখা যায় যে, মুসলমানদের চিরশত্রু জেদী ও অহংকারী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছুসংখ্যক গোত্র মুতার যুদ্ধের পর ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোত্র হচ্ছে, বনু ছালিম, আশজা, গাতফান, জিবান ও ফাজারাহ। মুতার যুদ্ধের প্রাক্কালে রোমকদের সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়েছিলো এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের বিজয় গৌরব দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করে। 


উপরের সম্পুর্ন লেখাটি নেওয়া হয়েছে আর-রাহেকুল মাখতুম নামক বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ থেকে। উল্লেখ্য রাবেতায়ে আলামে ইসলামী আয়োজিত বিশ্বব্যাপী সিরাতুননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিযোগিতায় ১১৮২ টি গ্রন্থের মধ্যে উক্ত বইটি প্রথম স্থান অর্জন করে। পাঠকরা বইটি পড়ে সিরাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন এবং সঠিক তথ্য পাবেন ইনশাআল্লাহ। বইটি সারা বাংলাদেশ ব্যাপি অনলাইন ও অফলাইনে কিনতে পারবেন।  

Previous Post Next Post