আবু যার আল-গিফারী : গিফারের বাতিঘর

আবু যার রাদিআল্লাহু আনহু

ইসলামের ইতিহাসের অনন্য এক নাম আবু যার গিফারী কী ছিল তাঁর ইসলামে আসার কাহিনি? ইমাম আহমেদ থেকে বর্ণিত হয় আবু যারের ভাষ্যে,


আমরা ছেড়ে চলে এলাম আমাদের গিফার শহর। ছোট থেকে যেখানে বড়ো হয়েছি, শেষপর্যন্ত সেই গিফার ছাড়তে বাধ্য হলাম। মা আর ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নতুন কোনো গন্তব্যের আশায়। গিফারের লোকেরা বড্ড বাড়াবাড়ি করছিল। পবিত্র মাসেও তাদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকো আশহুরুল হারামের এই অপমান আর সহ্য করা আশহরূপ হারাম হলো সেই চার মাস, যেগুলোকে আরবের লোকেরা পবিত্র মাস বলে গণ্য করতো। এ সময় তারা যুদ্ধবির সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য, এই চার মাসে কোনোপ্রকার হত্যা বা পুরোপুনি করা যাবে না। এই চার মাসের মর্যাদা কেউ ক্ষুন্য করবে না। তবে গিফারের লোকেরা ব্যতিক্রম। লুটপাট, হানাহানি করাই তাদের পেশা। এসব পবিত্র মাস বা প্রচলিত নিয়মনীতির ধার ধরতো না তারা। কাফেলা আক্রমণ, চুরি, হত্যা, এটি তাদের কাজ। তাদের অপকর্মের ফলে সারা আরব জুড়ে তাদের দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে।


ইসলাম গ্রহণের আগেও আবু যার গোত্রের এই অপরাধপ্রবণ জীবন পছন্দ করতেন না। সবার কাছে যা পার্নিভাত, আবু যার শিক্ষারীর কাছে সেটাই গর্হিত অপরাধ। তিনি যেন নিজ ভূমে পরবাসী। তাই এক সময় পরিবারসহ গিফার ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দেখা করলেন তাঁর চাচার সাথে তাঁর চাচা অন্য গোত্রের সদস্য। আবু যারের ভাষায়, 'চাচা আমাদের প্রতি খুবই দয়ালু এবং যত্নবান ছিলেন। কিন্তু তাদের প্রতি চাচার এই বিশেষ যত্নমাত্তি ও মেহমানদারি বাকি আত্মীয় স্বজনদের সহ্য হচ্ছিল না, তারা তাদেরকে কিনা করতো। একদিন সুযোগ বুঝে আবু যারের চাচার কানে বিষ ঢেলে দিলো। বললো, আপনি যখন এখানে থাকেন না, সেই সুযোগে আবু যারের ভাই উনাইস আপনার স্ত্রীর সাথে দেখাসাক্ষাত করে, আপনার বউয়ের ব্যাপারে তার বেশ আগ্রহ। চাচা আগে-পিছে কিছু বিবেচনা না করে সোজা আবু যার ও তার ভাই উনাইসের কাছে হাজির হলো। তাদেরকে এইসব বিষাক্ত কথা শুনিয়ে ছাড়লেন। আবু যার তার চাচার মুখে এসব কথা শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হন। বললেন, 'চাচা, আপনার দীর্ঘদিনের যত্নআত্তি আর উত্তম আচরণ সবই আজ বরবাদ হয়ে গেল। আপনি কীভাবে পারলেন আমাদের বিরুদ্ধে এমন একটা অভিযোগ তুলতে! আপনার এত দয়ার আর কোনো মূল্য থাকলো না। এই বলে তারা শীঘ্রই গোছগাছ করে চাচার বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন।


‘চাচা আমার কথায় খুব দুঃখ পেলেন, উনার চিন্তাশক্তি ফিরে এলো। উনি এসব কথা তোলার জন্য আফসোস করতে লাগলেন। কাপড়ে মুখ ঢেকে খুব কাঁদছিলেন চাচা। কিন্তু আমাদের রাগ কমলো না, এমন অভিযোগের পর থাকা যায় না, তাই সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে সেখান থেকে চলে এলাম।


এরপর আবু যারের পরিবার মক্কার কাছাকাছি একটি অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। আবু যার বর্ণনা করেন, 'আমার ভাই উনাইস ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মক্কায় যায়। সেখানে তার সাথে এক লোকের দেখা হয়। সে নিজেকে নবী দাবি করছিল। উনাইস ফিরে এসে বললো, আমার সাথে আজ এক লোকের সাক্ষাৎ হয়েছে, তিনি এক নতুন দ্বীন প্রচার করছেন। তিনি একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেন। আমি বললাম, আরে, আমি তো ইতিমধ্যেই অন্য সকল প্রকার মূর্তি ও দেব দেবীর পূজা বাদ দিয়েছি। তিন বছর যাবৎ কেবল এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত করছি।”


