ওমর আল-মুখতার: The Lion of Desert

উমর মুখতার

ওমর আল মুখতার ছিলেন কোরআন ও আরবি ভাষার শিক্ষক এবং পরবর্তী সময়ে যার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল লিবিয়ার ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আরব বিশ্বের একজন সাহসী গেরিলা যোদ্ধা ও বেদুইন নেতা হিসেবে, তার পুরো নাম ওমর আল মুখতার মোহাম্মদ বিন ফারহাত আল মানিফি। ওমর আল মুখতার জন্মগ্রহণ করেন লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল এলাকায়, ১৮৫৮ সালে। শৈশবে ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং অল্প বয়সে কোরআনে হাফেজ হন। ওমর আল মুখতার ছিলেন সেনুসি আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তিনি কোরআন ও আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে ১৯১১ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। উল্লেখ্য, সেই বছর ইতালীয় সেনাবাহিনী লিবিয়া আক্রমণ করে। তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ‘লিবিয়ান রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ দল গঠন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় কুড়ি বছর দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বলা হয়, ইতালি সরকার দলবলসহ তাকে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য অনেকবার সন্ধি করতে এবং ঘুষ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি বারবার সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন; বরং বলেছেন, ‘আমরা কখনই আত্মসমর্পণ করব না। আমরা জিতব নতুবা মরব।’ তবে দুর্ভাগ্য যে অনেক প্রচেষ্টার পরে ইতালীয় সেনাবাহিনী ৭৩ বছর বয়সী আল মুখতারকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিল। ইতালির স্বৈরাচারী সরকার এবং সেনাবাহিনী বিশেষ আদালতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করে।


বাস্তব জীবনে ওমর আল মুখতারের প্রভাব ছিল অনেক বিস্তৃত, যেমন লিবিয়ার তিন শাসনতন্ত্র—রাজতান্ত্রিক, বিপ্লবী এবং সামরিক বাহিনী—তাকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং লিবিয়ার ১০ দিনারের নোটে তার ছবি ছাপা হয়েছে। তিনি লিবীয়দের শিক্ষা দিয়েছেন যে তারা যেন মাতৃভূমিকে ভালোবাসে, স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং যেকোনো ধরনের আগ্রাসন প্রতিহত করে। পরবর্তী সময়ে তার মহত্তর ত্যাগ স্বীকার আরব জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন রূপ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হয়। তার অসীম সাহস ও গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল জানা এবং পরিচালনার দক্ষতার কোনো তুলনা হয় না। তাই শত্রপক্ষও তার বীরত্ব ও নিপুণ রণকৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করেছে ।


১৯৮১ সালে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘লায়ন অব দ্য ডেজার্ট’ যেখানে উমর আল মুখতারের ইতালির বিরুদ্ধে সংগ্রামী জীবন তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্রটি ইতালিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ২০০৯ সালের ১১ জুন তৎকালীন লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকারি সফরে ইতালি গিয়েছিলেন এবং সেই সময় সে দেশের স্কাই টিভিতে চলচ্চত্রটি প্রদর্শিত হয়। 


অক্টোবর ১৯১১ সাল।

অটোমান সাম্রাজ্য তখন দুর্বল বৃদ্ধ এক অবিভাবকের মতো। অ্যাডমিরাল ক্যাপো ফারাফেলি এবং তার যুদ্ধজাহাজের বহর ত্রিপোলির অদূরে উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রতীরে সপৌঁছে। সামরিক প্রশিক্ষণ তাদের উদ্দেশ্য নয়। তুর্কিদের নিষেধ তারা সম্পুর্ন উপেক্ষা করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা লিবিয়া ও তার আশেপাশের কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। সংবাদ পত্রে খবর ছাপা হয় লিবিয়া ও তার আশেপাশের জনগণ ইতালির পক্ষে রয়েছে৷ লোকমুখে প্রচলিত ছিলো আরবা দেশপ্রেমিক না। তাই তারা ইতালির শাসন মেনে নিয়েছে।


