মিসওয়াক : একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ্

মিসওয়াক একটি সুন্নত : মুমিনের হাতিয়ার

মিসওয়াক একটি সুন্নত এবং দ্বীনের অংশ। তা শুধুই দাঁতের ময়লা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য নয়; বরং তার আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হাঁ, দুর্গন্ধ ও ময়লা দূর হওয়াও এর একটি উদ্দেশ্য। ইসলামের প্রতিটি বিধানই ইহকালীন ও পরকালীন উভয় প্রকার কল্যাণে পরিপূর্ণ।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং সুন্দর ও উত্তমরূপে চলা ইসলামের সর্বব্যাপী শিক্ষা। একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচ্ছন্ন থাকা এবং উত্তম বেশ-ভূষা ধারন করাকে একজন মুসলিমের একটি বিশেষ প্রতিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে চেনা যাবে যে, সে একজন মুসলমান।

এক সফরে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন- যারা নিজেদের ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন-

إِنّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إِخْوَانِكُمْ، فَأَصْلِحُوا رِحَالَكُمْ، وَأَصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ، حَتّى تَكُونُوا كَأَنّكُمْ شَامَةٌ فِي النّاسِ.

তোমরা তোমাদের ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছ। তাই নিজেদের বাহন ও আসবাবপত্র ঠিকঠাক ও পরিপাটি করে নাও এবং সুন্দর ও  উত্তম বেশ-ভূষা ধারন কর; যেন মানুষদের মাঝে তোমাদেরকে তিলকের মত মনে হয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৮৯; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/২০৩)

মেসওয়াকের ফজিলত : মেসওয়াকের ওসিলায় বিজয়

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.)এর মেসওয়াকের ওসিলায় যুদ্ধে বিজয়

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) এক যুদ্ধে শরীক ছিলেন। সে যুদ্ধে কাফেরদের দূর্গ জয় করা সম্ভব হচ্ছিল না। রাতে তিনি খুব চিন্তিত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, হে আব্দুল্লাহ! কি চিন্তা করছো? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কাফেরদের ঐ দূর্গ জয় করতে পারছি না, তাই আমি চিন্তিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘অজুর সময় মেসওয়াক করবে।’ 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) ঘুম থেকে উঠে মেসওয়াক করে অজু করলেন। সাথীদেরকেও মেসওয়াক করার কথা বললেন। তাঁরা সবাই মেসওয়াক করে অজু করলেন। অপর দিকে দূর্গের পাহারাদার কাফের সৈনিকরা পাহাড়ের উপর থেকে মুসলিম মুজাহিদেরকে মেসওয়াক করতে দেখলো। এটা দেখে তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হলো। আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে তারা নিচে নেমে এসে দূর্গের নেতাদেরকে বললো, যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে তারা মনে হয় মানুষ খেকো। তারা তাদের দাঁত ধারাচ্ছে। এতে মনে হয় তারা আমাদের উপর বিজয় লাভ করে আমাদেরকে খাবে। 

সূতরাং তাদের নিকট দূত পাঠিয়ে বলে দিন, তোমরা সম্পদ চাও না প্রাণ চাও? তাই তারা দূত পাঠালো। দূত এসে এ কথা বললে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) বললেন, আমরা সম্পদ চাই না, প্রাণও চাই না। বরং আমরা চাই যে, তোমরা ইসলাম র্ধম গ্রহণ করো আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তোমরা বেঁচে যাবে। মেসওয়াকের এ সুন্নাতের উপর আমল করার বরকতে তারা সকলেই মুসলমান হয়ে গেলো। (ফাজায়েলে সিওয়াক, পৃষ্ঠা-১০৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে জানতে পড়ুন- ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (দুনিয়াবিরাগী আবিদ)

মেসওয়াক অবমাননা করার শিক্ষণীয় ঘটনা 

‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ নামক কিতাবে আছে, বসরা এলাকার অধিবাসী ‘আবু সালাম’ নামক এক ব্যক্তি ছিলো। সে ছিলো অত্যন্ত বেপরোয়া ও নির্লজ্জ। একবার তার সামনে মেসওয়াকের ফজীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলে সে রাগান্বিত হয়ে শপথ করে বললো, আমি আমার নিতম্বেই মেসওয়াক করবো। এরপর সে নিতম্বে মেসওয়াক ঘসে শপথ পূর্ণ করলো। এমন চরম বেয়াদবীর কারণে কুদরতীভাবে ঠিক নয় মাস পর একদিন তার পেট ব্যথা শুরু হলো। পেট ব্যথা শুরু হলে, কিছু সময় পর তার পেট থেকে বন্য ইদুরের মতো কুশ্রী এক প্রাণী ভূমিষ্ট হলো। ঐ প্রাণীর লেজ ছিলো এক বিঘাত চার আঙ্গুল লম্বা। পা ছিলো চারটা। মাথা ছিলো মাছের মাথার মতো। চারটি দাঁত বাহিরের দিকে বের হয়েছিলো। ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ঐ প্রাণীটি তিনবার চিৎকার দিয়েছিলো। তখন তার মেয়ে এসে ঐ প্রাণীটিকে মেরে ফেললো। এর তিন দিন পর আবু সালামও মারা গেলো। মারা যাওয়ার আগে সে বলেছিলো, এ প্রাণী আমার পেটের নাড়ীভূড়ি কেটে ফেলেছে। 