আবু যারের মতো মানুষগুলোর ফিতরাহ ছিল বিশুদ্ধ, তাদের জন্মগত স্বভাব ও প্রকৃতিই তাদেরকে বলে দিত যে, কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল। আবু যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘তুমি কীভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করতে?” তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে যে দিকে ফিরে দুআ করার নির্দেশ দিতেন, আমি সেদিকেই ফিরে দুআ করতাম। আল্লাহ আমাকে যে ভাবে দুআ করতে বলেন, আমি সেভাবে দুআ করতাম। আর আমি রাতভর দুআ করে যেতাম যতক্ষণ না ঘুম এসে আমাকে আচ্ছন্ন করে নেয় আর এরপর সূর্যের আলোয় আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি।


আবু যার তাঁর ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, ‘সেই মানুষটি কী শেখান?? উত্তরে উনাইস আবু যারকে ইসলামের কিছু শিক্ষার কথা বলেন। তিনি নবীজির কাছ থেকে সেগুলো শিখেছিলেন। এরপর আবু যার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকেরা তাঁর সম্পর্কে কী বলে?”


- লোকেরা বলে সে একজন জাদুকর, গণক, মিথ্যাবাদী।


- নাহ, তুমি আমার কৌতূহল মেটাতে পারছো না! আমি নিজেই যাবো তাঁর সাথে দেখা করতে। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে যা বলে, তা সত্য নাও হতে পারে।


আবু যার মক্কার ‘সিএনএন’ বা ‘বিবিসি’-র ওপর ভরসা করে থাকেননি। তিনি নিজে গিয়ে রাসূলুল্লাহর ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 'আমি মক্কায় পৌঁছে যাকে প্রথমে সামনে পেলাম, তাকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, তুমি কি আমাকে মুহাম্মাদের কাছে নিয়ে যেতে পারবে? – কথা নেই, বার্তা নেই, সেই লোক সজোরে চিৎকার করে কুরাইশদের জড়ো করে ফেললো! কুরাইশরা এসে আমার ওপর অতর্কিত মারতে শুরু করলো। পাথর, নুড়ি, হাতের কাছে যে যা পাচ্ছিলো তাই নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়তে থাকে, একসময় আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরলো, আমার তখন নুসুব আহমারের মতো অবস্থা!


নুসুব আহমার হলো সেই পাথর যার ওপর কুরাইশরা তাদের দেব দেবীর নামে পশু বলি দিতো, ফলে পাথরটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে থাকতো। মার খাওয়ার পর আবু যারের শরীরের অবস্থা হয়েছিল ওই পাথরের মত।


‘আমি যমযম কূপের কাছে গিয়ে সেখান থেকে পানি খেলাম, আর যমযমের পানি দিয়ে গায়ের রক্ত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করলাম। এরপর আমি কাবার পাশে গেলাম।' ইমাম আহমেদের বর্ণনায় আছে যে আবু যার সেখানে তিরিশ দিন অবস্থান করেন। কেননা তিনি জানতেন না কোথায় রাসূলুল্লাহর দেখা পাওয়া যাবে। আবু যার বলেন, ‘পুরো সময়টাতে আমার কাছে যমযমের পানি ছাড়া আর কোনো খাবার ছিল না। খাবার ছাড়া ত্রিশ দিন বেঁচে থাকা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়, তবে আবু যারের সাথে যা হয়েছিল তা হয়েছিল যমযমের পানির বরকতের কারণে। মজার ব্যাপার হলো, আবু যার বলেন, 'সে সময় আমার ওজন বাড়তে থাকে, আমার স্বাস্থ্য এত  ভালো হয়ে গেলো যে, আমার পেটে ভাঁজ পড়ে যায়!


