সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ : Alauddin Kayqubad

সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ


সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ বিন গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু ছিলেন রোমের সেলজুক সুলতান যিনি ১২২০ থেকে ১২৩৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর সমৃদ্ধ স্থাপত্যীয় নির্মানশিল্প এবং তাঁর রাজত্বকালে উন্নত উজ্জ্বল আদালত সংস্কৃতির জন্য আজো তাকে স্মরণ করা হয়।


তার পিতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন কায়খসরুর মৃত্যুর পর আলাউদ্দিনের ভাই ইজ্জেদ্দিন কায়কোবাদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। আলাউদ্দিন সুলতান হওয়ার জন্য তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন কিন্তু তিনি যুদ্ধে হেরে যান এবং কারাগারে বন্দী হন। ইজ্জেদ্দিন কায়কোবাদ ১২২০ সালে মারা যান, যেহেতু তার কোন পুত্র ছিল না, সেহেতু আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১২৩৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।


কায়কোবাদ এর রাজত্ব আনাতোলিয়ায় সেলযুক রাজবংশ শক্তি ও প্রভাবের অপূর্ব প্রতিনিধিত্ব করেছিল এবং কায়কোবাদ নিজে রাজবংশের সর্বাধিক সফল সুলতান হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলেন।


ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মঙ্গোল আগ্রাসনের পরবর্তী সময়ে, আনাতোলীয়াতে তুর্কি জাতিগুলোর মধ্যে একতা গড়ায় তিনি বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। যদিও মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে তিনি বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি সেলজুক সাম্রাজ্য। ভিতরে ভিতরে সেলজুক সাম্রাজ্যের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের অনেকেই মোঙ্গলদের দলে নাম লিখায়। আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মারা যাবার পর মোঙ্গলরা পুরোপুরি প্রাসাদ নিজেদের কব্জাতে নিয়ে নেয়। 


কায়কোবাদের রাজত্বকালে সালতানাতের যথেষ্ট প্রসার ঘটতে দেখা যায়। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ একদিকে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অন্যদিকে প্রাসাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে। 

আলাউদ্দিন কায়কোবাদ

আলাউদ্দিন কায়কোবাদ ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু এর দ্বিতীয় পুত্র। যিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দানশীল। তার পিতা তাকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় অ্যানাতোলিয়ান শহরের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১২১১ সালে আলাইহিরের যুদ্ধের পরে সুলতান গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু মারা গেলে কায়কোবাদ এবং তার বড় ভাই ইজ্জেদ্দিন কায়কাউস উভয়ই সিংহাসনের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। কায়কোবাদ প্রথমে সালতানাতের প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছু মিত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তার চাচা এবং এরজুরুমের স্বাধীন শাসক সিলতীয় আর্মেনিয়া ও তুঘ্রিল শাহের রাজা লিও-১ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সালতানাতের বেশিরভাগ আমিরই কায়কাউসকে সমর্থন করেন এবং কায়কবাদ আঙ্কারার দুর্গে পালাতে বাধ্য হন, যেখানে তিনি কাস্তামনুর তুর্কমেন উপজাতির কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছিলেন। তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তার ভাই ইজ্জেদ্দিন তাকে পশ্চিম আনাতোলিয়ার দুর্গে বন্দী করেন।


পরে ১২১৯ (অথবা ১২২৯) সালে ইজ্জেদ্দিনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়। এতে কায়কোবাদ বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। যেহেতু ইজ্জেদ্দিনের কোন পুত্র ছিল না, সেহেতু আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১২৩৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।


১২২৭/১২২৮ সালে কায়কোবাদ আনাতোলিয়ায় আসেন হয়, যেখানে জালাল আদ-দ্বীন খাওয়ারিজম শাহ এর আগমন একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ মঙ্গোলদের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত খয়েরেজম সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে আসেন এবং আলাউদ্দিন কায়কোবাদের সহায়তা চান। যদিও জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ আশানুরূপ সাহায্য সেলজুক সাম্রাজ্যের থেকে পান নি।


প্রথমে কায়কবাদ মঙ্গোলের হুমকির বিরুদ্ধে তার তুর্কি আত্মীয় জালাল আদ-দীন খাওয়ারিজম শাহের সাথে একটি জোট করেন এবং জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে থাকেন। জালালুদ্দিন দিন দিন মোঙ্গলদের আতংক হয়ে উঠে ও শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। কিন্তু রাজনীতির নির্মম করাঘাত জালালুদ্দিন ও কায়কোবাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধনকে দুর্বল করে দেয়। জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ আনাতোলিয়া থেকে চলে যান।


