আরবি মাসের নাম পরিচিতি : আরবি মাসের নাম, অর্থ ও নামকরণের কারণ

আরবি মাসের নাম
আরবি মাসের নাম

হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সাল বা আরবি মাসের গণনা শুরু হয়। মহরমকে আরবি মাসের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই হিজরত করেন। সেই দিনকে মহরম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। হিজরি বা আরবি মাসের হিসাবের প্রথম প্রয়োগ ঘটে উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৭ হিজরির ৩০ জুমাদাল উখরা অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে।  একনজরে আরবি মাসের নাম ও আরবি মাসের অর্থগুলো জেনে নেয়া যাক।


আরবি মাসের নাম ও অর্থঃ

নং

আরবি মাসের নাম

আরবি মাসের উচ্চারন

আরবি মাসের নামের অর্থ

মুহররম

ٱلْمُحَرَّم

নিষিদ্ধ

সফর

صَفَر

অকার্যকর

রবিউল আউয়াল

رَبِيع ٱلْأَوَّل

প্রথম বসন্ত

রবিউস সানি

رَبِيع ٱلْآخِر

দ্বিতীয় বসন্ত

জুমাদাল উলা (জমাদিউল আউয়াল)

جُمَادَىٰ ٱلْأُولَىٰ

শুকনো জমির প্রথম/শুরু

জুমাদাল উখরা (জমাদিউস সানি)

جُمَادَىٰ ٱلْآخِرَة

শুকনো জমির শেষ

রজব

رَجَب

সম্মান

শা'বান

شَعْبَان

বিক্ষিপ্ত

রমজান

رَمَضَان

জ্বলন্ত তাপ

১০

শাওয়াল

شَوَّال

উত্থাপিত হওয়া

১১

জিলকদ

ذُو ٱلْقَعْدَة

যুদ্ধবিরতি/বসা

১২

জিলহজ

ذُو ٱلْحِجَّة

তীর্থযাত্রা


হিজরি বা আরবি মাস শুধু আরবদের সন নয়; বরং এটি মুসলমানদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত সন। এর গণনা ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুসরণ করেই হয়। এজন্য আরবি মাসের নাম পরিচিতি ও নামকরণের কারণ জেনে রাখা জরুরি।


১. মহররম- محرّم অর্থ নিষিদ্ধ। চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মহররম। হিজরি সনের প্রথম মাসও মহররম। আরবে এ মাসকে পবিত্রতম মাস মনে করা হতো। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকত এবং এগুলো তখন হারাম মনে করা হতো। এজন্য এ মাসের নাম রাখা হয়েছে মহররম। মুসলমানদের এই মাস শোক ও চিন্তা-ভাবনা এবং ইবাদতের। এই মাসের ৭ তারিখ থেকে ইয়াজিদের বাহিনী হোসাইন (রা.)-এর জন্য কারবালায় ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিয়েছিল। চার দিন পানি, খাবার-দাবার বন্ধ রেখে হজরত হোসাইন (রা.)-সহ তার সফরসঙ্গী, পরিবার-পরিজনকে শহীদ করেছিল।


২. সফর- صفر অর্থ রিক্ত, শূন্য, ভ্রমণ। এটি ইসলামের দ্বিতীয় মাস। যুদ্ধ নিষিদ্ধ তিনটি মাস শেষ হওয়ার পর প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের লোকরা বাড়ি-ঘর খালি করেই যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়ত এ মাসে। আরবিতে ‘সাফিরাল মাকান’ ওই সময়কে বলা হয় যখন কোনো জায়গা মানবশূন্য হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ওই সময়টি ছিল আরবের প্রধান আর্থ উপার্জনের মাধ্যম ও খেজুর পাকার মৌসুম। তখন খেজুর পেকে হলুদ হতো। তাই সে মাসের নাম রাখা হয় সফর। অর্থাৎ শূন্য (ঘর) বা হলুদের (শস্য) মাস। সফর শব্দের আরেকটি অর্থ হল ভ্রমণ। এ মর্মে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হলো,তৎকালীন আরবরা এ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বেশি ভ্রমণ করত বলে এ মাসের নাম রাখা হয়েছে সফর।


