মুহাম্মদ তপার : সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান

মুহাম্মদ তপার (গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মদ তপার ইবনে মালিক শাহ) ছিলেন সেলজুক সুলতান মালিক শাহ এর পুত্র এবং আহমেদ সেনজার এর আপন বড় ভাই। সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস এর উত্থানযুগ যেমন ছিল রোমাঞ্চকর তেমনি শেষ পর্যায়ে এর কাহিনীটা ছিল বেদনাবিধুর। ক্ষমতার জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই কখনোই যে ভালো কিছু বয়ে আনে না তা সেলজুকদের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি। 


সুলতান মুহাম্মদ তপার। মেলিক তপার
মুহাম্মদ তপার

সুলতান মালিক শাহ এর মৃত্যুর পর সন্তানেরা তার বিশাল সাম্রাজ্যকে সামলে রাখতে পারে নি। যদিও এর পিছনে অনেকগুল কারণ রয়েছে। যার মধ্যে নব্য দুটি শয়তানি শক্তি মুখ্য ভুমিকা রেখেছিল। তা হলো হাসান সাব্বাহ এর বাতেনী মতবাদ আর ইউরোপীয় খ্রিস্টান ক্রুসেডার শক্তি। এদের সাথে যুক্ত ছিল ভ্রান্ত শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ফাতেমি খিলাফত।


তপার একটি তুর্কি শব্দ। তপার শব্দের অর্থ "যিনি অর্জন করেন"। মুহাম্মদ তপার এর শৈশব সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তপার ১০৮২ সালে সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান মালিক শাহ এর ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ইসফাহানে নিজামুল মুলক এর তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। সুলতানের পাশে থেকে তিনি রাজনৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনি শিক্ষাও গ্রহণ করেন। 


১০৯৬ সালে তাকে তার ভাই আহমেদ সেনজার এর সাথে খোরাসান এর দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময় সেলজুক সুলতান ছিলেন মোহাম্মাদ বারকিয়ারুক। সুলতান বারকিয়ারুক যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন বেশ কয়েকটি বিদ্রোহের শিকার হন। মুহাম্মদ তপারও সিংহাসনের অধিকার আদায়ের জন্য বিদ্রোহ করে বসেন৷ ফলে বার্কিয়ারুক তাকে মেলিক উপাধি দিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এর আমির নিযুক্ত করেন৷ কিছুদিন পর, তপার আবারও বিদ্রোহ করেন কিন্তু এবার তিনি সফল হতে না পেরে ফিরে যান৷ ১১০৪ সালের দিকে বারকিয়ারুক ইবনে মালিক শাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সালতানাতের ভিতর বাহিরের শত্রুদের আক্রমণে সুলতান বারকিয়ারুক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার ভাই তপারের সাথে সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে নেন। ১১০৫ সালে সুলতান বারকিয়ারুক ইবনে মালিক শাহ মারা যান। 


মুহাম্মদ তপার এর মুদ্রা
সুলতান তপারের মুদ্রা (Credit: Wikidata)

সুলতান বারকিয়ারুক এর মৃত্যুর পর সেলজুক সুলতান হিসেবে বারকিয়ারুক এর পুত্র মালিক শাহ দ্বিতীয় সিংহাসনে বসেন। মুহাম্মদ তপার তখন তার ভাতিজা মালিক শাহ দ্বিতীয় ইবনে বারকিয়ারুকের সাথে বাগদাদে শাসন কার্য পরিচালনা করছিলেন। বালক সুলতান মালিক শাহ দ্বিতীয় বাহ্যরূপে সুলতানের আসনে থাকলেও চাচা তপারই ছিলেন মূলত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অপরদিকে, খোরাসান একটি আঞ্চলিক প্রদেশ হওয়া সত্বেও আহমেদ সেনজার তার ভাই (বারকিয়ারুক) এর মৃত্যুর পর স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। এসময় সেলজুক রাজ্য অনেকটা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। যার ফলে অনেক রাজ্যই স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্য পরিচালনা করছিল। 


১১০৭ সালে খাবুর নদীর যুদ্ধে আলেপ্পোর আমির মেলিক তেকিসেরর পুত্র ফখরুদ্দিন রেদোয়ান কিলিজ আরসালান এর মুখোমুখি হন। কিলিজ আরসলান প্রথম মুসলিম সেনাপতি ছিলেন যিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, কিশোর বয়সেই তিনি ঘোড়ায় চড়ে তীরন্দাজি খুব ভালো ভাবেই রপ্ত করেছিলেন। সেই যুদ্ধে কিলিজ আরসালান পালাতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা যান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক Ed. Peter Malcolm Holt এর ভাষ্যমতে, মুহাম্মদ তপার রেদোয়ানকে এ যুদ্ধে সহায়তা করছিল। যদিও কোন মুসলিম স্কলার তা উল্লেখ করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। 