এ ঘটনা ৬৬৫ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তখন সেখানে অনেক খতীব ও ইমাম সাহেব ছিলেন। তারা সকলে সরাসরি এ ঘটনা দেখে ছিলেন। (ফাজায়েলে সিওয়াক, পৃষ্ঠা-৬০)। 
মিসওয়াকঃ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ্
মিসওয়াকঃ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ্
মেসওয়াক কেমন হওয়া উত্তমঃ

১. মেসওয়াক পীলু বা যয়তুনের ডালের হওয়া উত্তম।

২. মেসওয়াক কনিষ্ঠ আঙ্গুলের মত মােটা হওয়া উত্তম।

৩. মেসওয়াক প্রথমে এক বিঘত পরিমাণ লম্বা হওয়া উত্তম।

৪. মেসওয়াক নরম হওয়া মােনাসেব।

৫. মেসওয়াক কম গিরা সম্পন্ন হওয়া উত্তম।

৬. মেসওয়াকের ডাল কাঁচা হওয়া উত্তম। 

মেসওয়াক ধরার তরীকা পদ্ধতিঃ

১. মেসওয়াক ডান হাতে ধরা মােস্তাহাব।

২. মেসওয়াক ধরার তরীকা হল ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল মেসওয়াকের নীচে, বৃদ্ধ আঙ্গুলের অগ্রভাব মেসওয়াকের উপরের দিকে নীচেয় এবং অবশিষ্ট আঙ্গুলগুলাে (মধ্যের তিন আঙ্গুল) মেসওয়াকের উপরে রাখবে। 

মেসওয়াকের দুআ ও যিকির বিষয়কঃ

১. বিসমিল্লাহ বলে মেসওয়াক শুরু করবে।

২. মেসওয়াক শুরু করার সময় দুআ পড়া মােস্তাহাব। দুআটি'র বাংলা অর্থঃ

অর্থঃ হে আল্লাহ, এই মেসওয়াক করাকে আমার পাপ মােচনকারী ও তােমার রেজামন্দীর ওছীলা বানাও, আর আমার দাঁতগুলিকে যেমনি তুমি সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চেহারাকেও উজ্জ্বল (সুন্দর) কর।

মেসওয়াক করার তরীকা বিষয়কঃ

১. মেসওয়া্ক শুরু করার পূর্বে ভিজিয়ে নেয়া উত্তম।

২. প্রথমে উপরের দাতের ডান দিক অতঃপর বাম দিক, তারপর নীচের দাঁতের ডান দিকে অতঃপর বাম দিকে, তারপর দাঁতের ভিতরের দিকে অনুরূপ ভাবে ঘষতে হবে। 

৩. এভাবে তিনবার ঘষা উত্তম। প্রতিবারেই নতুন পানি দিয়ে মেসওয়াক ধুয়ে নেয়া মােস্তাহাব। 

8. মেসওয়াক দাঁতের অগ্রভাগে, উপর ও নীচের তালুর অগ্রভাগে এবং জিহবার উপরিভাগেও করা উত্তম।

৫. মেসওয়াক দাঁতের উপর চওড়াভাবে ঘষা নিয়ম। ইমাম গাযালী (রহঃ) উপর নীচে ঘষার কথাও বলেছেন। কমপক্ষে চওড়াভাবে ঘষতে হবে।

৬. শােয়া অবস্থায় মেসওয়াক করা মাকরূহ।

৭. মেসওয়াক করার পর মেসওয়াক ধুয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে।

বিঃ দ্রঃ মেসওয়াক না থাকলে মেসওয়াকের বিকল্প হিসেবে ব্রাশ ব্যবহার করা যায়। এতে মেসওয়াকের ডাল বিষয়ক সুন্নাত আদায় না হলেও মাজা ও পরিষ্কার করার সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। অন্যথায় হাত দিয়ে বা মােটা কাপড় দিয়ে দাঁত মেজে নিতে হবে। হাত দিয়ে মাজার তরীকা হল ও ডান হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে ডান পাশের দাঁতের উপরে অতঃপর নীচে, তারপর শাহাদাত (তর্জনী) আঙ্গুল দিয়ে বাম পাশের দাঁতের উপরে অতঃপর নীচে ঘষতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ 
১. আহকামে জিন্দেগী/মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন/মেসওয়াকের ফজিলত/মিসওয়াক করার নিয়ম ও আদবসমুহ/মেসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কিত। 
أحدث أقدم