কায়কোবাদ পরিশেষে ১২৩০ সালে ইয়াসিজিমান যুদ্ধের মাধ্যমে সিভাস এবং এরজিনিচান শহর আয়ত্বে নেন। তার বিজয়ের পরে, তিনি আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হন এবং এরজুরুম, আহলাত এবং লেক ভ্যান অঞ্চলের (পূর্বে আইয়ুবিডের অংশ) অঞ্চলে সেলজুক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিয়েরবাকরের আরতুকিদ এবং সিরিয়ার আইয়ুবিডরা তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি জর্জিয়ার বেশ কয়েকটি দুর্গও দখল করেছিলেন, যার রানী তার কাছে শান্তি চুক্তি করেছিলেন এবং কায়কবাদের দ্বিতীয় পুত্র কায়খুসরোর সাথে তার কন্যাকে তামরকে বিয়ে দিয়েছিলেন।


সেলজুক রুম সুলতানিয়ার সীমান্তে মঙ্গোলদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং শক্তি সম্পর্কে স্মরণ করে তিনি তার পূর্ব প্রদেশগুলিতে প্রতিরক্ষা এবং দুর্গগুলিকে আরও শক্তিশালী করেছিলেন। এদিকে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে সেলজুকদের সহায়তার শর্তে, রুমু সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ দেরিয়াবাখ ও উরফার মধ্যবর্তী একটি সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে আরতুগ্রুল বে তার বসতি স্থাপন করেন। সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তখন মোঙ্গলদের সাথে লড়াই করতে করতেই ছিলেন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। এদিকে আবার বাইজেন্টাইনদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা চিন্তাও করা যায় না। আবার মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য যোগাতে গিয়ে সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়ে৷ তাই সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ আরতুগ্রুল বে কে সীমান্তে বাইজেন্টাইনদের দিকে নজর রাখার জন্য অনুরোধ করেন। আরতুগ্রুল বে সীমান্তে নিপিড়ীত মানুষের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন একই সাথে মোঙ্গল তাতারদের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তার তলোয়ারের ছিলা সর্বদা ক্ষিপ্র। 


স্বল্প বয়সে আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মারা যাবার পর সেলজুকরা আর কখনো দাড়াতে পারেনি। বলা হয়ে থাকে তাকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তার বালক সন্তান সিংহাসনে বসেন যিনি মুলত পরিচালিত হতেন সাম্রাজ্যের কর্তাদের দ্বারা।


কায়কোবাদের তিনজন পুত্র ছিল। দ্বিতীয় কায়খসরু, 'আইজ আল-দীন এবং রুকন আল-দীন। কায়কবাদ প্রথমে তাঁর প্রজাদের পুত্র ইজ আল-দীনের প্রতি আনুগত্যের শপথ করান, কিন্তু আমিররা আরও শক্তিশালী কায়খসরু দ্বিতীয় এর কাছে বাইয়াত হন। সুস্পষ্ট উত্তরসূরি না পেয়ে কায়কবাদের মৃত্যুর পরে সেলজুক আমিরাত বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে।


কায়কাবাদ আনাতোলিয়া জুড়ে নানা রকম নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণ করেন। শহর ও দুর্গগুলি পুনর্গঠন ছাড়াও তিনি বহু মসজিদ, মধ্যযুগীয়, কাফেলাওয়ালা, সেতু এবং হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন, যার অনেকগুলি আজও রক্ষিত। সেলজুক রাজবংশের প্রাসাদ এর নির্মাণ শেষ করার পাশাপাশি কোনিয়ায় তার নির্মিত কুবাদাবাদ প্রাসাদ এর তীরে লেক বেয়শীল এবং প্রাসাদের কাছাকাছি কায়সেরি নির্মাণ করেন।


আলাউদ্দিন কায়কোবাদ ৩১ মে ১২৩৭ তারিখে কায়সারিতে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সম্মানে একটি ভোজের সময় মারা যান। কথিত আছে যে তার পুত্র, গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু দ্বিতীয়, প্রত্যাশিত সময়ের আগে পরবর্তী সুলতান হওয়ার জন্য তাকে বিষ দিয়েছিলেন। তাকে কনিয়া শহরের আলাউদ্দিন মসজিদে দাফন করা হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post