জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ : Jalal al-Din Khwarazmshah

জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ Jalal al-Din Khwarazmshah

৬১৫ হিজরীতে (১২৬৬-৬৭ খ্রি) চেঙ্গিয খান ইসলামী দেশসমূহের উদ্দেশে অভিযান পরিচালনা করেন । তিনি আনযারের নিকটবর্তী হয়ে তার তিন পুত্র ভূর্জী খান, উকতাই খান ও চুগতাই খানকে আনযার অবরোধে মোতায়েন করেন। তারপর আলাক নূইয়া ও মননকৃ বূকাকে এক এক বাহিনী দিয়ে খোজান্দ ও নাবাকত অভিমুখে প্রেরণ করেন এবং আপন কনিষ্ঠ পুত্র তূলীখানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি স্বয়ং বুখারা অভিমুখে রওয়ানা হন। মুঘলদের এই হামলার খবর পেয়ে খাওয়ারিযম শাহ ষাট হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী আনযারের দিকে এবং ত্রিশ হাজার অশ্বারোহীর এক বাহিনী বুখারার দিকে প্রেরণ করেন। তারপর দুই লক্ষ দশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে সমরকন্দের হিফাযতের জন্য এবং ষাট হাজার লোককে বুরুজ ও দুর্গ মেরামতের জন্য মোতায়েন করে স্বয়ং সমরকন্দ থেকে খুরাসানের উদ্দেশে রওয়ানা হন।

খোরাসান অঞ্চল
খোরাসান অঞ্চলের একটি চিত্র

এক্ষেত্রে খাওয়ারিজম শাহের যে বিরাট ভ্রান্তি বা কাপুরুষতা লক্ষ্য করা গেছে তা হলো, এত বিরাট এক সেনাবাহিনীর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বয়ং চেঙ্গিয খানের মুকাবিলা করেননি, বরং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে আসেন। নিজেদের বাদশাহকে সমরকন্দ্দ ছেড়ে খুরাসানের দিকে যেতে দেখে নিশ্চয়ই খাওয়ারিজম শাহের সৈন্যদের অন্তরে কিছু না কিছু হতাশার সৃষ্টি হয়ে থাকবে। এর চাইতেও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, যখন তিনি সমরকন্দ ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন একটি পরিখার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, আমাদের উপর এত বিরাট এক জাতি হামলা করেছে যে, যদি তারা শুধু নিজেদের চাবুকগুলো একত্র করে ফেলে দেয় তাহলে সমরকন্দের এই পরিখা পূর্ণ হয়ে যাবে। এ কথা শুনে সমরকন্দের হিফাজতে নিয়োজিত সৈন্যরা মুঘলদের সম্পর্কে আরো বেশি ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। খাওয়ারিজম শাহ সমরকন্দ থেকে বলখে গিয়ে পৌঁছেন এবং আপন পরিবার-পরিজন ও ধনসম্পদ মাযেন্দানে পাঠিয়ে দেন। বলখে পৌঁছে তিনি মুঘলদের মুকাবিলায় কি কৌশল অবলম্বন করতে হবে সে সম্পর্কে আপন আমীর-উমারা ও অধিনায়কদের সাথে পরামর্শ করেন। খাওয়ারিজম শাহের ছিল সাত পুত্র। তন্মধ্যে জালালুদ্দীন নামক পুত্র পিতাকে ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় দেখে বললঃ আপনি যদি ইরাকের দিকে যেতে চান তাহলে সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব আমার হাতে অৰ্পণ করে নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আল্লাহ্ চাহে তো আমি শত্রুদের উপর হামলা চালাবো এবং জাইন নদীর ওপারে গিয়ে আমার তাঁবু স্থাপন করব। মাওরাউন না আমার দায়িত্বে অর্পণ করুন এবং আপনি শুধু ইরাক ও খুরাসান সামলান। কিন্তু খাওয়ারিজম শাহ তার পুত্রের একথা পছন্দ করলেন না। তিনি বলখ থেকে হিরাত অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন । ইতিমধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে, মুঘলরা বুখারা জয় করে সেখানকার সমগ্র অধিবাসীকে হত্যা করে ফেলেছে। এ সংবাদ শুনে খাওয়ারিজম শাহ আরো বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং হিরাত থেকে নিশাপুর চলে যান। মুঘলরা তখন পর্যন্ত জাইহুন নদী অতিক্রম করার সাহস পায়নি বরং মাওরাউন নাহরেই লুটপাট চালাতে থাকে। এদিকে খাওয়ারিজম শাহ নিশাপুরে আব্রাম-আয়েশে লিপ্ত থাকেন ।


