হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহঃ এর জীবনী

হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রহঃ

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ:. ৬১ হিজরী সনে উমাইয়া বংশের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুল আজিজ। মাতার হলেন দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর পৌত্রী  উম্মু আসিম লায়লা। তিনি একজন উমাইয়া খলিফা ছিলেন। তাকে দ্বিতীয় ওমর ও ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলা হয়।


শিশুকাল হতে তিনি ছিলেন আল্লাহ ভীরু ও জ্ঞানতাপস। শিশু বয়সে তিনি পিতার সাথে মিশর গমন করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি কোরআন ও হাদিসের উচ্চতর জ্ঞান লাভের আশায় মদীনায় আগমন করেন। তৎকালীন সময়ে মদিনার বিখ্যাত শিক্ষকদের নিকট হতে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি কোরআন, হাদিস, তাফসীর ও আরবি সাহিত্যের উপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি উমাইয়া শাসক খলিফা আব্দুল মালিকের কন্যা ফাতেমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।


খলিফা ওয়ালিদ, ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে ৮৭ হিজরী সনে মদিনার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান করেন। তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ সহকারে দায়িত্ব পালন করেন। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি মজলিসে শুরা গঠন করেন। এর সদস্য ছিলেন ১০ জন মুত্তাকি আল্লাহভীরু লোক। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায় পরায়ণ। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন বিচারক নিয়োগ করেন। গভর্নর থাকাকালে তিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ কারণে তৎকালীন প্রখ্যাত মনীষী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব তাকে "মাহাদি" বা সুপথ প্রাপ্ত উপাধি দিয়েছিলেন।


গভর্নর নির্বাচিত হয়ে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জনসাধারণের কল্যাণার্থে কাজ শুরু করেন। তিনি মসজিদে নববীর সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধন করেন। তিনি অসংখ্য ঘরবাড়ি প্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। পিপাসার্ত মানুষদের জন্য তিনি অনেক কূপ খনন করেন। মসজিদে নববীর বাগানে একটি ঝর্ণা ও চৌবাচ্চা নির্মাণ করেন। সমগ্র এলাকায় বিশেষ করে মক্কা, মদিনা ও তায়েফের মাঝে চলাচলের জন্য সংযোগ সড়ক তৈরি করেন। শুধু জনকল্যাণমূলক কাজ নয় তিনি জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছে। তিনি জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। গভর্নর থাকাকালেও তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কোরআন, হাদিস ও অন্যান্য কিতাবাদি অধ্যায়ন করতেন।


হিজরী ৯৯ সন মোতাবেক ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা সোলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক ইন্তেকাল করলে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মুসলিম জাহানের খলিফা নিৃযুক্ত হন। খলিফা যুক্ত হয়ে তিনি পূ্র্ববর্তী খলিফাদের গৃহীত সকল অন্যায় নীতি বাতিল করে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে খলিফা নির্বাচনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি উপস্থিত লোকদের বলেন, হে মানব মন্ডলী! আমার অনিচ্ছা ও সাধারন মানুষের মতামত ছাড়া আমাকে খলিফা মনোনীত করা হয়েছে। আমি আপনাদের বাধ্য করছি না আপনারা যাকে ইচ্ছা খলিফা নির্বাচন করুন। তার এ  ভাষন এর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা বলল, আমরা আপনাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলাম। আমরা আপনার খিলাফতের উপর সন্তুষ্ট। অতঃপর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর প্রাদেশিক গভর্নর দের উদ্দেশ্যে প্রেরিত চিঠিতে তিনি উল্লেখ করলেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তার কিতাব মেনে চল এবং রাসূলের সুন্নাহ অনুসরন করুন।


উমাইয়া বংশের লোক জন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাবে রাষ্ট্র ও জনসাধারণের যে সকল সম্পদ দখল করে রেখেছিল। তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এবং যথাযথ মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এমনকি তার স্বীয় স্ত্রীর সম্পত্তি, উপঢৌকন সামগ্রী, গহনা রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মালে জমা দেন। রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ বাস্তবায়ন করেন। বিশেষ করে হযরত ওমর রাঃ এর শাসন নীতি অনুসরণ করেন। অনারবও মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরপেক্ষ শাসন নীতি প্রণয়ন করেন। রাষ্ট্রে সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পূর্ববর্তী  উমাইয়া খলিফাদের সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থাণ্বেষী নীতি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন। রাষ্ট্রে ন্যায়, পরায়নতা, ধর্মপরায়ণতা, সাম্যের ধারণা ও সকল জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে তাকে উমাইয়া সাধু (Umayyad Saint) বলা হয়।


ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে আল হাদিস। রাসুল সাঃ এর হাদিস গুলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। হাদিস গুলো সংরক্ষন ও সংকলনের জন্য তিনি প্রাদেশিক গভর্নর দের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের কাছে লেখেন, তোমরা রাসুল সাঃ এর হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া এবং তা সংগ্রহ ও সংকলন কর। তারই প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বে হাদিস সংকলিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ সহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ফলে হাদিস হারিয়ে যাওয়া ও বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।


ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। তিনি গভর্নরদের নিকট প্রেরিত পত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিতেন। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি অনেক প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন। শিক্ষকদের জন্য মাথাপিছু মাসিক ১০০ দিনার বাস্বর্ণমুদ্রা ভাতার ব্যবস্থা করেন। তার সময়ে সিন্ধু, আফ্রিকা, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ইসলাম ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে।


দ্বিতীয় ওমর নামে খ্যাত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাষ্ট্র পরিচালনায় কোরআন, হাদিস ও খোলাফায়ে রাশেদীনের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। আর তাই তাকে চার খলিফার পর ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলা হয়। তার আমলে কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি মানুষের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ দূর করে সাম্য ও সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়ে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার এত বেশি উন্নতি হয়েছিল যে, যাকাত গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। তিনি ছিলেন একাধারে ফকিহ (ইসলামী আইন শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ) মুজতাহিদ (ইসলাম ধর্মজ্ঞানের সুপন্ডিত) কোরআন ও হাদিসের হাফিজ।


হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী, বিনম্র, নম্র প্রকৃতির মানুষ। তার অন্তরে আল্লাহ ভীতি ছিল যে, তিনি প্রায় আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। খলিফা হয়েও তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দৈনিক মাত্র দুই দিরহাম বাতা গ্রহণ করতেন। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে তিনি অন্য ধর্মালম্বীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতেন। তার আমলে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অগ্নি উপাসক গনকে তাদের গির্জা উপসনালয় নিজের অধিকারে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তার আমলে সকল ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারতেন।তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। তিমি আইলা ও সাইপ্রাসের কর কমিয়ে দেয়। নাজরানের খ্রিস্টানদের তিনি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন। জ্ঞানচর্চায় ও অমুসলিম মনীষীদের সাহায্য করেছিলেন। তিনি তাদের দ্বারা কয়েকটি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।


এ মহামনীষী ১০১ হিজরী মোতাবেক ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের রজব মাসে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার খিলাফতকাল ছিল প্রায় আড়াই বছর।

Post a Comment

Previous Post Next Post