গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০) ছিলেন প্রথম ইলিয়াস শাহি রাজবংশের তৃতীয় সুলতান।তিনি তৎকালীন বাংলার সুপরিচিত সুলতানদের অন্যতম ছিলেন। তার প্রকৃত নাম আজম শাহ। সিংহাসন আরোহণের পর তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ নাম ধারণ করেন।
সময় ১৩৮৯ সাল। বাংলার ক্ষমতায় তখন ইলিয়াস শাহী রাজবংশ। সুলতান সিকান্দার শাহ দ্বিধাদন্ধে আছেন কাকে মনোনীত করবেন পরবর্তী সুলতান হিসাবে। এই সময় গিয়াসউদ্দিন আজমের আবির্ভাব। তিনি সুলতান সিকান্দার শাহ এর প্রথম পুত্র। গিয়াস উদ্দিন আজমের সৎ মা কৌশলে ক্ষমতা নিতে চাইছিলেন। সৎ মা ও সৎ ভাইদের দ্বারা চুড়ান্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন গিয়াসউদ্দিন আজম। এক পর্যায়ে বাবা সুলতান সিকান্দার শাহ কে জানান হয় যে গিয়াস উদ্দিন আজম বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করে সিংহাসন লাভের চেষ্টা করছেন। সুলতান সিকান্দার শাহ আর গিয়াসউদ্দিন আজমের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
সংঘাত আসন্ন কিন্তু দুইপক্ষ শেষ চাল দেবার আগে কালক্ষেপণের সিধান্ত নেয়। এক সময় গিয়াসউদ্দিন আজম খবর পেলেন যে তাকে বন্দি করা হবে ও তার সৎ ভাইকে করা হবে পরবর্তী সুলতান। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে হরিণ শিকারে যাবার বাহানায় গিয়াস উদ্দিন আজম চলে আসেন সোনারগাঁয়ে। এখানে তিনি সৈন্য সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু করেন বাবা সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গোয়ালপাড়া যুদ্ধের এক পর্যায় হয়ে তিনি বাবাকে হত্যা করেন এবং সিংহাসন দখল করেন। ধারন করেন শাহ উপাধি। সিংহাসনে বসেই গিয়াসউদ্দিন আজম তার ১৭ জন ভাইয়ের চোখ তুলে ফেলেন আর বিশেষ পানীয় পান করিয়ে ঘটান বুদ্ধি-বিকৃতি। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী আরও অনেককে করেন হত্যা। শুরু হয় তার ২২ বছরের শাসনামল।
ক্ষমতা কণ্টকমুক্ত করতে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মনুষত্বহীনতার পরিচয় দিলেও ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তায় পরিচালিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে তিনি বিদ্যোৎসাহী, ন্যায় বিচারক ও সুশাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন।
তিনি যুদ্ধের চেয়ে মিত্রতা ও কূটনীতির মাধ্যমে রাজ্যকে সমৃদ্ধ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি চীনের মিং সাম্রাজ্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, পারস্যের শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদদের সাথে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং আসামকে জয় করেছিলেন। শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি কামরূপেরবিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তবে অঞ্চল জয়ের চেয়ে শাসন সুসংহত করার প্রতি তার মনোনিবেশ বেশি ছিল।
জৌনপুরের খাজা জাহানের নিকট তিনি দূত ও উপহার প্রেরণ করেন। সমকালীন চৈনিক সম্রাট ইয়ং লির সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ সালে তিনি চীনে দূত প্রেরণ করেন। ইয়ং লিও তার কাছে দূত ও উপহার পাঠান। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মক্কাও মদিনায়ও দূত প্রেরণ করেন। এই দুই স্থানে গিয়াসিয়া মাদ্রাসা নামক দুটি মাদ্রাসা নির্মাণে তিনি আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। তার শাসনামলে জমিদার রাজা গণেশনিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ পণ্ডিত ও কবিদের সমাদর করতেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তার পত্রবিনিময় হত। বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা এ সময়ে সম্পন্ন করেন। এসময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়।
ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০ শাসনামল) হেজাজে দুটি মাদ্রাসা নির্মান করেছিলেন। যেখানে চার মাজহাবের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা ছিলো। সেখানে শাফেয়ী মাযহাবের পাঠদান দিতেন শাফেয়ী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ,ঐতিহাসিক শাইখ তাকী উদ্দীন। মক্কার মসজিদটি নির্মাণ হয়েছিল বাবে উম্মে হানীতে,মদিনার মুনাওয়ারারটি এই বাবুস সালামের পাশেই। মাদ্রাসাগুলির সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতেন সুলতান নিজেই। তাঁর মৃত্যুর পর মাদ্রাসা দুটির দেখভাল করতেন সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। তাঁর মৃত্যুর পর মাদ্রাসাগুলিতে বাংলার আর কোন শাসক অনুদান দিতো কিনা কিংবা মাদ্রাসাগুলির কি ঘটেছিল তা আমার জানা নেই।
কবি হাফিজকে বাংলায় নিমন্ত্রন করার জবাবে তিনি সুলতানকে একটি গজল রচনা করে পাঠান।
ভারতের তোতা হবে মিষ্টি-মুখো সকল-ই,
ফারসীর মিছরী যবে বাঙ্গালায় চলিছে।
হে হাফিয! গিয়াসুদ্দীন শাহের সভার বাসনাছেড়ো না,
কাজ তোমারি কাঁদা-কাটায় চলিছে।
১৪১১ সালে রাজা গণেশের পাঠানো গুপ্তঘাতকের হাতে তার মৃত্যু হয়। আবার রাজা গণেশের মৃত্য হয় পুত্র যদুর হাতে। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে তার মাজার রয়েছে। এটি বাংলাদেশের সুলতানি আমলের অন্যতম দৃশ্যমান নিদর্শন, যা সোনারগাঁও উপজেলার শাহচিলাপুরে অবস্থিত।