৬১৭ হিজরীর সফর (১২২০ খ্রি মে) মাসে চেঙ্গিয খানের জনৈক অধিনায়ক ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে জাইয়ূন নদী অতিক্রম করেন। এই সংবাদ শুনে খাওয়ারিজম শাহ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং পরিবার-পরিজন ও ধনভাণ্ডার কারূন দুর্গে পাঠিয়ে দিয়ে স্বাধীন নিশাপুর থেকে ইসফারাইনে চলে যান। মুঘলরা যখন লক্ষ্য করল কেউ তাদের মুকাবিলায় আসছেন না বরং তাদের ভয়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের সাহস আরো বৃদ্ধি পায়। তারা এবার আগে বেড়ে খাওয়ারিজম শাহের পশ্চাদ্ধাবন করতে শুরু করে। খাওয়ারিজম শাহ মুঘলদের থেকে পালাতে পালাতে কারূনে গিয়ে পৌঁছেন, যেখানে তার পরিবার-পরিজন ও ধনভাণ্ডার ছিল। কিন্তু তার সেখানে পৌঁছার পূর্বেই মুঘলরা অপর দিক থেকে এসে কারূন দুর্গ অবরোধ করে ফেলেছিল। তারপর খাওয়ারিজম শাহ সেখান থেকে পালিয়ে আস্তারাবাদ, তারপর আস্তারাবাদ থেকে আমল গিয়ে পৌঁছেন। ..


খাওয়ারিজম শাহের মৃত্যু


শেষ পর্যন্ত খাওয়ারিজম শাহ একটি দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তার কাছে সংবাদ পৌঁছে যে, মুঘলরা কারূন দুর্গ জয় করে তার সমগ্র ধনভাণ্ডার এবং পরিবার-পরিজনের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। এই সংবাদ শুনে তিনি এতই দুঃখিত ও মর্মাহত হন যে, সেই দুঃখেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। তিনি যে পোশাক পরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই পোশাকেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। কোন কাফন তার ভাগ্যে জুটেনি। এবার মুঘলরা সমগ্র খুরাসান ও ইরানে লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে । বিভিন্ন প্রদেশের শাসন ক্ষমতায় নিয়োজিত খাওয়ারিজম শাহের পুত্ররা মুঘলদের হাতে নিহত হন। শুধু একজন পুত্র অবশিষ্ট থাকেন। তার নাম ছিল জালালুদ্দীন। তিনি তাঁর ভাইদের মধ্যে অধিকতর বিচক্ষণ বিদ্যোৎসাহী ও বীর পুরুষ ছিলেন।


জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ | জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ
খোরাসানের একটি উপত্যকা

এই সময়ে বুখারা, সমরকন্দ প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে মুঘলরা সমগ্র খুরাসানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৬১৭ হিজরীর রবিউল আউয়ালের শেষ দিকে (১২২০ খ্রি জুনের প্রথম দিকে) চেঙ্গিয খান জাইন নদী অতিক্রম করে বলখ ও হিরাতে পাইকারী হত্যাকাণ্ড চালান। যখন খাওয়ারিজম শাহের পরিবার-পরিজন বন্দী হয়ে চেঙ্গিস খানের সামনে নীত হন তখন ঐ পাষাণ ব্যক্তিটি স্ত্রীলোক এবং শিশুদের প্রতিও কোনরূপ দয়া প্রদর্শন করেননি, বরং সকলকে হত্যার নির্দেশ দেন। বলখ ও হিরাতের পর মুঘলরা নিশাপুর, মায়েন্দাস্নান, আমল, রাই, হামদান, কুম, কাযডীন, তাবরীয, তিফলীস, মারাগাহ্ প্রভৃতি স্থানে এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালায় যে, তাদের হাত থেকে শিশু, স্ত্রীলোক, বৃদ্ধ কেউই রক্ষা পায়নি। যেহেতু আল্লাহ্ বান্দাদেরকে এরূপ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার দৃশ্য ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি তাই জনসাধারণ মুঘলদের সম্পর্কে এতই ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, একজন মুঘল স্ত্রীলোকও কোন ঘরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে দিলে তাকে বাধা দান তো দূরের কথা, তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার মত সাহসও কারো হতো না। হামদানবাসীরা, যারা মুঘলদের পাইকারী হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিল, একত্রিত হয় এবং মুঘলদের স্থানীয় শাসনকর্তাকে দুর্বল পেয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর মুঘলরা হামদানবাসীদেরকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হত্যা করে। তারপর মুঘলদের মুকাবিলা করার দুঃসাহস আর কারো হয়নি।


