পাহাড়ের ওপরে থাকা জঙ্গলে বসে যারা এই যুদ্ধ দেখছে, তাদের নিজেদের অবস্থাও তেমন ভালাে না। কাবিলার মুরুব্বিদের কথা উপেক্ষা করে তারা আনাতােলিয়ায় এসেছে। এক সময় তারা মার্ভে থাকত, চেঙ্গিজ খানের আক্রমণে মার্ভ শ্মশান হওয়ার আগেই তারা মার্ভ ছেড়ে পালাতে পেরেছিল।
পাহাড়ের ওপর থেকে দলটা দেখতে পাচ্ছিল, অপেক্ষাকৃত ছােটো সেনাবাহিনীটা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। বড়াে সেনাবাহিনীটা তাদের ঘিরে ফেলছে ধীরে ধীরে। দলনেতা এক তরুণ তুর্কমেন বে। তিনি ভাবলেন, এই লড়াইয়ে অপেক্ষাকৃত ছোটো দলটাকে সাহায্য করা তার কর্তব্য। কারণ, এরা মজলুম। আর তুর্কমেন কখনাে জালিমের হাতে মজলুমকে ছেড়ে যায় না।
দলের যােদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে তিনি হাক ছাড়লেন, 'কস! কয়েক মুহূর্তের ভেতর লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে গেল যােদ্ধারা। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলাে কার বিরুদ্ধে তারা লড়তে যাচ্ছে। অর্ধবৃত্তাকারে বড়াে সেনাবাহিনীটাকে ঘিরে ধরল তুর্কমেন যােদ্ধারা, পাহাড়ের অনেক ওপর থেকে। তারা সংখ্যায় সামান্য, কিন্তু প্রত্যেকে একেকজন পরীক্ষিত ওঘুজ যােদ্ধা।
তাদের তীর শত্রুর মৃত্যু ডেকে আনে। তরুণ দলপতি একবার বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ধনুকের ছিলা টানটান করে ধরলেন, তারপর উচ্চারণ করলেন প্রভুর নাম, ইয়া হাক!
তীর ছুটে গেল, একে একে চারশাে তীর অপেক্ষাকৃত বড়াে বাহিনীটার সৈন্যরা তীর কোথেকে আসছে বুঝে উঠার আগেই অতর্কিত তীরে নিহত হলাে অনেকেই। তারপর হঠাৎ তারা দেখতে পেল পাহাড় থেকে ধুলাের ঝড় তুলে নেমে আসছে একদল ঘােড়সওয়ার। যুদ্ধের মােড় ঘুরে গেল। কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর পালাতে বাধ্য হলাে শক্তিশালী সেনাবাহিনীটা।
দুর্বল বাহিনীর প্রধান তুর্কমেন বে-কে কৃতজ্ঞতা জানালেন। আনাতােলিয়ার মানুষের মুখে মুখে শােনা যায় এই লড়াইয়ের কথা। যাকে সাহায্য করা হয়েছিল, তিনি সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ। আর যিনি সাহায্য করেছিলেন, তার নাম আরতুরুল বে। সুলেইমান শাহের ছেলে, কায়ি গােত্রের আরতুরুল বে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে সহযােগিতা করার পুরস্কার হিসেবে সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাকে সােগুত নামের একটা জেলা দান করলেন। সােগুত ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তের একেবারে কাছে। এই সীমান্ত শুধু সেলজুক-বাইজান্টাইন সীমান্তই না, ইসলামি জাহানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তও বটে।
