পানিপথের প্রথম যুদ্ধ : ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল সূর্যোদয়

পানি পথের যুদ্ধ

থমথমে পানিপথের বাতাসের তখন যুদ্ধের জোরালো আগ্রাসন আর ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা যুদ্ধবাজ হাতি-ঘোড়ার ধ্বনি ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে যুদ্ধের আয়োজন এই বুঝি যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।


একদিকে মোঘল অধিপতি বাবর তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে প্রস্তুত। প্রায় আট হাজার সৈনিক সতর্কতার সাথে কান পেতে আছে বাবরের দিকে। যেকোনো সময় তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বাবরের নির্দেশে। অপরদিকে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকা ইব্রাহিম লোদির সুসজ্জিত বাহিনী। কারণ বাবরের চেয়ে তাদের শক্তিসংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বড়। 


বাবরকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য বদ্ধপরিকর সুলতানের বাহিনী। পানিপথ প্রান্তরে দু’পক্ষ অবস্থান করছেন প্রায় ৮ দিন ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কারো দিকে আক্রমণ চালাননি। ওদিকে বাবরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি হাত উঁচু করে ইশারা করলেন।


মুহূর্তের মধ্যে বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা । যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, পানিপথের যুদ্ধ!


পানিপথের প্রান্তর উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থান থেকে শুরু করে শক্তিশালী মারাঠাদের পতন পর্যন্ত প্রায় তিনটি বড় যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এখনো ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বর হয়ে আছে পানিপথ প্রান্তর।


পানিপথের যুদ্ধ


পানিপথ প্রান্তর

পানিপথ (Panipat) কোনো জলপথের নাম নয়। রাজধানী দিল্লীর উত্তরে অবস্থিত পানিপথ ভারতের হারিয়ানা প্রদেশের একটি শহরের নাম। মহাভারত অনুযায়ী, পানিপথ পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি শহরের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু মহাভারতের পানিপথকে কেউ হয়তো মনর রাখেনি। মহাভারতের ইতিহাস ছাপিয়ে পানিপথ মুখ্য হয়ে আছে মূলত পানিপথ প্রান্তরে ঘটে যাওয়া তিনটি বড় যুদ্ধের কারণে। (১৫২৬, ১৫৫৫, ১৭৬১)


পানিপথের মানচিত্র panipat

মানচিত্রে পানিপথের অবস্থান


পানিপথের প্রথম যুদ্ধঃ  সংঘটিত হয় ১৫২৬ সালে। 

প্রতিপক্ষঃ মোঘল অধিপতি বাবর এবং সুলতান ইব্রাহিম লোদী।


পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধঃ সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সালে।

প্রতিপক্ষঃ  সম্রাট আকবর এবং উত্তরের রাজা হেমচন্দ্র। 


পানিপথের সর্বশেষ যুদ্ধঃ সংঘটিত হয় ১৭৬১ সালে 

প্রতিপক্ষঃ মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন আহমদ শাহ আবদালী।


যুদ্ধের পটভূমি

তখনকার মোঘল অধিপতি বাবর, যার পুরো নাম ছিল জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তিনি ১৪৮৩ সালে উজবেকিস্তানের ফারগানা রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওমর শেখ মির্জা হলেন ফারগানার পূর্বকালীন অধিপতি তিমুরের বংশধর। আবার মায়ের দিক থেকে তিনি মঙ্গোল অধিপতি চেঙ্গিস খানের বংশধর। 


পূর্বসূরীদের মতোই বাবরের রক্তেও মিশে ছিল যুদ্ধের নেশা। সভাসদদের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ দিকে দৃষ্টিপাত করেন। দক্ষিণে তখন দিল্লীর সিংহাসন সুলতান ইব্রাহিম লোদির দখলে ছিল। বাবর খবর নিয়ে জানতে পারলেন লোদির সভাসদদের মধ্যেই অনেকে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেননি।


মোঘল সম্রাট বাবর ও ইব্রাহিম লোদী
মোঘল সম্রাট বাবর এবং দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদি; সূত্রঃ medium.com


ইব্রাহিম লোদি তার সভাসদদের মধ্যে বড় একটা অংশের বিদ্রোহের কথা জানতে পারেন এবং নির্বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। সভাসদদের একজন ছিলেন দৌলত খান লোদি। তিনি সম্পর্কে সুলতানের চাচা ছিলেন। কিন্তু তার নিজেরও প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি বাবরকে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অনুরোধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন বাবর সুলতানকে অপসারণ করে কাবুলে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাবরের মনে তখন ছিল ভারত দখলের নেশা।


বাবর প্রায় ১৫ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করেন। লোদির বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সেটা পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু বাবর তার সাথে নিয়ে নেন এক ‘গোপন অস্ত্র’। যা ইতিপূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে কেউ ব্যবহার করতে দেখেনি। 


ভারতবর্ষে প্রথম কামানের ব্যবহার Panipat cannon

উপমহাদেশে বাবর সর্বপ্রথম যুদ্ধে গোলন্দাজ বাহিনী সংযোজন করেন; সূত্রঃ Wikimedia commons