জালালুদ্দীন ইবনে খাওয়ারিজম শাহ

জালালুদ্দীন ইব্‌ন খাওয়ারিজম শাহ আপন পিতার মৃত্যুর পর কাস্পিয়ান সাগরের একটি দ্বীপ থেকে রওয়ানা হয়ে তাবরীয় শহরে আসেন। এখানে এসে তিনি তার কিছু সংখ্যক দুঃসাহসী বন্ধু-বান্ধবকে একত্র করেন। মুঘলরা তাকে বন্দী করার জন্য ঘেরাও করে। কিন্তু তিনি আপন সঙ্গী-সাথীসহ মুঘলদের ঘেরাও থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি গাযনীনে যান। সেখানে তার চারপাশে বেশ কিছুসংখ্যক সহানুভূতিশীল ও সমব্যথী বন্ধু এসে জোটে । জালালুদ্দীন কিছুটা দুঃসাহস করে ঐ অঞ্চলে যে মুঘল বাহিনী ছিল তাদের উপর হামলা চালান এবং তাদেরকে পরাজিত করেন। খুব সম্ভবত এই প্রথম বারের মত মুঘলবাহিনী জালালুদ্দীনের মুকাবিলায় পরাজয় বরণ করে। এই সংবাদ শুনে চেঙ্গিয খান তাইফান দুর্গ থেকে রওয়ানা হয়ে বামিয়ান এসে পৌঁছেন। সেখানে তার এক নাতি অর্থাৎ দুঘতাই খানের পুত্র তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। চেঙ্গিয খান বামিয়ানের স্ত্রী-পুরুষ সবাইকে হত্যা করার এমনি কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোককে হত্যা করা হলে তার গর্ভ থেকে বাচ্চা বের করে সে বাচ্চারও গর্দান মারা হতো। সুলতান জালালুদ্দীন মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করার পর অনতিবিলম্বে আপন অবস্থাকে মজবুত ও সুদৃঢ় করে তুলেন এবং চেঙ্গিয খানের মুকাবিলার প্রস্তুতি নেন। যদি খাওয়ারিযম শাহের পরিবর্তে জালালুদ্দীন বাদশাহ হতেন তাহলে মুঘলরা এরূপ বাড়াবাড়ি করার সুযোগ নিশ্চয়ই পেত না। খাওয়ারিজম শাহেরই ভীরুতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে তার বিরাট সেনাবাহিনী কোন কাজে লাগেনি । তিনি তার অধীনস্থ শহর, বন্দর ও বসতিসমূহকে মুঘলদের সহজ শিকারে পরিণত করে এখান থেকে সেখানে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। যাহোক, সুলতান জালালুদ্দীন এক বাহিনী গঠন করে চেঙ্গিয খানের মুকাবিলায় উদ্যত হয়েছেন ঠিক এমনি মুহূর্তে বাহিনীর কিছু সংখ্যক অধিনায়ক ধোঁকা দিয়ে মুঘলদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। ফলে জালালুদ্দীনের কাছে শুধু সাতশ লোক থাকে । ওদেরকে নিয়েই লড়তে লড়তে সুলতান জালালুদ্দীন সিন্ধু নদের উপকূল অভিমুখে রওয়ানা হন। চেঙ্গিয খানও আপন বিরাট বাহিনী নিয়ে সেখানে এসে পৌঁছেন । জালালুদ্দীন সিন্ধুনদকে পটভূমিতে রেখে মুঘল বাহিনীর মুকাবিলা করেন। মুঘলরা ধনুক আকারে ঘেরাও করে জালালুদ্দীনের উপর হামলা চালায়। এতদসত্ত্বেও জালালুদ্দীন অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুঘলদের মুকাবিলা করেন এবং তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। সুলতান জালালুদ্দীন যখন বিপুল বিক্রমে মুঘলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন তখন তারা অনেক দূর পিছনে হটে যেত । কিন্তু প্রচুর জনবল থাকায় তারা পুনরায় এগিয়ে এসে হামলা করত। নিজের জনবলের স্বল্পতার কারণে এই যুদ্ধে সুলতান জালালুদ্দীন জয়ী হতে পারেননি সত্য, তবে এর মাধ্যমে তাঁর বীরত্ব, তেজস্বিতা ও দুঃসাহসিকতার যে ছবি চেঙ্গিস খানের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তা বোধ করি তিনি কোনদিন বিস্মৃত হতে পারেননি। জালালুদ্দীন খাওয়ারিজম শাহ বাহিনীর এই সাতশ বীর যোদ্ধার মধ্যে মাত্র একশ জনের মত যখন অবশিষ্ট থাকে তখন জালালুদ্দীন আপন দেহ থেকে বর্ম খুলে দূরে নিক্ষেপ করেন এবং নিজের মুকুটটি হাতে নিয়ে সিন্ধু নদে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। বাকি সঙ্গীরাও তাদের নেতাকে অনুসরণ করে। চেঙ্গিয খান চেয়েছিলেন মুঘলবাহিনীও যেন ওদেরকে অনুসরণ করে এবং জালালুদ্দীনকে বন্দী করে নিয়ে আসে। কিন্তু ঐ উত্তাল সমুদ্রে ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়া যে যার তার কাজ নয়। যাহোক, চেঙ্গিয খান এবং মুঘল বাহিনী সিন্ধু নদের তীরে দাঁড়িয়ে ঐ সামান্য কয়েকজন সৈন্যের উপর অবিরাম তীর বর্ষণ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সুলতান জালালুদ্দীনসহ মাত্র সাত ব্যক্তি সাঁতরিয়ে তীরে উঠতে সক্ষম হন। বাকি সবাই মুঘলদের তীরের আঘাতে নিহত হয়। সুলতান জালালুদ্দীন এপারে পৌঁছে দেহ থেকে কাপড় খুলে তা শুকাবার জন্য ঝোঁপের উপর দেন। তারপর নিজের বর্শাটি ভূমির উপর গেড়ে তার উপর মুকুটটি রাখেন এবং তার নিচে বসে বিশ্রাম নিতে থাকেন। তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে জিনটিও খুলেন এবং তা শুকাবার জন্য সামনে রেখে দেন।