 ১১০৬ সালে মুহাম্মদ তপার শাহদিজের ইসমাইলি দূর্গ জয় করেন এবং বাওয়ানদিদের শাসক শাহরিয়ার চতুর্থকে ইসমাইলিদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে অংশ নেওয়ার আদেশ দেন। শাহরিয়ার এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। মুহাম্মদ তাকে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার উত্তরে তিনি ইসমাইলীদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। মুহম্মদ তপার তখন আমির চাভলির নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, যিনি ইরানের একটি অঞ্চল অবরোধ করেছিলেন কিন্তু শাহরিয়ার ও তাঁর পুত্র তৃতীয় ক্যারিনের নেতৃত্বে অপ্রত্যাশিতভাবে একটি বাহিনী নিয়ে চাভলি কে মোকাবেলা করে। মুহাম্মদ তপার পরবর্তীতে আরো একটি চিঠি প্রেরণ করেন, যা শাহরিয়ারকে অনুরোধ করেন যেন তার কোন একজন পুত্রকে ইসফাহানের সেলজুক দরবারে প্রেরণ করেন। শাহরিয়ার তার ছেলে আলীকে ইসফাহানে বিপুল উপহারসহ প্রেরণ করেছিলেন, যিনি মুহাম্মদকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলেন যে তিনি তাকে বিবাহের ক্ষেত্রে তাঁর কন্যার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আলী তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তার ভাই ক্যারিনকে এই সম্মান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে সুলতান তা গ্রহণ করেন এবং কুরিনের সাথে তার কন্যার বিয়ে হয়।


১১০৭ সালের দিকের ঘটনা, বিখ্যাত উজির নিজামুল মুলকের পুত্র আহমাদ ইবনে নিজাম আল-মুলক হামাদানের রাইস (প্রধান) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে ইসফাহানে সুলতানের দরবারে যান। আহমদ যখন আদালতে উপস্থিত হলেন, মুহাম্মদ তপার তখন তাকে দেখে অনেক খুশি হন, তিনি সাদ আল-মুলক আবু'আল মহসিন আবিরের পরিবর্তে তাকে উজির নিয়োগ করেন। ধারণা করা হয়, সাদ আল মূলকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ধর্মবিরোধের অভিযোগ ছিল।


সেলজুক সাম্রাজ্যের মানচিত্র। মুহাম্মদ তপার
সেলজুক সাম্রাজ্যের মানচিত্র (Credit: Wikipedia)


উজির পদে নিয়োগ পাওয়ার মতো তেমন কোন গুন আহমেদ এর ছিল না৷ কিন্তু তবুও সে পদটি পেয়েছিল কেবল তার পিতা নিজামুল মুলক এর খ্যাতির কারণে৷ তারপরে তাকে বিভিন্ন পদবি দেওয়া হয়েছিল যা তাঁর পিতা পেয়েছিলেন (ক্বাউম আল-দীন, সদর-ইসলাম এবং নিজাম আল-মুলক)।


 মুহাম্মদ প্রথম বা তপার তার উজির আহমদকে সাথে নিয়ে ইরাকে একটি অভিযান চালিয়েছিলেন, সেখানে তারা "আরবদের রাজা" উপাধি প্রাপ্ত মাজিয়াদীদ এর শাসক সাইফুদ্দৌলা সাদাকা ইবনে মনসুরকে পরাজিত ও হত্যা করেন।  ১১০৯ সালে, সুলতান তপার তার উজির আহমদ এবং চাভলি সাকাভুকে আলমাতে ইসমাইলি দুর্গগুলি দখল করতে প্রেরণ করেন তবে তারা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় এবং খালি হাতে ফিরে আসেন।


সুলতান মুহম্মদ তপার ১১১৮ সালে মারা যান এবং তার পুত্র দ্বিতীয় মাহমুদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন, যদিও মুহাম্মদ প্রথমের মৃত্যুর পরে আহমেদ সেনজার স্পষ্টতই সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রধান শক্তি ছিলেন।



কীওয়ার্ডঃ সুলতান মুহাম্মদ তপার, মেলিক তপার, মেলিক তেকিস, মালিক শাহ এর পুত্র, তপার।



তথ্যসূত্রঃ 

‌1. Anatolia in the Period of the Seljuks and the Beyliks, Osman Turan, The Cambridge History of Islam, Ed. Peter Malcolm Holt, Ann K. S. Lambton and Bernard Lewis, (Cambridge University Press, 1970), 239.

2. Barkyaruq, Cl. Cahen, The Encyclopedia of Islam, Ed. H.A.R.Gibb, J.H.Kramers, E. Levi-Provencal and J.Schacht, (E.J.Brill, 1986), 1052.

Acknowledgement : this article is translated from Wikipedia English

Previous Post Next Post