আর্তুগ্রুল গাজী বা আর্তুগুল গাজী হলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজীর পিতা। আরতুগ্রুল আনুমানিক ১১৯১-১১৯৮ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে আহালাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ওর্ঘুজ তুর্কী যাযাবর গোত্র কায়ী গোত্রের নেতা সুলায়মান শাহের পুত্র। কায়ি একটি অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত যাযাবর জাতি। ১১শত শতাব্দীতে কায়ি শব্দটি সর্বপ্রথম তুর্কি পণ্ডিত মাহমুদ আল কাশগারি প্রথম বলেন। কায়ি শব্দের অর্থ সম্পর্কের দ্বারা যার ক্ষমতা আছে। সুলায়মান শাহ যখন গোত্রপতি তখন সব জায়গায় চলছিল মোঙ্গল বাহিনীর ধ্বংসাত্মক শক্তির খেলা। অন্য সব তুর্কী যাযাবর গোত্রের মতো কায়ীরাও মোঙ্গলদের হাত থেকে পালিয়ে আনাতলিয়ার দিকে চলে আসে। তুর্কী সব গোত্রের মধ্যে কায়ী গোত্র ছিল সবচেয়ে বড় আর সাহসী। যার ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তুর্কী গোত্রগুলি সবাই আনাতলিয়ায় একত্র হতে থাকে।
খােরাসান থেকে আনাতােলিয়ায় পালিয়ে এসেছিলেন আরও অনেকে। এদেরই একজন শায়খ নাসরুদ্দিন আবুল হাকায়িক মাহমুদ বিন আহমাদ আল খােয়ি। এই বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন একইসঙ্গে কারিগর, ব্যবসায়ী ও সুফি। তিনি বিশ্বাস করতেন, হালাল রুজি উপার্জন হলাে আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার সর্বোত্তম উপায়। আর হালাল রুজি উপার্জন করার সবচেয়ে ভালাে উপায় হালাল ব্যবসা। ব্যবসা এমন একটা পেশা, যেখানে ক্রতা, বিক্রেতা ও উৎপাদক তিন পক্ষই যদি সৎ না হয়, তাহলে কোনাে একপক্ষ বেশি দিন সততা ধরে রাখতে পারে না। নাসরুদ্দিনের ডাকনাম ছিল আখি এভরান। তিনি সৎ ব্যবসায়ে আগ্রহী তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল ভ্রাতৃসংঘ, যা আখিলিক নামে বিখ্যাত।
সুলাইমান শাহ এর কায়ী গোত্র মোঙ্গলদের সাথে লড়াই করে বীরের মতো। আহলাত থেকে আলেপ্পো, আলেপ্পো থেকে এরজুরুম সব জায়গায় ছুটেছেন নিজেদের ইমান রক্ষার জন্য। কী মোঙ্গল কী নাইট, সব শত্রুর সাথে বীর দর্পে লড়াই করার ক্ষেত্রে কায়ীদের সুনাম তখন অন্য সব বসতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
পুরােনাে জোব্বা পরা একজন বৃদ্ধ মৃদুস্বরে কথা বলছেন, তার চারপাশে ভিড় করেছে। প্রচুর মানুষ। বৃদ্ধ বলে চলেছেন, 'তােমরা কি আল্লাহ নামের প্রথম হরফ আলিফের হাকিকত বােঝাে?
জনতা বলল, না শায়খ, আমরা বুঝি না। আপনিই বলুন।
শায়খ বললেন, 'প্রথম হরফ আলিফ মানে আল্লাহতেই সমস্ত কিছুর শুরু। তিনি সব কিছুর উৎস। আলিফের আগে যেমন কোনাে হরফের অস্তিত্ব নেই, তেমনি আল্লাহর আগেও অন্য কোনাে কিছুর অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই আসে না।
ভিড়ের ভেতর থেকে প্রশ্ন করা হলাে- 'শায়খ, তাহলে আলিফের পরে যে লাম এসেছে, তার হাকিকত কী?
