সিপাহি বিদ্রোহ : নাকি স্বাধীনতা সংগ্রাম

the sepoy mutiny সিপাহি বিদ্রোহ

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করতে ইংরেজ প্রশাসন ও সরকারের তল্লিবাহি গবেষকরা কোনো দ্বিধা করেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকেই এর ইতিহাস বিকৃত করার নানা উপায় বেছে নিয়েছে তারা। এই বিকৃতির প্রথম ধাপ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ করে দেয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর পর ইংরেজরা এই আন্দোলনকে সিপয় মিউটিনি বা সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করে। তাদের দাবি ছিল এটি সিপাহিদের একাংশের বিদ্রোহ, ভারতবাসী যার সাথে একমত ছিল না। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিদ্রোহ বলেন, তাদের দাবি এই লড়াইয়ের সূচনা করেছিল সিপাহিরাই। এ ছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়েও সিপাহিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে ছিলেন। ফলে একে সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করাই যুক্তিসংগত।


কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিদ্রোহের আগুন সেনা ব্যারাক থেকে জ্বলে উঠলেও ক্রমেই তা পরিণত হয়েছিল জনমানুষের আন্দোলনে। রাজপথে নেমে এসেছিল নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। প্রত্যেকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বেগবান করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে। অনেক স্থানে সিপাহিরা অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু একে কেন্দ্র করে পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র পাল্টে দেয়া যেতে পারে না। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালেই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ডিজরেলি হাউস অব কমন্সের সভায় ভাষণ দানকালে বলেন, একে সিপাহি বিদ্রোহ বলা ভুল হবে, এটি হলো জাতীয় বিদ্রোহ। (১৮৫৭ সালের ২৭ জুলাই তিনি এই বক্তব্য দেন। দেখুন, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, ১৮)


the sepoy mutiny map

স্বাধীনতা বিদ্রোহ/ সিপাহি বিদ্রোহের ম্যাপ

ডিজরেলির কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে হ্যাসটিল ম্যাকারফির কথাতেও। তিনি লিখেছেন, প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের ব্যাপক এলাকাজুড়ে দেশীয় জাতিগুলো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। একে নিছক সামরিক মিউটিনি বললে সত্যের অপলাপ হবে। (প্রাগুক্ত, ১৯) গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন, যদি আমরা দৃষ্টি শুধু বিদ্রোহের সূচনাবিন্দুতেই সীমাবদ্ধ রাখি তাহলে একে সিপাহি বিদ্রোহ বলা ঠিক আছে। কিন্তু যদি এর সামগ্রিক কাঠামো ও সকল কর্মসূচি লক্ষ করা হয় তাহলে স্পষ্ট হবে, মূলত এটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। কারণ, ইংরেজ শাসনের পতন ঘটাতেই এই সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। (আঠঠারো সো সাত্তাওয়ান পাক ও হিন্দ কি পেহলি জংগে আযিম, ৬৪)


স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্য নেতৃবৃন্দের দিকেও যদি তাকাই তাহলে সেখানে সিপাহিদের নাম নেই বললেই চলে। এই সংগ্রামের মূল্য নেতৃত্ব ছিল রানি লক্ষ্মী বাই, বেগম হজরত মহল, আজিমুল্লাহ খান, মাওলানা লিয়াকত আলি, নানাসাহেব, তাতিয়া টোপি, শাহজাদা ফিরোজ শাহ, মৌলবি আহমাদুল্লাহ শাহ প্রমুখ। তারা কেউই সিপাহি কিংবা সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন না। তাদের নেতৃত্বে যে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল একে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলে সীমাবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম হিসেবে পরিচয় করানো অনুচিত।