চেঙ্গিয খান অপর পারে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে জালালুদ্দীনের এসব ব্যাপার লক্ষ্য করেন। এক সময় তিনি তার সকল পুত্র এবং অধিনায়কদেরকে, যারা সেখানে তার সাথে ছিল, সম্মুখে ডেকে এনে বলেন- আমি আজ পর্যন্ত এমন একজন বাহাদুর ও দুঃসাহসী ব্যক্তি দেখিনি । তাঁর সঙ্গীরাও তাঁরই মত অতুলনীয় বীর। এত বিরাট নদী এভাবে সাঁতরিয়ে অতিক্রম করা তাঁদের পক্ষেই সাজে। যদি এই ব্যক্তি জীবিত থাকে তাহলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে একদিন দুনিয়া থেকে মুঘলদের নাম-নিশানা মুছে তবে ক্ষান্ত হবে। অতএব একে হত্যার ব্যাপারে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কিন্তু চেঙ্গিয খানের পক্ষে সেদিন সিন্ধু নদের তীরে দাঁড়িয়ে শুধু আক্ষেপ করাটাই সার হলো। সিন্ধু নদ অতিক্রম করা তার বা তার বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হলো না। এটা হচ্ছে ৬২০ হিজরীর (১২২৩ খ্রি) ঘটনা।


জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ সম্পর্কে চেঙ্গিস খানের উক্তি
জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ সম্পর্কে চেঙ্গিস খানের উক্তি

তারপর সুলতান জালালুদ্দীন সিন্ধুর কিছু অঞ্চল জয় করেন। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেখানে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে থাকে। কিছুদিন পর সুলতান জালালুদ্দীন সিন্ধু নদ অতিক্রম করে কিরমানে এসে পৌঁছেন। সেখান থেকে শীরাযে যান। ঐ সময়ে তিনি ফিদায়ীদেরকে একের পর এক পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে আলামৃত দুর্গ ছাড়া তাদের প্রায় সবগুলো দুর্গই ধ্বংস করে ফেলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফিদায়ী বা বাতিনী সম্প্রদায় ইতিপূর্বে বর্ণিত মুঘলদের হামলা চলাকালে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত ছিল। মুসলমানদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা করা হচ্ছে, এ খবর শুনে তারা আনন্দ প্রকাশ করছিল। যেহেতু মুঘলদের মত ওরাও মুসলমানদের কট্টর শত্রু ছিল। তাঁদের মুঘলদের দিক থেকে তাদের কোন আশঙ্কা ছিল না। তারা মুসলমানদের বিপর্যস্ত অবস্থা লক্ষ্য করে নিজেদের দখলাধীন ভূখণ্ড অনেক বিস্তৃত করে নিয়েছিল । কারামতীয়দের মুকাবিলার ক্ষেত্রে সুলতান জালালুদ্দীনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তখন ছিল ঐ যুগ যখন মুঘলদের অভিযাত্রা উত্তরমুখী হয়ে গিয়েছিল । সুলতান জালালুদ্দীন সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মুঘলদেরকে ইসলামী দেশ থেকে বিতাড়ন এবং তাদের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে খলীফা নাসির লিদীনিল্লাহ্-এর কাছে গিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। জালালুদ্দীনের পিতার সাথে যেহেতু খলীফার বিদ্বেষ ছিল তাই তিনি জালালুদ্দীনকেও ঘৃণার চোখে দেখেন এবং তাঁকে অবিলম্বে বাগদাদ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তাঁর উমাবা ও অধিনায়কদেরকে নির্দেশ দেন। এই তামাশা দেখে সুলতান জালালুদ্দীন মুকাবিলার প্রস্তুতি নেন এবং বাগদাদের উমারা ও অধিনায়কদেরকে পরাজিত করে তাড়িয়ে দেন। তারপর তিনি বাগদাদে না এসে সেখান থেকে তাবরীয অভিমুখে রওয়ানা হন এবং তাবরীয দখল করে গারাজিস্তানের দিকে যাত্রা করেন। গারাজিস্তানের আমীর-উমারা অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায় এবং সেখানে তাঁর আগমনকে অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে অভিমত প্রকাশ করে ।