শায়খ বললেন, 'আলিফের পর যে দুটো লাম এসেছে, তার প্রথম লাম হলো আল্লাহর তারিফের জন্য। আর দ্বিতীয় লাম হলাে প্রথম লামে জোর দেওয়ার জন্য। এই দুই লামের পর আছে হা। মাখলুক যেন সহজেই তার দমে আল্লাহকে ধারণ করতেসেজন্য শেষ হরফ হিসেবে এসেছে হা। তােমরা দম নাও। দেখাে, প্রতি দমে তােমরা দুইবার হা পেশ হু উচ্চারণ করাে। কামিল ইনসান প্রতিবার দম নেওয়ার সময়েই আল্লাহকে স্মরণ করে, আর গাফিল ইনসান তার নিশ্বাসের ভেতরে থাকা হা সম্পর্কে বেখবর থাকে।
এই শায়খের নাম মুহিউদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনে আলি ইবনে মুহাম্মাদ আল আন্দালুসি। ইবন আল আরাবি নামে সবাই তাকে চেনে। ভক্তরা তাকে ডাকেন শায়খ আল আকবার নামে। জ্ঞানের এমন কোনাে শাখা নেই, যেখানে তার বিচরণ ছিল না। ধারণা করাহতাে, ত্রয়ােদশ শতাব্দীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি তিনি। এক অদ্ভুত স্বপ্ন তাকে আন্দালুসিয়া থেকে আনাতােলিয়ায় নিয়ে এসেছে।
আরতুগ্রুল গাজী ইবনে আরাবির সান্নিধ্যে যাওয়ার পর তিনি তার দেখানো পথে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেন যা পরবর্তীতে উসমানি খিলাফতের মধ্যদিয়ে বাস্তবায়ন হয়।
সুলাইমান শাহ এর মোট চার জন ছেলে সন্তান থাকলেও তার কোনো মেয়ে ছিল না। আরতুগ্রুলের তিন ভাইয়ের নাম ছিল; সুনগুর-তেকিন, গুন্দোগদু (গুর্দারো) এবং দ্বীনদার। পিতা সুলাইমান শাহ এর মৃত্যুর পর আরতুগ্রুল গাজী তার মা হায়মে হাতুনের সাথে, দ্বীনদার এবং কায়ী বসতিতে তাঁর অনুসারীদের সাথে নিয়ে আনাতলিয়ার পশ্চিমে যাত্রা করেন, যদিও তাঁর দুই ভাইকে পূর্ব দিকে স্থানান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আরতুগ্রুল বে জানতেন পশ্চিম সীমান্ত একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের উপযুক্ত ভুমি কিন্তু তার ভাই গুন্দারো তা মানতে চাচ্ছিলেন না যদিও সুনগুর তেকিন সবই জানতেন। রাজনৈতিক কারনে তিনিও নিরবতা পালন করেন। ফলে কায়ীরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, একটি পশ্চিমে বাইজেন্টাইন সীমান্তে আরতুগ্রুল বের অধীনে অন্যটি পূর্বে সুনগুর তেকিন ও গুনদারোর অধীনে।
সোগুত গ্রামে প্রথম উসমান কর্তৃক নির্মিত একটি গম্বুজ ও মসজিদ আরতুগ্রুলের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু অনেকবার পুনর্নির্মাণের ফলে এর উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। বর্তমান দরগাটি উনিশ শতকের শেষ দিকে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ কর্তৃক নির্মিত হয়। প্রথম দিকের উসমানীদের স্মরণে সাগুত শহরে বাৎসরিক উৎসবের আয়োজন করা হয়।
১৮৬৩ সালে অটোমানদের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তার নামে আরতুগ্রুল নামকরণ করা হয়। তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে একটি মসজিদও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। সুলতান আবদুল হামিদের একটি ইয়র্ড ছিল যা আরতুগ্রুল গাজী এর নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
উসমানীয় তথা অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্মাতা হিসাবে তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বীরত্ব-গাথা জীবনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। তাই তাকে এই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্মাতা হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়।
কীওয়ার্ডঃ আরতুগ্রুল গাজী, উসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাস, আরতুগ্রুল গাজী জীবনী, শায়েখ ইবনে আরাবি, আহি সংগঠন।
তথ্যসূত্রঃ
১. সানজাকে উসমান বই
২. ইতিবৃত্ত সাইট
৩. উইকিপিডিয়া বাংলা ও উইকিপিডিয়া ইংরেজি