‘একদিন দেখতে পেলাম দু'জন মহিলা, কাবার চারপাশে তাওয়াফ করছে। প্রত্যেক চক্করে চক্করে তারা ইসাফ আর নাইলা পাথরকে স্পর্শ করছিল।' ইসাফ আর নাইলা। নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত। তারা ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা, বিয়ে করেনি। একদিন দুজনে কাবার পাশে দেখা করে আর আল্লাহ তাআলার ঘরের পাশে তারা পরস্পরের সাথে যিনা করার ইচ্ছা করে! ওই অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পাথরে পরিণত করেন। অথচ, কালের পরিক্রমায়, মক্কার মুশরিকরা তাদের এই মূর্তিগুলোর উপাসনা শুরু করে। এভাবেই শয়তান মানুষকে অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে, খারাপ কাজগুলোকে তাদের সামনে অতি মোহনীয় মোড়কে সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করে।


মূর্তি পূজার সূচনাও হয় এভাবে। পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম যে মানুষগুলোর মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল, তারা আদতে খারাপ লোক নয়, বরং সৎকর্মশীল মানুষ ছিলেন। নূহের জাতি থেকে যখন নেককার লোকেদের মৃত্যু হলো, তখন শয়তান এসে মানুষদের বলতে থাকে, ‘তোমরা তাদের মূর্তি তৈরি করলেই তো পারো, ওদের মূর্তি দেখে তোমাদের আল্লাহর কথা, ভালো কাজ করার কথা মনে পড়বে। ফলে লোকেরা ‘ভালো নিয়তে’ তাদের মূর্তি গড়ে শয়তানের প্রথম পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এর কয়েক প্রজন্ম পরে সবাই যখন ভুলে গেল এই মূর্তি কেন তৈরি করা হয়েছিল, কী এদের উদ্দেশ্য। তখন শয়তান এসে বললো এই মূর্তিগুলোই পূজা করতে। এভাবে আস্তে আস্তে তারা মূর্তিপূজা আরম্ভ করে।


তবে আবু যার বরাবরই মূর্তিপূজার ঘোরবিরোধী। তিনি কাবার পাশে এমন মূর্তিপূজা দেখে আর চুপ থাকতে পারলেন না। মহিলা দুটোর দিকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, 'তোমরা পাথরদুটোর একটিকে আরেকটির সাথে সঙ্গম করিয়ে দিলেই তো পারো।” মহিলাদের মুখে কোনো কথা নেই। হতে পারে তারা তাঁর কথা বোঝেইনি, অথবা এমনও হতে পারে যে, তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে কেউ তাদের দেবতাদের নামে এরকম বাজে কথা বলতে পারে। তারা কোনো উত্তর না দিয়ে তাওয়াফ করতে থাকে। আবু যার যখন দেখলেন তাঁর কথায় মহিলাদের কোন ভাবাবেগ নেই, তিনি তারচেয়েও বাজে একটি মন্তব্য করলেন। এবারে মহিলাদের আর কোনো সন্দেহ রইলো না। তারা নিশ্চিত হয়ে গেল লোকটা আসলেই তাদের দেব দেবীদের সম্পর্কে এসব বাজে বকছে। ওমনি দু'জন চিৎকার করতে করতে দৌঁড়ে মক্কার রাস্তায় চলে গেল। ছুটতে ছুটতে একেবারে হাজির হলো মুহাম্মাদ সাঃ ও আবু বকরের সামনে।


মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হয়েছে তোমাদের?


- ওই যে, ওখানে... ওখানে একটা মুরতাদ!


- কী করেছে সে?


- সে কথা মুখে আনার মতো নয়।


রাসূলুল্লাহ সাঃ লোকটির সাথে দেখা করতে চললেন। তিনি সেখানে আবু যারকে পেলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,


- তুমি কোথা থেকে এসেছো? 


- আমি এসেছি গিফার গোত্র থেকে।


রাসূলুল্লাহ সাঃ মমতার সাথে তাঁর হাত আবু যারের কপালে রাখলেন। আবু যার বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ও আমাকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত সত্যের অনুসন্ধানে কেউ একজন গিফার থেকে মক্কায় চলে এসেছে! কেননা গিফারে আইন-কানুন মানার কোনো বালাই নেই, পবিত্র মাসকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করে না। সেই গিফারের একজন মানুষ কিনা সত্যধর্মের খোঁজে মক্কায় চলে এলো! বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে! অথচ যেখানে মক্কার কুরাইশরা ধর্মে-কর্মে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও সত্য দ্বীনের ব্যাপারে এগিয়ে এলো না।


‘আমার কাছে মনে হলো যে, আমি গিফার থেকে এসেছি এটা শুনে হয়তো উনার পছন্দ হয়নি তাই তিনি আমার কপালে হাত দিয়েছেন। আমি হাত বাড়িয়ে কপাল থেকে উনার হাত সরাতে গেলাম। সাথে সাথেই আবু বকর আমার হাতে বাড়ি মেরে নামিয়ে দিলেন, বললেন হাত নামিয়ে নাও।' এরপর রাসূলুল্লাহর সাথে তাঁর কথোপকথন শুরু হয়।