এদিকে ইতালির সামরিক বাহিনী লিবিয়ার দখল নিতে পারলে কোনভাবেই শান্তিতে থাকতে পারছে না। প্রতিদিনই কোন না কোন গেরিলা আক্রমন হচ্ছে তাদের উপর। তাহলে অটোমান বাহিনীর কোন কমান্ডো ফোর্স? ইতালীয় বাহিনীর ঘুম নেই দুচোখে।


১৯১২ সাল।

আক্রমণের উদ্দেশ্য প্রস্তুত হচ্ছে কয়েকজনের একটি গেরিলা বাহিনী। উদ্দেশ্য বির হাল্ঘ বারগার।  জায়গাটি বেনগাজি থেকে খুব বেশি দুরে নয় এবং মিসরীয় সীমান্তের কাছাকাছি। রওনা দেওয়ার আগে সব দিকনির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছেন একজন আলেম ধরনের শান্ত প্রকৃতির মানুষ। দেখলে মনে হবে মাদ্রাসার কোন শিক্ষক ছাত্রদের পাঠ দিচ্ছেন। 


ইনিই হলেন উমর আর মুখতার।  এই শান্ত-শিষ্ট শিক্ষক অতি অল্প সময়ের মধ্যে মরুভূমির বুকে সংঘটিত গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলের দিক থেকে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কেননা অন্যদের তুলনায় তিনি তার দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবেশ সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন মরুভূমিতে, যা ছিল ইতালীয় সৈন্যদের কাছে অজানা এবং রহস্যময়। মরুভূমিতে যুদ্ধ পরিচালনায় তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে থাকা জ্ঞান তিনি ইতালির সেনাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান। ইতালীয়রা মরু অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল না। মুখতার তার বাহিনী নিয়ে ইতালির সেনাদের ওপর গেরিলা হামলা চালাতে শুরু করেন। তার বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে ইতালি সেনাদের চৌকির ওপর হামলা চালিয়ে সরে পড়তো। তারা ইতালির সেনাদের যোগাযোগ ও রশদ সরবরাহে ব্যাপকভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।


পরপর কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতালির শাসক মুসোলিনি তার সেনা কর্মকর্তা জেনারেল গ্রাজিয়ানিকে লিবিয়ায় ইতালীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচন করেন। গ্রাজিয়ানি দাবি করেছিলেন, লিবিয়াকে পুরোপুরি ইতালির নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে তাকে আইনের বালাই না রেখে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে, এর জন্য তার কাছে কোন জবাবদিহি চাওয়া যাবে না। মুসোলিনি তা মেনে নেন।


স্থানীয়রা যাতে মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করতে না পারে সেজন্য গ্রাজিয়ানি হাজার হাজার লিবীয়কে ইতালির সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করেন। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর অবস্থা ছিল ভয়ংকর। মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করছে- এই সন্দেহে প্রায়ই শিবিরের নারী, শিশু ও পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। এছাড়া অনাহার ও রোগে মৃত্যু ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।


১৯২৭ সালের মার্চে ইতালীয়রা জাঘবুব দখল করে। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত মুখতার সানুসি বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। ১৯২৯ সালে পিয়েত্রো বাদোগলি লিবিয়ার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ওমর মুখতারের সাথে শান্তি আলোচনায় বসেন। এসময় গভর্নরের পক্ষ থেকে মুখতারকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ওই বছরের অক্টোবরে মুখতার লিবিয়ায় ইতালির সেনাপ্রধান রডোলফো গ্রাজিয়ানির সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য লিবিয় যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।