৩. রবিউল আউয়াল- রবিউল আউয়াল আরবি তৃতীয় মাস। রবি শব্দটি ‘ইরতিবাউন’ শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ হলো, ঘরে থাকা। যেহেতু এ মাসে লোকরা ঘরে বসে থাকত, এজন্য একে রবি নাম দেওয়া হয়েছে। আবার রবি অর্থ বসন্তকালও। এ মাসে আরবের প্রকৃতিতে বসন্ত লাগত, তাই এর নাম রবিউল আউয়াল বা প্রথম বসন্ত দেওয়া হয়েছে। এ মাসেই নবীজি (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।


৪. রবিউস সানি - কেউ কেউ এর নামকরণের কারণ বলতে গিয়ে বলেছেন, আরবে বসন্তকাল দুই মাস জুড়ে হয়ে থাকে; রবিউল আওয়াল এবং রবিউল আখের। অর্থাৎ বসন্তের প্রথম ও শেষ বসন্ত। যে জিনিসের গণনায় তিন আছে সে ক্ষেত্রে ‘সানি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ দুই মাসের পরে যেহেতু এ নামে আর কোনো মাস নেই তাই রবিউস সানি না বলে রবিউল আখির বলাই ভালো। অনেকের মতে, ‘রবিউস সানি’ শব্দ ব্যবহারের অবকাশই নেই।


৫. জুমাদাল উলা (জমাদিউল আউয়াল)- জুমাদাল উলা পঞ্চম মাস। আরবিতে জুমুদ অর্থ জমে যাওয়া। প্রসিদ্ধ উষ্ট্রযুদ্ধও এই মাসের ১৫ তারিখে সংঘটিত হয়।


৬. জুমাদাল উখরা (জমাদিউস সানি)- جمادي الآخر يদ্বিতীয় শুকনো ভূমিখণ্ড, জুমাদাল উখরা ষষ্ঠ মাস। যে সময় এ মাসের নাম রাখা হয় তখন পানি শুকনো হওয়ার শেষ মৌসুম ছিল। এই মাসের ১ তারিখ হজরত জিবরাইল (আ.) প্রথমবার রাসুলের (সা.) কাছে ওহি নিয়ে এসেছেন।


৭. রজব - رجب শ্রদ্ধা, সম্মান। রজব শব্দটি আরবিতে ‘তারজিব’ থেকে উদ্ভূত। অর্থ সম্মান করা। প্রাক-ইসলাম যুগ থেকেই যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস হওয়ার কারণে তা সবার কাছে মহিমান্বিত বিবেচিত হতো। তাই এ মাসের নাম রজব রাখা হয়েছে। 'রজব' শব্দের অন্য অর্থ 'সরিয়ে নেওয়া'। কেননা প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবরা এ মাসে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য বর্শার মাথা সরিয়ে রাখতো। এ মাসে ওমরাহ আদায় করা হতো। এ মাসের বরকতময় হওয়ার কারণ হলো, এ মাসের ২৭ তারিখ রাতে নবীজির (সা.) মেরাজ সংঘটিত হয়।


৮. শাবান - شعبان বিক্ষিপ্ত। হিজরি বর্ষের অষ্টম মাস এটি। শাবান শব্দটি ‘তাশায়য়াবা’ থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো বিভক্ত হওয়া। যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস শেষ হওয়ার পর যুদ্ধের জন্য মানুষরা বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ত। এজন্য এ মাসকে শাবান নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর নামকরণের আরো একটি সম্ভাব্য কারণ এ মাসের পানির অভাব। তৎকালীন আরবেরা এ মাসে পানির সন্ধানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। তাই এর নাম 'শাবান'। এর অন্য অর্থ দুইয়ের মাঝামাঝি, কেননা এটি রজব এবং রমজান মাসের মাঝখানে। এ মাসের ১৫ তারিখ মুসলমানরা শবেবরাত পালন করেন। রাতের বেলায় আল্লাহর স্মরণে রত থাকেন। দিনের বেলা রোজা রাখেন। এ রাতে আগামী এক বছরের সবকিছু ফয়সালা হয়।