আবু যার অনুসন্ধানী ব্যক্তি ছিলেন। যার-তার, যে কোনো কথা মেনে নেওয়ার লোক নন। আপন ভাই যখন নবীর সন্ধান এনেছিল, তিনি তার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সত্যের ব্যাপারে আবু যারের সহজাত একটা বোধ বরাবরই কাজ করতো। অন্যায়কে তিনি কোনোদিনও সহ্য করতে পারেন নি। ভিটেমাটি ছেড়েছেন, সত্যের সন্ধানে সুদূর মক্কায় এসেছেন, মার খেয়েছেন—তবু সত্যের প্রতি আগ্রহ দমেনি। কথোপকথনের এক পর্যায়ে আবু যারের অন্তরের সকল প্রশ্নের অবসান হলো। যে সত্যের সন্ধানে তিনি এতোদূর এসেছিলেন, আজ যেন সেই সত্য তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই চিরন্তন সত্যের সামনে তিনি মাথানত করে দিলেন। আবু যার ইসলাম গ্রহণ করলেন। আজ থেকে তিনি মুসলিম!


রাসূলুল্লাহ আবু যারকে উপদেশ দিলেন, 'তোমার ঈমানের কথা কারো কাছে প্রকাশ কোরো না।' কিন্তু প্রবল উৎসাহে আবু যার পরদিনই মক্কার কুরাইশদের সামনে চিৎকার করে উঠলেন, 'আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ । এই কাজের ফল কী হতে পারে সেদিকে নজর দেওয়ার যেন সময়ই নেই।


শাহাদাহ শোনামাত্র কুরাইশরা আমাকে হেঁকে ধরলো, এমনভাবে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো যে আরেকটু হলে আমি সেদিনই মারা পড়তাম। কিন্তু ঠিক তক্ষুণি আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব এসে পড়লেন বলে সে যাত্রা রক্ষা পেলাম। তিনি বললেন, তোমরা জানো এই লোক কোথাকার? এই লোক গিফার গোত্রের। এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমাকে রেখে পালিয়ে গেল।


আবু যার রাদিআল্লাহু আনহু অপ্রতিরোধ্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনেও তিনি একই কাজ করলেন। প্রতিদিনই মক্কার লোকেরা তাঁকে মারধোর করতো, আর আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু এসে বলতেন যে এই লোক গিফার থেকে এসেছে। আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু  বলতেন, 'তোমরা কি জানো যে এই লোক তোমাদের হাতে মারা পড়লে কী হবে? তোমাদের কোনো কাফেলা আর নিরাপদে সিরিয়া পর্যন্ত পৌঁছাবে না।' রাসূলুল্লাহ এরপর আবু যারকে বললেন, তুমি তোমার লোকদের কাছে ফিরে যাও, তাদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দাও। যখন শুনবে আমি বিজয়ী হয়েছি তখন আমার সাথে দেখা করতে এসো।


আবু যার রাসূলুল্লাহর সাথে খুব অল্প সময় কাটিয়েছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহর কাছ থেকে খুব বেশি কিছু শেখার সুযোগ হয়তো সেভাবে হয়নি। হয়তো তিনি হাতেগোণা কিছু আয়াত ও হাদীস শিখতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেগুলোকে সম্বল করেই গিফারে ফিরে যান তিনি। সেখানকার লোকেদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ দিতে শুরু করেন। আর দেখতে দেখতে গিফারের লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করে। তিনি বলেন, 'রাসূলুল্লাহ যখন হিজরত করেন, তত দিনে আমার গোত্রের প্রায় অর্ধেক লোকই মুসলিম। আমরা ঠিক করলাম যে, রাসূলুল্লাহর সাথে দেখা করতে যাবো, আর তখন গোত্রের বাকি অর্ধেকও বলে উঠলো, রাসুলুল্লাহ মদীনায় আসলে আমরাও তাঁর সাথে দেখা করতে যাবো। আমরাও তখন ইসলাম গ্রহণ করবো। এভাবে এক এক করে পুরো গিফার গোত্রই মুসলিম হয়ে যায়।


অতঃপর একদিন মদীনায় নবীজি দিগন্তে ধূলোর মেঘ দেখতে পান। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সৈন্যদল আক্রমণ করতে আসছে। কয়েকজন সাহাবী নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে উদ্যত হন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে উঠলেন, “নাহ, সম্ভবত আবু যার আসছে।' রাসূলুল্লাহর ধারণা সত্য হলো। বস্তুত এই ধূলিমেঘ ছিল আবু যারের বাহিনীর। তিনি তাঁর পুরো গোত্রকে সাথে নিয়ে কাছে বায়াত দিতে মদীনায় আসছিলেন।