এবার সুলতান জালালুদ্দীনের অবস্থা বেশ আশাব্যঞ্জক হয়ে ওঠে এবং তা দেখে বিরাট মুঘলবাহিনী তার মুকাবিলায় ধেয়ে আসে। ইসপাহানের সন্নিকটে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে সুলতান জালালুদ্দীন মুঘলদেরকে পরাজিত করে পলায়নে বাধ্য করেন এবং এই বিরাট বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র গারাজিস্তান ও তার আশেপাশের এলাকা দখল করে নেন। তারপর মুঘলরা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে এসে সুলতান জালালুদ্দীনের উপর হামলা চালায়। পূর্বাহ্ণে এই হামলার প্রস্তুতি-সংবাদ শুনে সুলতান জালালুদ্দীন বাগদাদ এবং অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে দূত মারফত আবেদন জানান- এই মুহূর্তে আমাদের সাধারণ শত্রুকে ধ্বংসের ব্যাপারে আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। কিন্তু যেহেতু জালালুদ্দীনের বীরত্ব বাহাদুরীর খ্যাতি তখন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই ঈর্ষাবশত কোন রাষ্ট্রনায়কই জালালুদ্দীনের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেননি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি একাই মুঘলদের মুকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়ে যান। ঐ মুহূর্তে জালালুদ্দীন হয়ত মুঘলদের পরাজিত করে মুঘলদের মনে এমনি ভীতির সঞ্চার করতেন যে, তারা পরবর্তী সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যসমূহ আক্রমণ করার সাহস পেত না। কিন্তু এটা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল না। তাই দেখা যায়, মুঘল বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য জালালুদ্দীন যে সমস্ত গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন তারা তাকে এই সংবাদ দিল যে, মুঘল বাহিনী এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে। অথচ মুঘল বাহিনী তখন একেবারে সন্নিকটে এসে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুঘলরা ঠিক অর্ধেক রাতে অকস্মাৎ এমনভাবে হামলা চালাল যে, তখন শত্রুদের এভাবে আগমনের কথা জালালুদ্দীন কল্পনাও করতে পারেননি। এভাবে তিনি হঠাৎ নিজেকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখে বাধ্য হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কিন্তু যখন জয়ের কোনই সম্ভাবনা দেখতে পেলেন না তখন প্রবল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুর ঘেরাও থেকে বের হয়ে গেলেন। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ। তাঁর সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।


সুলতান জালালুদ্দীনের শেষ অবস্থাঃ সুলতান জালালুদ্দীনের পরিণাম সম্পর্কে দু'টি বর্ণনা খুবই বিখ্যাত। একটি বর্ননা এই যে, পলায়নরত অবস্থায় যখন তিনি পাহাড়ের কোন একটি জায়গায় বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন তখন তার ঘোড়া ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে কোন একটি পাহাড়ী লোকের ভয়ানক লোভ হয় এবং সে তাঁকে প্রতারণার মাধ্যমে হত্যা করে ফেলে। অপর বর্ণনা এই যে, তিনি তাঁর পোশাক পরিবর্তন করে অলী-আল্লাহ্দের খিদমতে গিয়ে হাযির হন এবং একজন সূফী ও আবিদ হিসাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। ঐ সময়ে তিনি দূর-দূরান্তের দেশসমূহ সফর করেন। এই সংসার ত্যাগী অবস্থায় তিনি নাকি দীর্ঘদিন বেঁচেছিলেন। 

Post a Comment

Previous Post Next Post