লোদির বিশাল বাহিনী দেখে বাবর চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধির কারণে মুখোমুখি হবার প্রথম দিনেই লোদিবাহিনী অগ্রসর হতে সাহস পায়নি। বাবর তার পুরো বাহিনীর বামদিকে পানিপথ শহর এবং ডানদিকে অসংখ্য খাদ নির্মাণ করে এমনভাবে অবস্থান করেন যে লোদিবাহিনীর আক্রমণের পথ খুব সরু হয়ে যায়। তারপর তার নির্দেশে সৈনিকরা শহর থেকে শত শত গরুর গাড়ি নিয়ে হাজির হন। বাবর গরুগুলো ছেড়ে দিয়ে গাড়িগুলোকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে অর্ধবৃত্তাকার প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। গাড়িগুলোর মাঝে যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা রাখেন। সেখানে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ পদাতিক সেনা মোতায়েন করেন।


এবার প্রতিবন্ধক থেকে আরো পেছনে তিনি তার কামানগুলো স্থাপন করেন। এর ফলে গোলন্দাজ বাহিনী লোদিবাহিনীর তীরন্দাজের সীমানার আওতামুক্ত হয়ে যায়। গোলন্দাজ বাহিনীর সাথে প্রায় হাজারখানেক সৈনিক অতিরিক্ত হিসেবে আলাদা করে রাখেন।


এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। দেখতে দেখতে ৭ দিন চলে যায়। লোদিবাহিনী এক পা-ও সামনে অগ্রসর হয়নি। বাবরের তীরন্দাজরা প্রতিদিন শত্রুপক্ষের দিকে অগ্নিফলক নিক্ষেপ করতো যেন লোদিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এমনকি বাবর রাতের অন্ধকারে লোদিবাহিনীর ব্যারাকে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু উল্টো তিনি নিজেই বিপদে পড়ে যান। সেবার অল্পের জন্য বেঁচে যায় মোঘল বাহিনী।


পরদিন সকালে লোদিবাহিনী ব্যারাক থেকে বের হয়ে যুদ্ধের সাঁজে সজ্জিত হয়। মোঘলরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুতেই লোদিবাহিনীকে চমকে দেন বাবর। তিনি অটোম্যানদের যুদ্ধের প্রথম কৌশল ‘তুলুঘমা’ অনুসরণ করেন। তুলুঘমা অর্থ শত্রুকে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলা।


৮ হাজার সৈনিক যখন লোদির ৪০ হাজার যোদ্ধাকে ঘিরে ফেললো, তখন সুলতান নিজেই খেই হারিয়ে ফেললেন। বিপদে পড়লে যেমন মানুষ তার সেরাটা দিয়ে আঘাত করতে চায়, তেমনি লোদি তার হস্তিবাহিনী দিয়ে চড়াও হলেন ঘিরে ফেলা মোঘল সৈনিকদের উপর।


কিন্তু তিনি আরো শক্ত করে পিছু হটাতে লাগলেন লোদিবাহিনীকে। এরপর সুবিধাজনক দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার পর বাবর পিছনে ফিরে তাকালেন। এরপর মৃদু ইশারা করলেন। বাবরের ইশারা পাওয়া মাত্রই হঠাৎ একসাথে ২০টি কামান গর্জে উঠলো। ভারতবর্ষের বাতাসে প্রথমবারের মতো বারুদের ভারি গন্ধ মিশে গেল।


লোদির হস্তিবাহিনী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা এর আগে কখনো কামানের আওয়াজ শোনেনি। একদিকে কামানের গোলায় লোদিবাহিনীর ঘোড়া, হাতি এবং সৈনিকদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। অপরদিকে হাতিগুলো ভয় পেয়ে আর সামনে অগ্রসর হতে রাজি হলো না। উল্টো হাতিগুলো পাগলের মতো লোদিবাহিনীর উপর চড়াও হলো। হাতির পায়ের তলায় পিষে যেতে থাকলেন সুলতানের সৈন্যরা।


বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী এবং তীরন্দাজ বাহিনী অতি উৎসাহে আক্রমণ চালাতে লাগলো। মোঘলরা লোদিবাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ না দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগলো। তাদের সাথে বাবরের অতিরিক্ত সৈনিকরা যোগ দিলে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ বাবরের হাতে চলে যায়।


যুদ্ধের তিন ঘন্টার মাথায় সুলতান ইব্রাহিম লোদি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে লোদি তখন যুদ্ধের তীব্রতায় সৈনিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অতিরিক্ত ফৌজ থাকার পরেও তিনি তাদের ব্যবহার করতে পারেননি। সুলতানের মৃত্যুর পর লোদিবাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয়।


বাবরের কৌশলের কাছে পরাজিত হলো দিল্লী সালতানাত। মাত্র ৮ হাজার সৈনিক নিয়ে ভারতের বুকে নিজেদের খুঁটি স্থাপন করলো মোঘলরা। যুদ্ধে লোদিবাহিনীর প্রায় ১৫ হাজার যোদ্ধা প্রাণ হারায়, যেখানে মোঘলদের প্রাণহানীর সংখ্যা মাত্র ৪ হাজারের কাছাকাছি।


যুদ্ধের তিনদিন পর পানিপথের বীর বাবর বিজয়ীর বেশে দিল্লী দখল করে নেন। শুরু হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, যার নাম মোঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুদ্ধে বাবরের একমাত্র কঠিন কাজ ছিল লোদিবাহিনীকে সামনে অগ্রসর হতে প্ররোচিত করা।


পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে মোঘল শাসনের শুরু হয়। মোঘলদের দ্বারা ভারতবর্ষের বুকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ব্যবহারের মাধ্যমে উপমহাদেশে যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ হয়।


Post a Comment

Previous Post Next Post