৯. রমজান - আরবি নবম মাস রামাদান শব্দটি ‘রামাদুন’ থেকে নির্গত। অর্থ হলো প্রখর তাপ, তীব্র গরম। যেহেতু এ মাসে অনেক গরম থাকত, তাই এই নাম। রমজান মাসে গুনাহের বহর জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে বান্দারা আল্লাহর করুণায় উদ্ভাসিত হয়। এদিক বিচারেও নামটি বেশ জুতসই।


এ মাসে পুরো এক মাস রোজা রাখা ফরজ। বছরের মধ্যে এ মাসটি সবচেয়ে বেশি বরকতময়। কেননা, দ্বিতীয় হিজরিতে এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়। নবীজির জিন্দেগিতে এবং নবীজির পরে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়, যেগুলো এ মাসের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৭ রমজান বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে কাফেরদের মোকাবিলায় মুসলমানরা প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। এ মাসের ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ মাসের ইবাদত অনেক বেশি কবুল হয়। তারাবির নামাজ এ মাসের বিশেষ ইবাদত। রমজান শেষে আসে সুমহান পবিত্র ঈদুল ফিতর।


১০. শাওয়াল - হিজরি সনের দশম মাসের নাম শাওয়াল। ‘শাওলুন’ শব্দের অর্থ ক্ষিপ্রতা। এ মাসে আরবরা সফর ও শিকারের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ এলাকা থেকে বের হতো। শিকারের সময় শিকারির ক্ষিপ্রতা না থাকলেই নয়। সে সুবাদে তখন প্রায় সব আরবের মধ্যেই শিকারে ক্ষিপ্রতা বিরাজ করত। আরবদের সমকালীন অবস্থার দিকে লক্ষ করে এ মাসের নাম রাখা হয়, শাওয়াল। এ নামের কারণ এই সময়ে স্ত্রী-উট বাচ্চা প্রসব করে এবং লেজ উত্থিত করে। এ মাসের ১ তারিখ পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ মাসের ফজিলত ঈদের কারণে।


১১. জিলকদ - ذو القعدة অর্থ সাময়িক যুদ্ধবিরতির মাস। জিলকদ ইসলামি ক্যালেন্ডারের এগারোতম মাস। আল্লাহতায়ালা এ পবিত্র মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম করেছেন। তাই লোকরা এ মাসে ঘরে বসে দিন কাটাত। এজন্য এই মাসকে জিলকদ নামে অভিহিত করা হয়। এ মাসে মুসলমানরা হজের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তবে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার অনুমতি রয়েছে। 


১২. জিলহজ - ذو الحجة অর্থ হজ্জের মাস। ইসলামি ক্যালেন্ডারের বারোতম ও সর্বশেষ মাস জিলহজ। এটি ফরজ বিধান হজ পালনের মাস। এজন্য এ মাসকে জিলহজ বলা হয়। এর ৯ তারিখ মুসলমানরা হজ আদায়ের জন্য আরাফার ময়দানে একত্র হন। ১০ তারিখ হযরত ইবরাহিমের (আ.) আদর্শ বাস্তবায়নকল্পে আল্লাহর দরবারে পশু কোরবানি করেন। এ মাসের ৮, ৯ ও ১০ তারিখে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়। ঈদুল আযহা এই মাসের ১০ তারিখে শুরু হয় এবং ১২ তারিখ সূর্যাস্তের সাথে সাথে শেষ হয়। এই মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। 

(ইবনে কাসির : ৪/১২৮-১২৯) 



Post a Comment

Previous Post Next Post