১৯৩০ সালের জুনে গ্রাজিয়ানির বাহিনী মুখতারের কাছে পরাজিত হয়। খবর পেয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে গ্রাজিয়ানির পরামর্শে মুসোলিনি জেবেল আখদার থেকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সরিয়ে উপকূল এলাকায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এছাড়া গিয়ারাবুবে উপকূলের কাছে লিবিয়া ও মিশরের সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুখতারের যোদ্ধারা যাতে মিশর ও স্থানীয় জনতার সহযোগিতা না পায় সেজন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।


১৯৩১ সালের প্রথম দিক থেকেই মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে দিতে সক্ষম হয় গ্রাজিয়ানির বাহিনী। আকাশ ও স্থল উভয় পথেই মুখতার বাহিনীর ওপর চলে আক্রমণ। এর পরেও মুখতার লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্লোনটার কাছে অতর্কিত হামলা চালানো হয় মুখতার বাহিনীর ওপর। ইতালির সেনাদের গুলিতে মুখতারের ঘোড়াটি মারা গেলে পড়ে যান তিনি। এরপরেও নিজের বন্দুকটি নেওয়ার চেষ্টা করলে সেনারা তার হাত লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। শেষ পর্যন্ত আহত অবস্থায় ৭২ বছর বয়সে বন্দি হন মুখতার।


ওমর আল-মুখতার



১৯৩১ সাল। লিবিয়ার বেনগাজির সামরিক আদালত।


বিচারক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ‘আসামির কথোপকথন-


-আপনি কি ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন?

-হ্যাঁ।

-আপনি কি ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করতে লোকজনকে উৎসাহিত করেন?

-হ্যাঁ।

-আপনি যা করেছেন তার দণ্ড সম্পর্কে কি আপনি জানেন?

-হ্যাঁ।

-আপনি কত বছর ধরে ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন?

-২০ বছর।

-আপনি যা করেছেন তার জন্য কি অনুশোচনা হয়?

-না।

-আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে?

-হ্যাঁ।

এ পর্যায়ে বিচারক বললেন- ‘আপনার মতো লোকের জন্য এটি করুণ পরিণতি।’

কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মানুষটির জবাবও বেশ তীক্ষ্ম। তিনি বললেন, ‘বিপরীতভাবে বলতে পারি জীবন শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায় এটি।’


মাত্র তিনদিনের মধ্যে মুখতারের বিচার সম্পন্ন হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয় বেনগাজির সামরিক আদালত। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সুলুকের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মুখতারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। 


মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে বিপ্লবী ওমর মুখতার কুরআনুল কারিমের যে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেছিলেন। একজন মুমিনের জীবনের চাওয়া-পাওয়াও তাই। তিনি সুরা ফজর-এর শেষ ৪ আয়াত তেলাওয়াত করেন। আর তাহলো-

'হে উদ্বেগমুক্ত আত্মা!

তুমি তোমার প্রভুর দিকে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষজনক হৃদয়ে।

সুতরাং তুমি আমার (অনুগত) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও।

এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সুরা ফজর : আয়াত ২৭-৩০)


আল্লাহ তাআলা কুরআনের সৈনিক ও দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ওমর মুখতারের প্রতি সদয় হোন। তাকে জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন। মুসলিম উম্মাহকে দেশপ্রেম ও ইসলামের জন্য অনুপ্রাণিত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।


মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে মুখতারকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে তাকে মুজাহিদদের কাছে চিঠি লিখে ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জবাবে মুখতার বলেছিলেন, ‘আমরা কখনোই আত্মসমর্পন করবো না। হয় আমরা জিতব নতুবা মৃত্যুকে বরণ করবো। তোমাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে লড়তে হবে এবং এর পরের প্রজন্মের সঙ্গে।’

key word: মরুর সিংহ ওমর আল মুখতার । ওমর মুখতার pdf । লিবিয়া । লায়ন অব দ্য ডেজার্ট কার উপাধি । আল মুখতারের উত্থান সম্পর্কে যা জানো লেখো । মরু সিংহ কার উপাধি । লিবিয়া যুদ্ধ ২০১১

Post a Comment

Previous Post Next Post