হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রাদি) : ক্ষতচিহ্নের গভীরতা

খাব্বাব ইবনে আরাত রাদিআল্লাহু আনহু

খাব্বাব ইবন আরাত রাদিআল্লাহু আনহু নামের এক সাহাবী একবার রাসূলুল্লাহর কাছে যান। নবীজি কাবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। খাব্বাব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ , আপনি কেন আমাদের জন্য দুআ করছেন না?


খাব্বাবের জীবনের নিদারুণ কষ্টের মুহূর্তগুলোর একটি ঘটনা এরকম: উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন খলীফা। একদিন তিনি মুসলিমদের মাক্কী জীবনের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য তাদের জড়ো করলেন। দেখতে দেখতে খাব্বাবের পালা এলো। তিনি মুখে কিছু বললেন না, শুধু পরনের জামাটা খুলে সবার সামনে পিঠ মেলে দাঁড়ালেন। উমার রাদিআল্লাহু আনহু তাঁকে দেখে যেন আঁতকে উঠলেন, বললেন, “তোমার কী হয়েছিল, খাব্বাব? এমন কিছু আমি কখনও দেখিনি!


খাব্বাবের পিঠ জুড়ে ছিল গভীর গভীর গর্ত। তিনি বললেন, ‘মাক্কী জীবনের ঘটনা। কুরাইশরা পাথর নিয়ে এসে সেগুলোকে আগুনে পোড়াতো। পাথরগুলো যখন পুড়ে লাল হয়ে যেতো, তখন রৌদ্রতপ্ত বালিতে জ্বলন্ত পাথর রেখে আমাকে তার ওপর ছুঁড়ে ফেলতো। তপ্ত পাথরে আমার মাংস ঝলসে যেতো। আমি আমার নিজের মাংস পোড়ার শব্দ শুনতাম, চর্বি পোড়ার গন্ধ পেতাম।


প্রকৃতপক্ষেই খাব্বারের কাছে নালিশ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তি ছিল। কিন্তু তিনি নালিশ করেননি। মুসলিমদের ওপর যে সীমাহীন কষ্ট এসে পড়েছে, সে কষ্ট কমানোর দুআ করতে বলেছেন শুধু “ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আপনি কেন আমাদের জন্য দুআ করছেন না?”


কিন্তু নবীজি রেগে গেলেন, সোজা উঠে বসলেন, রাগে তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি খাব্বাবকে বললেন,


'তোমাদের আগে এমনও মু'মিন বান্দা ছিল, লোহার চিরুনি দিয়ে যাদের হাড় থেকে মাংস খুবলে আনা হতো, করাত দিয়ে যাদের মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত চিরে দু' ভাগ করে ফেলা হতো, কিন্তু তবুও তাদেরকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। আর তোমরা তাড়াহুড়া করছো। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনকে বিজয় দান করবেন। আর অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন একজন মুসাফির সানা থেকে হাঘরামাউত পর্যন্ত সফর করবে, কিন্তু তার মনে আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় থাকবে না।


খাব্বাবের ঘটনা থেকে শিক্ষা


১. রাসূলুল্লাহ ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। যত কষ্ট-দুর্ভোগ-অত্যাচার সহ্য করতে হোক না কেন, হার মানা যাবে না।


২. প্রকৃতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতির যেমন কিছু ধরাবাঁধা সূত্র আছে, তেমনি দ্বীন কায়েমেরও কিছু নির্দিষ্ট সুত্র আছে যেগুলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ঠিক করে রেখেছেন। দুনিয়ার বুকে দ্বীনকে কায়েম করার জন্য মুসলিম উম্মাহকে একে একে সেই নির্ধারিত পথের প্রতিটি ধাপ পাড়ি দিতে হবে। এর কোনো ব্যতিক্রম বা শর্টকাট নেই। বহু আগের যুগের মু'মিনরা যে কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন, সাহাবীদেরকেও সেই একই পথ পার করতে হয়েছে। আমাদেরও সে পথই পাড়ি দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ চেয়েছিলেন তাঁর উম্মাহ হবে সবার সেরা। তাই পূর্ববর্তী জাতিরা যদি দ্বীন কায়েমের পথে ধৈর্যশীল হয়ে থাকে, তবে তাঁর উম্মাহ যেন আরও বেশি ধৈর্যের পরিচয় দেয়। পূর্ববর্তী জাতিরা যদি শক্তিশালী হয়ে থাকে, তবে এই উম্মাহ যেন তারচেয়েও বেশি শক্তিশালী হয় এটাই ছিল নবীজির চাওয়া। তিনি চাইতেন যে ক্বিয়ামতের দিনে তাঁর উম্মাহ-ই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই মুসলিমদের দায়িত্ব হচ্ছে রাসূলুল্লাহর ও প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ করা।


৩. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন আর এমন এক সময় আসবে যখন লোকেরা সানা থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে সফর করতে পারবে আর তাদের মনে আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় স্থান পাবে না। এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে, রাসূল ছিলেন মক্কার অধিবাসী, তিনি মক্কার কথা না বলে ইয়েমেনের এই বিশেষ দুটি স্থানকে বেছে নিলেন কেন? মক্কার লোকেদের জীবনেই তো তেমন নিরাপত্তা ছিল না, তাহলে মক্কা উল্লেখ করে বোঝানো কি যেতো না যে, পরবর্তী সময়ে মক্কায় নিরাপত্তা আসবে। হাদীসে মক্কার কথা উল্লেখ না করে ইয়েমেনের কথা বলার বিশেষ কারণ আছে। সেই অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ইয়েমেনে গোত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত। রাসূলের সময় পুরো ইয়েমেনজুড়ে প্রচুর সশস্ত্র গোত্র ছিল। তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ ও হানাহানিতে লিপ্ত থাকতো। তারা প্রত্যেকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। রাসূলুল্লাহর এ যুগে যখন ইসলামের আলো ইয়েমেনে প্রবেশ করলো, তা পুরো সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন করে তুললো। ইসলামের সৌন্দর্যই এটা। যেকোনো কিছুই ইসলামের স্পর্শে নিরাপদ ও প্রশান্তিময় হয়ে ওঠে। এখন মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, শরীয়াহর শাসন উঠে গেছে আর সেজন্যই সেই একই সানা থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত অঞ্চলটি আজ আবারও ইয়েমেনের সবচেয়ে অনিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এ দুটো স্থানের আশেপাশে সফরের কথা চিন্তায় আনাও নির্বুদ্ধিতার শামিল। এতেই বোঝা যায়, একমাত্র ইসলামের ছায়াতলেই রয়েছে সত্যিকার শান্তি।


গ্রন্থঃ সিরাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

Previous Post Next Post