তায়েফের যুদ্ধ : আনসারদের প্রতি সুসংবাদ

তায়েফের যুদ্ধ


তায়েফের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে হোনায়েনের যুদ্ধেরই অংশ। হাওয়াযেন ও ছাকিফ গোত্রের পরাজিত লোকদের অধিকাংশই তাদের কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ নসরীর সাথে তায়েফে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।


প্রথমে খালেদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়, এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রওয়ানা হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং কারণ মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালেক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেই দুর্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তায়েফ পৌছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ দুর্গ অবরোধ করেন। অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাসের (রা.) বর্ণনা অনুযায়ী এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। কোন কোন সীরাত রচয়িতা ২০ দিন বলেও উল্লেখ করেছেন। কেউ ১০ কেউ ১৫ আবার কেউ ১৮ দিন উল্লেখ করেছেন। 


অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। মুসলমানদের প্রথম অবরোধকালে তাদের ওপর লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশী তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে কয়েকজন মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।


তায়েফ মসজিদ বা হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু মসজিদ
তায়েফে অবস্থিত মসজিদুত তায়েফ বা হযরত আলি মসজিদ

নবী (সাঃ) সেখান থেকে সরে এসে তায়েফের ঐ স্থানে চলে আসলেন, যেখানে বর্তমানে ‘মসজিদুত্ তায়েফ’ তথা তায়েফের মসজিদ অবস্থিত। নবী (সাঃ) তাদেরকে ১৮ দিন মতান্তরে ২৩ দিন অবরোধ করে রাখলেন। এ সময় মুসলিমগণ তাদের বিরুদ্ধে মিনজানিক (প্রাচীন ক্ষেপণাস্ত্রবিশেষ) দিয়ে আক্রমণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরণের অস্ত্রের এটিই ছিল প্রথম ব্যবহার। ঐ দিকে নাবী (সাঃ) মুসলমানদেরকে সেখানকার আঙ্গুরের বাগানগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ রসূল (সাঃ) এর আদেশ তামিল করতে গিয়ে দ্রুত কাফেরদের বাগানগুলো কাটতে লাগলেন।


এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করে দুর্গ লক্ষ্য করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।


রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত ছকিফ গোত্র আল্লাহ তায়ালা এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মঞ্জুর করলেন।


অবরোধের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলো যে, যে ক্রীতদাস দুর্গ থেকে নেমে আমাদের কাছে আসবে, সে মুক্ত। এতে ত্রিশজন লোক দূর্গ থেকে এসে মুসলমানদের সাথে শামিল হয়। 


তায়েফের যুদ্ধ। তায়েফ ময়দানের অবস্থিত কাফেরদের দূর্গের ছবি
এই দুর্গগুলো শহরের বাসিন্দাদের আবাসের জন্যই শুধু নয়, বরং যেকোনো অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত আক্রমণ হতে শহরবাসীকে রক্ষার জন্য একদল দক্ষ লোক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

আগত ক্রীতদাসদের মধ্যে হযরত আবু বকরাহ'ও ছিলেন। দুর্গের দেয়ালে উঠে ঘূর্ণায়মান চরকার মাধ্যমে তিনি নীচের দিকে ঝুলে পড়েন এবং মুসলমানদের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেন। আরবী ভাষায় ঘারাবিকে বকরাহ বলা হয়। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগন্তুক এ ক্রীতদাসের উপাধি দিলেন আবু বকরাহ। কথা অনুযায়ী মুসলমানের কাছে এসে আত্মসমর্পণকারী ক্রীতদাসদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত করে দিলেন এবং তাদেরকে ত্রিশজন সাহাবীর দায়িত্বে দিয়ে বললেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে দাও। এ ঘটনা দুর্গের শত্রুদের জন্যে বড়োই মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালো।


অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লো এবং শত্রুদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নওফেল বিনে মাবিয়া দয়লির সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বললেন, শৃগাল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন। আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবরোধ অবসানের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত ওমর (রা.) সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, ইনশাল্লাহ আগামী কাল আমরা ফিরে যাব সাহাবারা এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিরে যাব? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের ভিন্নমত শুনে বললেন আচ্ছা তাহলে কাল সকালে যুদ্ধে চলো। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু আঘাত খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোন লাভ হলো না। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশাল্লাহ আগামী কাল আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। 