সে যুগে গিফার এবং আসলাম এই দুই গোত্রের মাঝে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আসলামের লোকেরা আবিষ্কার করলো গিফারের সব লোক মুসলিম হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে বায়াতও দিয়ে ফেলেছে! তারা অবিলম্বে রাসূলুল্লাহর  কাছে গিয়ে বললো, “আমরাও মুসলিম হবো! রাসূলুল্লাহ সাঃ দুআ করলেন, ‘গিফার! আল্লাহ যেন তাদের মাফ করে দেন। আসলাম! আল্লাহ যেন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত করেন। পুরো দু-দুটো গোত্রের মুসলিম হয়ে যাওয়া এই বিশাল ঘটনার পেছনে ছিলেন একজন মাত্র লোক, আবু যার গিফারী । তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন না, তাঁর অনেক বেশি বুজুর্গিও ছিল না। পরবর্তীতে অনেক ইলম অর্জন করলেও, ইসলাম গ্রহণের পর পর খুব অল্পসংখ্যক আয়াতই জানতেন। কিন্তু এই সীমিত জ্ঞান সম্বল করেই তিনি এগিয়ে যান। এর পেছনে ছিল তাঁর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা।


এভাবেই আবু যারের মাধ্যমে গিফার ও আসলামের সমস্ত লোক মুসলিম হয়ে যায়।" আরবের যে লোকগুলো কখনো মুসলিম হবে বলে আশাও করা যায়নি, তারাই ইসলাম গ্রহণ করে।


আবু যারের কাহিনি থেকে শিক্ষা:


১. যে ব্যক্তি সরলপথের খোঁজ করে, আল্লাহ তাকে হেদায়েত দেন। আবু যার সত্য জানার প্রচেষ্টায় আন্তরিক ছিলেন, তাই আল্লাহ আযযা ওয়াজাল তাঁকে সত্যের সন্ধান দিয়েছেন।


২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, অন্তত একটি আয়াত জানলেও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।


৩. আবু যার ছিলেন খুবই সাহসী। সত্য কথা অকপটে তিনি সবার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। মক্কায় একজন ‘বিদেশী’ হওয়া সত্ত্বেও কথা বলতে ভয় পাননি, কারণ তিনি নিজের মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্বিত ছিলেন।


৪. আবু যারের কাছ থেকে শিক্ষণীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোনো কথার সত্যতা যাচাই করা । মক্কার লোকেরা রাসূলুল্লাহকে জাদুকর বা মিথ্যাবাদী বলে সবার কাছে প্রচার করেছিল। কিন্তু তাদের দেখাদেখি আবু যার সে কথায় বিশ্বাস করে ফেলেননি। বরং তিনি নিজচোখে সত্য যাচাই করতে মক্কায় এসেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষকে বিবেক ও বুদ্ধি দান করেছেন। মুসলিমদের উচিত মিডিয়ার কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে নিজের বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে সত্য বোঝার চেষ্টা করা।


৫. রাসূলুল্লাহ সাঃ একটি হাদীসে বলেছেন, কোনো ভালো কাজকেই ছোটো মনে করো না। এমনকি যদি তা হয় তোমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি। কোনো ভালো কাজকেই নগণ্য ভাবা যাবে না, কেননা বিচারের দিনে একটি ছোটো কাজও হয়তো অনেক ব্যবধান গড়ে দেবে। আবু যার ইসলাম সম্পর্কে খুব বেশি। জানতেন তা কিন্তু না, তিনি অল্পই জানতেন। আর তিনি নিজের গোত্রে ফিরে গিয়ে যা জানতেন, তা দ্বারাই ইসলামের দাওয়াহ দেন-এর বেশি কিছু করেন নি। হয়তো তখন তাঁর কল্পনাতেও আসেনি যে, তাঁর পুরো গোত্র তাঁর আহ্বনে সাড়া দিয়ে মুসলিম হয়ে যাবে, এমনকি তাদের দেখাদেখি আসলাম গোত্রও ইসলাম গ্রহণ করবে! কিন্তু দাঈদের কাজ এটাই। তারা বীজ বুনবে, চারাগাছ জন্ম দেবেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। হাদীসে আছে, কোনো ব্যক্তি হয়তো তেমন চিন্তা-ভাবনা না করেই এমন একটি ভালো কথা বলে ফেলবে, যার কারণে আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন এবং তাঁর জন্য জান্নাত নির্ধারিত করে দেবেন। আর কোনো ব্যক্তি হয়তো এমন একটা কথা বলে বসবে যা আল্লাহর রাগের কারণ হবে, ফলে আল্লাহ তার সেই কথার জন্য তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।”

Previous Post Next Post