অনেকে প্রশ্ন তোলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। তাদের মতে শুরু থেকেই এটি ছিল সিপাহিদের একাংশের বিদ্রোহ। কারণ, তাদের সামনে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। ছিল না কোনো রোডম্যাপ। বিভিন্ন স্থানে তারা যোগাযোগ করেছিল সত্য, কিন্তু সেখানে পরিকল্পনা ও কৌশলের ঘাটতি ছিল। এ প্রশ্নের জবাবে গোলাম রসুল মেহের পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, পৃথিবীতে যত সংগ্রাম ও বিপ্লব হয়েছে তার মধ্যে ক'টিরই-বা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা জানা গেছে? ক'টি আন্দোলনের ব্যাপারেই-বা এমন বলা যায়, এর শেষভাগে এটি যেমন বিস্তৃত হয়েছিল শুরুতেও ঠিক তেমন বিস্তৃত ছিল? মেহেরের মতে বেশিরভাগ আন্দোলনই শুরু হয় অল্পকিছু মাওলানা লিয়াকত আলি, মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহ, মাওলানা সরফরাজ আলি প্রমুখ ছিলেন এই ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রামী। যাদের কোনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা স্বার্থ ছিল না। এই সংগ্রামে তারা জড়িয়েছেন শুধু একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। তারা প্রত্যেকেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চাচ্ছিলেন। তারা সেই আওয়াজই তুলেছিলেন, যা ৭০/৮০ বছর আগে মহীশুরে হায়দার আলি ও তার পুত্র টিপু সুলতান তুলেছিলেন। যে উদ্দেশ্য সাধনে টিপু সুলতান নিজের জীবন দিয়েছিলেন, তারা সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতেই মাঠে নেমেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মাওলানারা লালন করছিলেন সাইয়েদ আহমাদ শহিদের চেতনা, যা ১৮৩১ সালে ইংরেজ ও শিখ বাহিনীর হাতে পরাজিত হলেও নিভু নিভু হয়ে জ্বলছিল ভারতবর্ষের নানা স্থানে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে এই মাওলানাদের পৃথক করার সুযোগ নেই। যদি আমরা তাদের জীবন ও চিন্তাধারা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই, শুধু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যই তারা নিজেদের নিরাপদ জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে ময়দানে নেমে এসেছিলেন। সুতরাং তাদের এই সংগ্রামকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে সীমাবদ্ধ করে দিলে আড়ালে চলে ত্যাগের এক অপূর্ব ইতিহাস।


যদি একে নিছক সিপাহিদের বিদ্রোহই বলতে হয় তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে, ইংরেজ বাহিনীতে আগেও দেশীয় সিপাহিরা এ ধরনের অনেক বিদ্রোহ করেছিল। এমনকি বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে ইংরেজরা তাদের অনেককে তোপের মুখে উড়িয়েও দিয়েছিল। কিন্তু এসবের প্রতিক্রিয়ায় কখনোই সারা দেশে একযোগে ইংরেজবিরোধী লড়াই শুরু হয়নি। তাহলে ব্যারাকপুরে মঙ্গলপাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় এমন কী ছিল যা সারা দেশে একযোগে যুদ্ধের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। পূর্বের সেনা বিদ্রোহ ও ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এর চরিত্র পূর্বের থেকে ভিন্ন ছিল।


স্বাধীনতা সংগ্রামকে সিপাহি বিদ্রোহ বলার সমস্যা হলো, একে জনমানুষের আন্দোলন থেকে খারিজ করে নির্দিষ্ট শ্রেণির ক্ষোভ বা প্রতিহিংসা বলে চালিয়ে দেয়া। এতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবস্থান ভুল মনে হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে অনেকে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল; কিন্তু একে ভারতবাসীর সামগ্রিক অবস্থান হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। পৃথিবীর কোনো সংগ্রাম বা বিপ্লব এমন হয় না, যেখানে সমাজের সব সদস্য অংশ নেয়। কেউ না কেউ বিরোধিতা করেই এবং শত্রুপক্ষের সাথে হাতও মিলায়। কিন্তু এতে করে সমাজের মূলধারার অবস্থানটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।


পলাশির যুদ্ধে মির জাফর ও তার অনুসারীদের একাংশ হাত মিলিয়েছিল ইংরেজদের সাথে, কিন্তু এতে নবাব সিরাজের আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। মির সাদেকের ইংরেজপ্রীতির কথা টেনে যেভাবে টিপু সুলতানের অবস্থানকে হেয় করা যায় না।


স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি বাক সাক্ষ্য দেয় এই সংগ্রাম ছিল গণমানুষের সংগ্রাম। এতে ছিল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সত্যেন সেন আক্ষেপের সুরে লিখেছেন, আমাদের দেশের ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে একদল একে স্বাধীনতার সংগ্রাম আখ্যা দিতে রাজি নন। তাদের মতে এটা দেশীয় রাজা ও ভূস্বামীদের হৃত সম্পদ ও অধিকার পুনরুদ্ধাদের প্রচেষ্টা মাত্র। মূলত ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের আগেই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলির সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী ১৮২৬ সাল থেকে অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে জিহাদ চালিয়ে আসছিল তাকে অবশ্যই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা বলতে হবে। (ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, ২১)

1 Comments

  1. একশ ষাট বছর আগে ১৮৫৭ সালে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে উপমহাদেশে দেশীয় সিপাহিরা যে বিদ্রোহ করেছিল বৃটিশ ইতিহাসবিদরা সে ঘটনাকে সিপয় মিউটিনি' বা সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে বর্ণনা করলেও বাস্তবে পলাশী যুদ্ধের একশ বছর পর এটি ছিল উপমহাদেশে জনগোষ্ঠীর প্রথম স্বাধীনতার লড়াই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post