তায়েফের প্রান্তরের মানচিত্র
তায়েফের মানচিত্র

এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসতে লাগলেন। সাহাবায়ে কেরাম ফিরে যাওয়ার পথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'আয়েবুনা তায়েবুনা আবেদুনা লেরাব্বেনা হামেদুন।' অর্থাৎ তোমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী এবাদাতগুজার এবং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রশংসা করে থাকো।


সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাকিফের লোকদের জন্যে বদদোয়া করুন তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা ছাকিফকে হেদায়াত করুন এবং তাদের নিয়ে আসুন।


যেরানায় গনীমতের মাল বন্টনঃ

তায়েফ থেকে অবরোধ তুলে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেরানায় সঞ্চিত গনীমতের মাল ভাগ বাটোয়ারা করা থেকে বিরত থাকলেন। এ দেরীর কারণ ছিলো এই যে, তিনি চাচ্ছিলেন, হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা ফিরে এসে তওবা করলে তিনি তাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু অপেক্ষা করার পরও কেউ আসলো না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল বন্টন করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন গোত্রের সর্দার এবং মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ গনীমতের মাল পাওয়ার আশায় উন্মুখ ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল নবদীক্ষিত মুসলমানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গনীমতের মাল প্রদান করলেন। 


আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে ৪০ উকিয়া অর্থাৎ প্রায় ৬ কিলো রূপা অর্থাৎ চাঁদি এবং একশত উট দেয়া হলো। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র ইয়াযিদ? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াযিদেকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র মুয়াবিয়া? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। মোটকথা একমাত্র আবু সুফিয়ান এবং তার দুইপুত্রকে প্রদান করা হলো ১৮ কিলো চাঁদি এবং তিনশত উট। হাকিম ইবনে হাজামকে একশত উট প্রদান করা হলো। এরপর আরো চাইলে আরো একশত


উট দেয়া হলো। সফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে তিনবার একশত করে উট দেয়া হলো। অর্থাৎ তাকে তিনশত উট দেয়া হলো। হারেছ ইবনে কালদাকে একশত উট দেয়া হলো। কোরায়শ এবং কোরায়শ নয় এমন সকল গোত্রীয় নেতাকে কাউকে একশত, কাউকে পঞ্চাশ এবং কাউকে চল্লিশটি করে উট দেয়া হলো । লোকদের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতো এতো দান করেন যে, তিনি দারিদ্র্যের আশঙ্কা করেন না। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেদুইনরা এসে আল্লাহ রসূলকে ঘিরে ধরলো এবং তাঁকে একটি গাছের কাছে নিয়ে গেলো। তাদের ভিড়ের চোটে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর গাছের মধ্যে থেকে গেলো। তিনি বললেন, হে লোক সকল, আমার চাদর দিয়ে দাও।


সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি তোহামার বৃক্ষরাজির সংখ্যার সমান চতুষ্পদ জন্তুও আমার কাছে থাকে, তবুও আমি সব বন্টন করে দেবো। এরপর তোমরা দেখবে, আমি কৃপণ নই, ভীত নই, মিথ্যাবাদী নই।১১ এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের উটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার কয়েকটি লোম তুলে নিয়ে দেখিয়ে বললেন, হে লোক সকল, তোমাদের ‘ফাঈ' মালামালের মধ্য থেকে আমার জন্যে কিছু নেই। এমনকি এই যে উটের পশম দেখছো, এই পরিমাণও নেই শুধুমাত্র খুমুস রয়েছে, অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মাথাপিছু বন্টনে এক পঞ্চামাংশের অংশ বিশেষ সেই খুমুসও তোমাদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয় ।


তায়েফের ময়দান মানচিত্র


নবদীক্ষিত মুসলমানদের দেয়া হলো, যাদেরকে কোরআনে 'মোয়াল্লেফাতুল কুলুব' বলা হয়েছে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেতকে বললেন, “তিনি যেন গনীমতের মাল এবং সৈন্যদের এক জায়গায় করে বন্টনের হিসাব করেন। তিনি তাই করলেন। তে প্রত্যেক সৈন্যের ভাগে চারটি উট এবং ৪০টি বকরি পড়লো। বিশিষ্ট যোদ্ধারা পলেন ১২টি করে উট এবং ১২টি করে বকরি।


এ বন্টনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। কেননা, পৃথিবীতে বহু লোক এমন রয়েছে যারা নিজের বিবেকের পথে নয় বরং পেটের পথে চলে । পশুর সামনে একমুঠো তাজা ঘাস ঝুলিয়ে পিছনে সরে গিয়ে গিয়ে তাকে যেমন নিরাপদ ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া যায় তেমনি উল্লিখিত সম্পদ বন্টনের দ্বারা নবদীক্ষিত মুসলমানদের মন জয়ের চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে তারা ঈমান শেখার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত হয়।


আনসারদের মানসিক অবস্থাঃ

যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিতরণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাজনৈতিক কৌশল প্রথমে বোঝা যায়নি। এ কারণে কিছু লোক সমালোচনা করছিলেন। বিশেষত আনসারদের মন খারাপ হয়েছিলো। কেননা তাদেরকে কিছুই দেয়া হয়নি। অথচ সঙ্কটকালে তাদের ডাকা হয়েছিলো এবং তারা দ্রুত হাযির হয়েছিলেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে, দৃশ্যমান পরাজয় বিজয়ে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু গনীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য করলেন যে, সঙ্কটের সময় পলায়নকারীদের হাত পরিপূর্ণ, অথচ তাদের হাত খালি।


ইবনে ইসহাক আবু সাইদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোরায়শ এবং আরবের গোত্রীয় নেতাদের অধিক দান করলেন থচ আনসারদের কিছুই দিলেন না, তখন তাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করলেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, আল্লাহর কসম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু মালাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন। হযরত সা'দ ইবনে ওবাদা (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে আপনি যা করেছেন, এতে আনসাররা খুশী হয়নি। তারা সমালোচনা করছে। তারা বলছে, আপনি শুধু নিজের কওমের মধ্যেই সম্পদ বন্টন করেছেন। আরব গোত্রদের বিশেষভাবে দান করেছেন। অথচ আনসারদের কিছুই দেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে সা’দ, এ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? তিনি বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমিও তো আমার কওমেরই একজন। প্রিয় নবী বললেন, যাও তোমার কওমের লোকদের এক জায়গায় একত্রিত করো। সা’দ তাই করলেন। কয়েকজন মোহাজের এলেন, তাদেরও বসতে দেয়া হলো। অন্য কিছু লোক এলো, তাদের ফিরিয়ে দেয়া হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর জানানো হলো যে, ওরা হাযির হয়েছেন। তিনি তখন তাদের কাছে গেলেন।


তায়েফের যুদ্ধ। তায়েফের ময়দান এর চিত্র
তায়েফের ঘটনা চিত্র। হুনাইন প্রান্তর ও তায়েফ ময়দানের মানচিত্র

আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করার পর প্রিয়নবী বললেন, 'হে আনসাররা, তোমাদের অসন্তোষ তোমাদের সমালোচনার কারণ কি? আমি কি তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় যাইনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? আল্লাহ তায়ালা এরপর তোমাদের হেদায়াত দিলেন। তোমরা ছিলে পরমুখাপেক্ষি, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন। তোমাদের পরস্পর অন্তর জোড়া লাগিয়ে দিয়েছেন। এসব কি ঠিক নয়? তারা বললেন, হাঁ, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক দয়া। তিনি বললেন, আনসাররা জবাব দিচ্ছ না কেন? তারা বললেন আমরা কি জবাব দেবো? আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বড় দয়া আমাদের ওপর। তিনি বললেন, যদি তোমরা ইচ্ছা করো তবে একথা বলতে পারো যে, আপনি আমাদের কাছে এমন সময়ে এসেছিলেন যখন আপনাকে অবিশ্বাস করা হয়েছিলো, সে সময় আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনাকে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো সে সময় আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। আপনাকে উপেক্ষা করা হয়েছিলো, আমরা আপনাকে ঠিকানা দিয়েছি। আপনি মোহতাজ ছিলেন, আমরা আপনার দুঃখ লাঘব করেছি।


রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আনসাররা, তোমরা দুনিয়ায় তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্যে মনে মনে নাখোশ হয়েছো। সেই জিনিসের মাধ্যমে আমি কিছু লোকের মনে প্রবোধ দিয়েছি, যেন তারা মুসলমান হয়ে যায়। তোমাদেরকে তোমাদের গৃহীত ইসলামের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। হে আনসাররা, তোমরা কি এতে খুশী নও যে, অন্যরা উট বকরি নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরবে? সেই যাতে-পাকের শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি হিজরতের ঘটনা ঘটতো, তবে আমিও একজন আনসার হতাম। যদি সব লোক এক পথে চলে, আর আনসাররা অন্য পথে চলে, তবে আমি আনসারদের পথেই চলবো। হে আল্লাহ তায়ালা আনসারদের ওপর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং তাদের পৌত্র পোত্রীদের প্রতি রহমত করুন।


রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষণ শুনে লোকেরা এতোবেশী কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে গেলো। তারা বলতে লাগলেন, আমাদের অংশে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকবেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে গেলেন এবং সাহাবারা নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন ।


হাওয়াযেন প্রতিনিধি দলের আগমনঃ

গনীমতের মালামাল বন্টনের পর হাওয়াযেন গোত্রের একদল প্রতিনিধি মুসলমান হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন তারা ছিলেন চৌদ্দজন। যোহায়ের ইবনে ছুরাদ ছিলেন তাদের নেতা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেজায়ী চাচা আবু বারকানও তাদের মধ্যে ছিলেন। তারা এসে যুদ্ধবন্দী এবং মালামাল ফেরত চাইলেন। তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, সকলের মন নরম হয়ে গেলো। ১৫ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার সাথে যেসব লোক রয়েছে, তোমরা তাদের দেখতে পাচ্ছো। সত্য কথা আমি বেশী পছন্দ করি। সত্যি করে বলো, তোমরা নিজের সন্তান-সন্তুতিকে বেশী ভালোবাসো নাকি ধন সম্পদ?


তারা বললেন, পারিবারিক মর্যাদার মূল্যই আমাদের কাছে বেশী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, আমি যোহরের নামায আদায়ের পর তোমরা উঠে বলবে যে, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মোমেনীনদের পক্ষে সুপারিশকারী এবং মোমেনীনদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে সুপারিশকারী বানাচ্ছি। কাজেই আমাদের কয়েদীদের ফিরিয়ে দিন।


যোহরের নামাযের পর তারা সেকথা বললেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার নিজের এবং বনু আবদুল মোত্তালেবের অংশ তোমাদের জন্যে। আমি এখনই অন্য লোকদের জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। সাথে সাথে আনসার এবং মোহাজেররা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমাদের যা কিছু রয়েছে, সেইসবও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে । এরপর আকরা ইবনে হাবেস উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যা কিছু আমার এবং বনু তামিমের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। উত্তায়না বিন হিস্‌ বললো, যা কিছু আমার এবং বনু ফাজারাদের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। আব্বাস ইবনে মায়দাস বললো, যা কিছু আমার এবং বনু সালিমের রয়েছে সেসবও আপনার জন্যে নয়। বনু সালিম গোত্রের লোকেরা দাঁড়িয়ে বললো, জ্বী না; বরং যা কিছু আমাদের রয়েছে, সেসবই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে একথা শুনে আব্বাস ইবনে মারদাস বললো, তোমরা আমাকে অপমান করেছো।


রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দেখো ওরা মুসলমান হয়ে এসেছে। এ কারণে আমি তাদের বন্দীদের বন্টনে দেরী করেছি। এরপর আমি তাদের মতামত জানতে চেয়েছি তারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে অধিক প্রাধ্যান্য দিয়েছে। কাজেই যাদের কাছে বন্দী রয়েছে তারা যেন ফিরিয়ে দেয়। এটা খুব ভালো হবে। যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য অংশ রাখতে চায়, সেও যেন অন্তত কয়েদীদের ফিরিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে যখন ‘ফাঈ'-এর মাল পাওয়া যাবে, এর বিনিময়ে তাদের ছয়গুণ দেয়া হবে। লোকেরা বললো, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে সব কিছু সানন্দে দিতে রাযি আছি।

Previous Post Next Post